ম্যাডাম হিলারি, এখন আপনার নিবাস, কার্যালয়, ক্লিনটন ফাউন্ডেশন-এর কর্মপ্রান্তর, কোথায় কী, খোদ মার্কিনি মিডিয়ায়ও তেমন দেখিনা। তবুও সেই আপনার কথাই মনে পড়ে গেলো! না, গুগল খুলে আপনার সন্ধান করবারও ইচ্ছে কিংবা ধৈর্য হয়না। তবুও আপনার কথাই এই সুদূর বাংলাদেশ থেকে পূবাল হাওয়ার পশ্চিমে বয়ে যাওয়ার সুর ও গতি আপনার শ্রবণকুহরে যদি প্রবেশ করানো যেতো! যদি এই ক্ষমতাহীন লিখিয়ের একটি শব্দও শুনতে পেতেন, তবে সেই শব্দটি হতো ‘সরি! ইংরেজি শব্দটির বঙ্গার্থ হচ্ছে ‘দুঃখিত’।
দুঃখিত ম্যাডাম। মাদাম কিংবা ম্যাদমঁয়জেলও বলতে পারি আপনাকে। চার বছর আগে মার্কিনি ইতিহাসের ‘নিকৃষ্টতম প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়া ব্যক্তিটির সঙ্গে নির্বাচনে আপনি ‘পপুলার’ ভোটে জিতে গেলেও ‘ইলেকটোরাল’ ক্যাঁচকা কলের ভেল্কিতে হেরে গেলেন। পৃথিবীব্যাপী অনেকেই ‘দুঃখিত’ হলো। কিন্তু ম্যাডাম, আমরা কতিপয় চাঁড়াল বাঙ্গাল কেন যেন ‘দুঃখিত’ হতে পারিনি। যদিও আমাদের বিপুল সংখ্যক ‘সুশীল’ ছাপ্পড় মারা বাংলাদেশীরা কপালে হাত দিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে ভেউ ভেউ কান্না জুড়ে দিতে পারলে তাদের ‘দুঃখ’ হাল্কা করতে পারতেন। ভেউ ভেউ ঘেউ ঘেউ তো ঐ সুশীল-এলিটদের শোভা পায়না। ওদের বদনখানি মলিন, মলিনতর, মলিনতম হয়ে গিয়েছিল। কেননা তারা রেডি, ওয়ান্টু, গেট সেট হয়ে গিয়েছিল। আপনি সাদা ভবনে ঢুকেছেন মানেই তারা বাংলাদেশে গণভবন, বঙ্গভবনে সুড়ুৎ ঢুকে যাবে। বরং তাদের বদনই ‘সাদা’ হয়ে গিয়েছিল তখন। অবশ্য ওদের দুখ্খু আর হাহাকারের গভীরতা বুঝার আপনার ফুরসৎ ছিলনা।
কেননা, আপনার নিজের দুঃখই তখন হিমালয়, হিন্দুকুশ, থাই, আল্পস, আন্দিজ পর্বতের চেয়েও ভারি হয়ে গিয়েছিল। ভাবতেই পারেননি, মার্কিনি কয়েকটি পুঁচকে স্টেটের ইলেকটোরাল ব্লো আপনাকে অমন কুপোকাৎ করে দেবে। মাকির্নি ‘মহাগণতন্ত্রের’ ইতিহাসে প্রথম ‘মহিলা প্রেসিডেন্ট’ হবার অবশ্য সম্ভাবনা এভাবে মাঠে মারা যাবে। ঐ ছোট স্টেটগুলোকে আপনি নগন্য বিবেচনা করে নাকি ওসব জায়গায় নির্বাচনী সফরেই যাননি। উচ্চাকাঙ্ক্ষা অবশ্যই অতিপ্রয়োজন, সেই উচ্চাকাংখার নাসিকা যদি নীচের ভাগকে অন্ধকার করে দেয় তবে যা ঘটার তাই ঘটেছিল। আমাদের সুশীলবর্গ তখন ভেঙে পড়েছিল।
আমরা ‘কুশীল নিম্নবর্গের’ অনেকেই ভয়াল বিপদ থেকে ত্রাণ পেয়ে ‘হ্যাপি’ হয়েছিলাম। এটা নিছক স্বদেশের বিষয়। আমাদের মাতৃভূমির বিষয়। আমাদের জাতীয়তাবোধ আশংকিত হয়ে পড়েছিল। আমাদের ‘অর্থনৈতিক সম্ভাবনার স্থাপনা’ বিপন্ন হতে চলেছিল। সেসময় ভেবেছি, ট্রাম্প আসুক আর ঘ্রাম্প আসুক, কিছুই আসে যায় না, শুধু আপনি না আসুন। ট্রাম্প হাসুন, আপনি কেঁদে ভাসুন।
কেননা আমরা মার্ক্সীয় প্রত্যয় ‘কার্যকারণ’ বুঝি। ওবামার সাথে ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে হেরে প্রথমবার ‘ প্রেসিডেন্ট’ হবার চেষ্টায় আপনি ‘নকআউট’ হয়ে গিয়েছিলেন। তবুও আপনাকে বাগে রাখার সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে আপনি হয়ে গেলেন মার্কিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। হাসি খুশিতে বাগ বাগ আমাদের সুশীল আর মিডিয়া টাইকুনেরা। এবার কেল্লা ফতে হবার জেল্লা। বাংলাদেশের ক্ষমতা থেকে ঐ ‘অসহ্য নারীকে’ নিষ্ক্রান্ত করবোই। পদ্মা সেতু বানিয়ে ‘ইমেজ’ গড়ে ক্ষমতার ‘প্রিমিজ’ ধবধবা করবেন, সে সুযোগ তাকে কোনোক্রমেই দেয়া যাবে না। বিশ্বব্যাংক বোকামি করে এ ‘শক্ত’ নারীর গদিকে ‘ পোক্ত’ করে দেবার যে রেকর্ড অর্থায়ন করেছে, তা ভন্ডুল করে দিতে হবে। অতএব মহামতি লেনিনের একটি পুস্তকের শিরোনাম ‘কী করিতে হইবে’-এর মতো ঐসব সুশীলেরাও অংক কষতে থাকলেন। ঐসব সুশীলদের অনেকেই আবার দীর্ঘকাল মার্কস-লেনিন তপস্বী ছিলেন, এখন তপসে মাছ খাবার বিল্লি-তপস্বীতে রূপান্তরিত হয়েছেন মহারথীরা।
অতএব বুদ্ধি আঁটবার কতো যে গোপন অধিবেশন। ওসবে যারা যারা আছেন, তার ভেতর স্বচ্ছতা-আন্তর্জাতিকেরাও আছেন। স্বচ্ছতাওয়ালাদের গোপন কর্মকান্ডের একটি করে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে পাঠক, আপনারা পাগল হয়ে যাবেন। এক-এগারোর মোক্ষম বল্লম ব্যর্থ হলেও তারা হাল ছাড়েননি। ‘বি’ থেকে ‘ডি’ হওয়া অর্থনীতির শার্দুল জাঁদরেল, মিডিয়া টাইকুন আর স্বচ্ছতা মহানরা একজন ক্ষুদ্র কারবারের বিশাল বিশ্ব-ব্যক্তিত্বকে সামনে রেখে পুনঃআক্রমণ শানালেন। বিশ্বব্যাংক প্রধান জোয়েলিক মিয়া আবার ম্যাডাম আপনারই একান্তজন । আপনি বঙ্গদেশী ক্ষুদ্র থেকে বিশাল হওয়া ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানের তহবিল যোগাড় করে ‘কমিশন’ রোশনাইয়ে আপনাদের ক্লিন্টন ফাউন্ডেশনকে নিয়মিত আলোকিত করে যে ‘ব্যবসায়িক সেতু’ গড়েছেন, সেই প্রভাবেই ‘পদ্মা সেতু’ কে এ পৃথিবী থেকে ‘নাই’ করে দিতে হবে। আপনি তাতে সম্মতি দিলেন। আওয়াজ তুলে দেয়া হলো পদ্মা সেতু নিয়ে ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্র’ হয়েছে। ঐ ‘অবাধ্য’ নারীর পরিবারকে নাস্তানাবুদ করার ছক পূরণে নানাপ্রকার নাস্তা-সুস্বাদু খাবার এবং সুধার নহর বইতে থাকলো হেথা হোথা। একটি ডলারও ছাড় করেনি, তবুও মিলিয়ন ডলারের দুর্নীতি নিয়ে ডংকা নিনাদ প্রচারণা।
ম্যাডাম, দুর্নীতি কী, কাহাকে বলে, কীভাবে হয়, কতটুকু হলো, এই মর্ত্ত্যভূমিতে দুর্নীতির গর্ত কোথা কোথা তা আপনাদের গোয়েন্দা বিভাগের চেয়ে বেশি কেউ জানে কী! তবুও তোলো আওয়াজ ‘দুর্নীতি-ষড়যন্ত্রের’। এমনই আওয়াজ। ধুন্ধুমার কাণ্ড। বিশ্বব্যাংকে দীর্ঘকাল কাজ করা ‘সেমি-যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে সন্দেহকৃত গণি মিয়াও এই আওয়াজে শামিল। এবং পেলে-ম্যারাডোনা-মেসি-রোনাল্ডোর মিলিত আক্রমণে যেমন অনিবার্য মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম গোলটি করা যেতো, বিশ্বব্যাংক প্রধান সে সময় তার চেয়েও চমকপ্রদ গোলটি করে ফেললেন আপনারই মহা মদদে। কিন্তু হায়, একটু ফাউল হয়ে গেলো। কার্যকালের শেষদিনে কোনো ফাইলে স্বাক্ষর করাও সঠিক নয়। জোয়েলিক মিয়া সেই ফাউল স্বাক্ষরটি করে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংককে সরিয়ে নিলেন। খবর আসে বিশ্বব্যাংক দফতর থেকেই। এই জোয়েলিক মিয়ার দরবারে ধর্ণা দিতে আমাদের দেশ থেকে কারা কারা কখন গিয়েছিলেন সেসব রেকর্ড কী ডিজিটাল-ইশ্বরেরা জানেন না?
সেসব কথা থাক ম্যাডাম। জানি এই বঙ্গদেশী ঘ্যান ঘ্যানে আপনি বিরক্ত হচ্ছেন। মাত্র চার বছরের মাথায় আপনাদের দলের একজন কম গ্লামারের বুড়ো নরম সরম মানুষ ঐ ট্রাম্পের গরম ড্রামকে নিশেষে ঠান্ডা করে দিলেন। তবুও ট্রাম্প ভায়ার ড্রাম-বুদ্বুদ যায়না। অথচ আপনি বিশ্ব-উচ্চাকাংখী গ্ল্যামার রাজনীতিক হয়েও মার্কিনি গণতন্ত্রে পরাজয় মেনে নিয়েছিলেন। এবার সিএনএন, এবিসি, এনবিসি, আলজাজিরা ইত্যাদি যতো চ্যানেলই দেখি একবার মাত্র কয়েক সেকেন্ড-এর জন্য আপনাকে দেখেছি। আপনি কি তাহলে উহ্য হয়ে গেছেন মার্কিনি রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে!
তা হোন বা না হোন, আপনি যে হঠাৎ অতি দূর সমুদ্রের কিনারের একটি আকারে ক্ষুদ্র-জনসংখ্যায় বিশাল দেশে প্রাসঙ্গিক হয়ে গেছেন হঠাৎ, সে খবরটা পেয়েছেন? নিশ্চয়ই জানেন, ক্ষুদ্র দেশের ঐ ‘অবাধ্য’ নারী অতঃপর কী করেছিলেন! দেশের মানবপ্রেমী বিশেষজ্ঞ এবং প্রকৌশলীদের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং অধিকাংশের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে দেবদারু-গ্রীবার মহিমা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের চিত্ত-পিত্ত-প্লীহা চমকে দিয়ে সংস্থাটির জন্মের পর সবচেয়ে মোক্ষম নাকানি এবং প্রকান্ড চুবানি দিয়ে ঘোষণা করলেন, বিশ্বব্যাংক, চাইনা তোমাদের করুণা, যথেষ্ট অপমান সয়েছি, আর নয়। আমরা এবার নিজেদের অর্থেই আমাদের পদ্মা নদীর এপার-ওপার সেতুবন্ধ তৈরি করবো। চমকে গেলো বিশ্বের নানা প্রকরণের মাতব্বরেরা।
তখন আমাদের সুশীলেরা ভড়কে গিয়েও, হায় হায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেঙে যাবে বলে অশ্রুসজল কুম্ভীর গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমাদের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বুলন্দ আওয়াজী বাহিনী সামান্য একটি ধন্যবাদ দিতেও পৃথিবীর বৃহত্তম কার্পণ্য দেখালেন। তবে সাধারণ অনেক মানুষকেই দেখেছি খুশি হতে। নিজের দেশকে মেরুদণ্ডী দেখলে মতলববাজ ছাড়া সবারইতো গর্বিত হবার কথা।
তারপর? সরকার। আমাদের নিজস্ব প্রকৌশলী পরামর্শ বিশেষজ্ঞ। বিদেশি ঠিকাদার। আমাদের অর্থ। পৃথিবীর অন্যতম জটিল নদীর উপর জটিলতর সেতু। কতো যে ‘চ্যালেঞ্জ’ বিশাল কর্মযজ্ঞে। কাজ এগিয়ে যায়। এগিয়ে যায়।
সেতু বিরোধী চক্র হঠাৎ ‘ সেতুর জন্য শিশুর কল্লা দরকার’ বলে গুজব ছড়িয়ে দিলো। আতংকিত হলো সাধারণ সরল মানুষেরা। আমাদের ‘জ্ঞানী’ বিরোধী নেত্রী বললেন, এই সেতুতে পদ্মা পাড়ি দেবেননা, দেবেননা। এটা ভেঙে চুরে যাবে। ট্রাম্পের নির্বাচনী আজগুবি অভিযোগ বিশ্বাস করার লোক খোদ আমেরিকায় পর্যন্ড আছে। বিরোধী নেত্রীর কথা বিশ্বাস করার একজন তার দলীয় লোক এখনও খুঁজে পাইনি। বরং পদ্মাপাড়ের খেঁকশিয়ালের কেয়া হুুয়া হাসির কলকল-আওয়াজ তখন নাকি হুহু বেড়ে গিয়েছিলো।
অবশেষে যুক্ত হলো মুক্ত। ২০২০ সালের বিজয় দিবসের পূর্বাহ্নেই ৪১টি স্প্যানে পদ্মা সেতুর বাহ্যিক রূপ মূর্ত হয়ে গেলো শত ব্যারিকেড অতিক্রম করে। মিডিয়া টাইকুনদের মুখ চুন হলো কিনা জানিনা। মহাজ্ঞানী ‘ডি’ অর্থনীতিবিদেরা কী হিসাব কীভাবে দেবে জানিনা। ক্ষুদ্র ঋণের বিশাল মানবদের কোনো বাহ্যিক প্রতিক্রিয়া এখনো দেখিনি। অথচ সামান্য ‘লজ্জা’ নামক উপাদান থাকলে ওরা পদ্মাপারে গিয়ে সেতুর ভাস্কর্যের সামনে নতজানু হয়ে মহাকালের ‘ক্ষমাপ্রার্থনা’ অনুষ্ঠান করে ‘নাকে খত’ এর বিকল্প আয়োজনে নিজেদের ‘সুশীলতা’র এক ফোঁটা প্রমাণ করতে পারতো।
সরি! ম্যাডাম হিলারি। এতোসব কথা বলে আপনার অতিশয় মূল্যবান ‘ক্লিন্টন ফাউন্ডেশন কমিশন’ সংস্থার কাজে ব্যাঘাত ঘটানোতে একান্ত দুঃখ প্রকাশ করছি। ক্ষুদ্র বাংলাদেশের দুঃসাহসিক নেতৃত্বের প্রকৃত বিশাল শক্তি নিশ্চয়ই আপনাদের বিমূঢ় করে দিয়েছে।
তবে বিচার হবে। দেশি বিদেশি আপনাদের ষড়যন্ত্রের ফলে আমরা যে তিনটি বছর হারিয়েছি,তার একটি আর্থিক হিসাব হবে। কড়ায় গন্ডায় সে হিসাব ইতিহাসের কাছে আপনাদের চুকাতেই হবে ম্যাডাম!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)