মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ই থাকছে। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে ‘সর্বোত্তম স্বার্থে’ আদালতের নির্দেশে ও বাবা মায়ের সম্মতিতে যেকোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ে হতে পারবে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬ খসড়ায় এভাবেই বলা আছে, যা এরই মধ্যে মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত হয়ে গেছে। তবে এই বিশেষ ক্ষেত্রে ১৮ এর নীচে ঠিক কত বছর বয়সে বিয়ে হতে পারে, তা আইনে নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। সমস্যাটা কিন্তু এখানেই। আমাদের আপত্তিটাও এই ‘সর্বোত্তম স্বার্থে’ শীর্ষক ব্যতিক্রমটা নিয়ে।আইনের এই ফাঁকটিরই যথেচ্ছ ব্যবহার করবে অভিভাবকরা। কারণ আমাদের সমাজে এখনও ১১/১২ বছর বয়সের বিয়েটাকেই বাল্যবিয়ে বলে মনে করা হয়। অধিকাংশ মানুষই মনে করে মেয়েদের বিয়ের উপযুক্ত বয়স ১৪ থেকে ১৫।
২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, ব্র্যাক, ইউনিসেফ, আইসিডিডিআরবি ও প্ল্যান বাংলাদেশের আলাদা আলাদাভাবে করা গবেষণায় দেখা গেছে আইনত নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে হচ্ছে। এর হার কমবেশি ৬৪ শতাংশ। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৬৫ শতাংশ মেয়ের বিয়ের গড় বয়স ১৫ দশমিক ৫৩। তবে সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো দেশে এখনও ১০ বছরের নীচে মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে। ১২ বছরের আগেই ২.২৬ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে।
কিন্তু কেন এই আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়েও আমাদের মেয়েদের এত কম বয়সে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? কেন বাল্যবিয়ের শিকার শতকরা ৬৩.৭৪ ভাগ ছাত্রী? এরা ঝরে পড়ছে স্কুল থেকে। এমনকি উৎপাদনশীল কাজের সাথে জড়িত শতকরা ১১.৬৩ ভাগ মেয়েও বাধ্য হয়ে চলে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি। মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দেয়ার কাজে সবচেয়ে সক্রিয় থাকে ঘটকরা। ৪১ ভাগেরও বেশি মেয়ের বিয়ে হয় ঘটকদের ফন্দি ফিকিরে পড়ে। পাত্রীর পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়রা এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন। কারণ সমাজে শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত এবং পড়াশোনা না জানা পুরুষদের অনেকেই তাদের শারীরিক ও অন্যান্য চাহিদা মেটানোর জন্য কমবয়সী মেয়ে বিয়ে করতে চায়। তারা মনে করে ১৬ বছরের কমবয়সী মেয়েরাই প্রকৃত ‘কুমারী’। এবং কমবয়সী মেয়ে বিয়ে করলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ হবে।
দেখা গেছে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হয়। এই হার ২৫.৪৬ শতাংশ। এরপর ভালো পাত্র পাওয়া গেছে, এই ছুঁতোয় বিয়ে দেয়া দেয়া হয় শতকরা ২২.৪৯ জনের। আর অভাব অনটনের কারণে কম বয়সেই বিয়ে দেয়া হয় ১৮.৯৯ জনের। এছাড়া ধর্মীয় বিশ্বাস, পড়াশোনায় কম উৎসাহ, যৌতুকের ভয়ে, সামাজিক চাপের কারণেও কিছু বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে।
তবে আমাদের মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেয়েদের বিয়ের বয়স নিয়ে প্রথম আলোকে দেয়া সাক্ষাৎকারে যেসব অনভিপ্রেত ঘটনার কথা বলেছেন, মানে কেন আইনে এই ব্যতিক্রমটা রাখা হচ্ছে বলে যেসব কারণ উল্লেখ করেছেন, আমরা বাস্তবে এর তেমন কোনো নজীর পাইনা। উনি বলেছেন, কোনো ঘটনা ঘটলে আদালত ও বাবা মায়ের সম্মতি থাকলে তবেই বিয়ে হতে পারে ১৮ এর আগে। তিনি বলেন, বাল্যবিয়ে বন্ধ করলেও কিশোর-কিশোরীদের প্রেম বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটি নয়। কোনো কিশোরী পরিস্থিতির শিকার হয়ে গর্ভবতী হলে তখন তার ভবিষ্যৎ কী হবে? অভিভাবকহীন প্রতিবন্ধী শিশুর থাকার জায়গা না থাকলে এবং ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তাকে কোথাও রাখাটা নিরাপদ মনে না হলে তাকে বিয়ে দেয়া যেতে পারে।
আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, এসব সমস্যা সমাধানের জন্য বিয়ে দিয়ে দেয়া কি কোনো উপায় হতে পারে? নাকি হওয়া উচিৎ? অভিভাবকহীন প্রতিবন্ধী মেয়ের দায়িত্ব নেবে রাষ্ট্র। তাকে বিয়ে দিলে তার সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। বাল্যবিয়ের কারণ হিসেবে কিশোর-কিশোরীর প্রেম বা গর্ভধারণের ঘটনা খুবই দুর্বল একটা যুক্তি। এক্ষেত্রেও বিয়েটা কোনো সমাধান হতে পারেনা। বরং সন্তানকে এইসব সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। যাতে তারা এইসব ঘটনা না ঘটায়।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের করা গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ১.৫ শতাংশ বাল্যবিয়ে হয় বিয়ে পূর্ববর্তী শারীরিক সম্পর্কের কারণে, যা খুবই নগণ্য বলে ধরে নেয়া যায়। তাও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের এই বয়সটা ১৬ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে বেশি। প্রেমের কারণে মাত্র ৫.৭৯ শতাংশ বিয়ে হয় বাল্য বয়সে। সাধারণত ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের এবং শহরে প্রেমের বিয়ে বেশি হয়।
এক্ষেত্রে খুবই আশংকাজনক এবং একই সাথে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো বরের বাড়ি থেকে ১২ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য খুবই চাপ দেয়া হয়। পাত্রপক্ষের কাছে এই বয়সের মেয়েদের চাহিদা অনেক বেশি। আর তাই এই বয়সেই বিয়ে দেয়াটা সহজ মনে করে পাত্রীর অভিভাবক। কাজেই আইনে এ সংক্রান্ত কোনো ব্যতিক্রম রাখা হলে ছলেবলে কৌশলে অভিভাবক, ঘটক, পাত্রপক্ষ এর সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করবে এবং অবশ্যই নেবে। খুব হাতেগোনা কয়েকটি ঘটনার জন্য আমরা কেন মেয়েশিশুদের জীবনটা হুমকির মুখে এনে দাঁড় করাচ্ছি?
এক অনুষ্ঠানে কথা হলো পিয়ার সাথে। বয়স মাত্র ১৭ বছর। খুব ভালো রেজাল্ট করে এসএসসি পাশ করেছে। বাবা মা বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন ভালো ছেলে পেয়ে। পাত্র ডাক্তার। পিয়া জানালো ওর অভিভাবক ওর মত নিয়েই বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন। জানতে চাইলাম ও কি স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছে বিয়েতে? বলল, না ওরা জোর করে রাজি করিয়েছে। ৪০ শতাংশ মেয়ে রয়েছে, যারা বিয়েতে রাজি না। জোর করে তাদের বিয়ে দেয়া হয় গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ৭৫.৯১ ভাগ মেয়েশিশু স্বীকার করেছে যে বিয়ের আগে মা বাবা তাদের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছে। এরমধ্যে যারা বাবা মায়ের চাপে বাধ্য হয়ে মত দিয়েছে পিয়া তাদের একজন। এদের সংখ্যা ৫৯.৬৪ শতাংশ।
বাল্যবিয়ে যে মেয়েদের জীবনে কতটা করুণ পরিণতি ডেকে আনতে পারে, এর অনেক উদাহরণ আছে আমাদের সমাজে। বাল্য বয়সে বিয়ে হলে মেয়েরা খুব সহজেই পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়, যৌতুকের বলি হয়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা বেশি হয়, দাম্পত্য ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, বহুগামিতা বৃদ্ধি পায়, নারী বৈষম্যেরও শিকার হয় সংসারের ভেতরে। এছাড়া মানসিক চাপ, শ্বশুরবাড়ির চাপ, শৈশব জীবন থেকে বঞ্চিত করা এবং জোর করে যৌনমিলন করানো হয়। কন্যাশিশু খুব অল্প বয়সে মা হয়, মা হতে গিয়ে মারা যায়, বিকলাঙ্গ ও অসুস্থ শিশুর জন্ম দেয়, গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। এছাড়া তার শিক্ষাজীবন অকালে শেষ হয়ে যায়। দেশে বেকারত্ব বেড়ে যায়। পরিবারে সদস্যসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যায়। মেয়েরা ঘরে-বাইরে কাজ করার ক্ষমতা হারায়।
একটা যুগ ছিল যখন ১৩ বছরের মেয়ের সাথে ৫০ বছরের পুরুষের বিয়ে হতো, আর এটাই ছিল স্বাভাবিক। আমার এক খালাকে দেখেছি ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে ২১ বছর বয়সে এসে দু’সন্তান নিয়ে বিধবা হতে। কত কষ্ট করে যে উনি জীবনে জয়ী হয়েছিলেন, তা ভাবাই যায়না। আমার আরেক খালার কাছে শুনেছি ৯ বছর বয়সে ৩০ বছর বয়সী স্বামীর ঘর করতে এসে তার কী দুর্দশাই না হয়েছিল। আমার দাদি কিংবা মায়ের আমলে এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এখন মেয়েরা আর অল্প বয়সে বা পড়াশোনা শেষ না করে বিয়ে করতে চায়না। কিন্তু জোরজবরদস্তি করে তাদের বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হচ্ছে। নারীর উন্নয়ন বা সাফল্যের এতটা পথ পার হওয়ার পরও কিন্তু এখনো আমাদের সমাজে বাল্যবিয়ের হার অনেক বেশি। আইনে ফাঁক রেখে একে আরো জোরদার করা কি ঠিক হবে? আশা করি সরকার বিষয়টি আমলে নেবেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)