বাংলাদেশে তালিকা হচ্ছে দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারদের৷ সত্যিই কি তাই? আর এমনটি হলে যারা রাজকোষ হতে টাকা বের করে দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারদের হাতে তুলে দিলো তাদের তালিকা কেন নয়?
শোনা যাচ্ছে মানসম্মতভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য স্বচ্ছ ও দক্ষ ঠিকাদার নিয়োগের উদ্যোগ নিতে চলেছে সরকার। গত পাঁচ বছরে মানহীনভাবে বাস্তবায়িত প্রকল্পের ঠিকাদারদের কালো তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। যেসব ঠিকাদার দুর্নীতিবাজ ও অদক্ষ তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। যদি তাই হয়, যারা রাজকোষ হতে বরাদ্দ নিয়ে লুণ্ঠনকারী ঠিকাদারদের হাতে তুলে দিয়েছে তারা কেন কালো তালিকায় নয়?
যে বাবার সন্তান জুয়া খেলে, টাকা হারায়, টাকা অন্যের হাতে তুলে দেয় ও বন্ধুদের সাথে ফূর্তি করে টাকা উড়ায়, সেক্ষেত্রে বাবা কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়? ছেলের সঙ্গীদের না ছেলের? দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে (২০১৪-২০১৮) যেসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, সেগুলোর ঠিকাদারদের বিস্তারিত তথ্য নিচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
সম্প্রতি সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থায় চিঠি দিয়ে গত পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন হয়েছে এমন সব প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। যাদের মাধ্যমে রাজকোষের টাকা এসব ঠিকাদারদের হাতে গেল তথ্যটা সর্বাগ্রে তাদের কাছে চাওয়াটাই কি যৌক্তিক ছিলোনা?
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে প্রত্যেকটি প্রকল্পের নাম, ব্যয়, বাস্তবায়ন অগ্রগতি এবং প্রকল্পটি কোন ঠিকাদার বাস্তবায়ন করেছেন, সেই তথ্য দিতে বলা হয়েছে। ঠিকাদাররা উন্মুক্ত, সরাসরি না সীমিত দরপত্র পদ্ধতিতে কাজ পেয়েছে তাও জানাতে বলা হয়েছে৷ প্রকল্পের গুণগত মান বিষয়ে বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থার প্রধানদেরকেও মতামত দিতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য শামসুল আলম মত দিয়েছেন, এটি সময়োপযোগী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। কারণ এখন প্রকল্পের মান নিয়ে সুশীল সমাজ ও সরকারের ভেতরেই প্রশ্ন উঠছে। এ জন্য দেখা দরকার কারা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। একই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বারবার প্রকল্প পাচ্ছে কি না তাও খতিয়ে দেখা দরকার। তাদের অন্য কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা আছে কি-না সেটা জানাও জরুরি। এটা খুবই একটা গুরুত্বপূর্ন ভাবনা৷
মানহীনভাবে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে বা সময়মতো বাস্তবায়ন হয়নি ওই সব প্রকল্পের ঠিকাদারদের অন্য কোন সম্পৃক্ততা রয়েছে কি-না সেটাই সবার আগে দেখতে হবে। কারণ ঠিকাদাররা সিন্ডিকেট করেই এসব লুটপাট করে থাকে৷ সুতরাং কালো তালিকাভূক্ত শুধু এই ঠিকাদারদের নয় করতে হবে পুরো সিন্ডিকেটকে৷ ঠিকাদাররা কীভাবে ও কার মাধ্যমে কাজ পেয়েছে তাও খুঁজে বের করতে হবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে উন্নয়ন সহায়তা থোকসহ এডিপিতে ১৫২১ প্রকল্প ছিল। এসব প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৬৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের এডিপিতে ১৪৫৭টি প্রকল্প ছিল, যাতে বরাদ্দ ছিল ৭৭ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৫৫৭টি প্রকল্পে ৯৩ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রকল্প ছিল ১৭১০টি, আর বরাদ্দ ছিল এক লাখ ১৯ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এডিপিতে মোট প্রকল্প ছিল ১৭২৩টি। এসব প্রকল্পে এক লাখ ৫৭ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়।
এসব কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ নিয়ে গড়ে উঠছে সিন্ডিকেট৷ যারা বরাদ্দ বের করেছে অনেক ক্ষেত্রে তারা নিজেরাও জড়িত আছে নেপথ্য সিন্ডিকেটে৷ আবার কেউ কেউ সিন্ডিকেটের কাছে অসহায়৷ এক্ষেত্রে শুধু দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারদের কালো তালিকাভূক্ত করলেই হবে না৷ চিহ্নিত করতে হবে সিন্ডিকেটকে। আর এ দায়িত্ব দিতে হবে যাদের মাধ্যমে রাজকোষ হতে অর্থ বের হয়েছে তাদেরকে৷ জনগণের আমানত বের করে তারা রক্ষা করতে পারবে না তাহলে তারা তা বের করল কেন? কেন তারা ঠিকাদারকে এসব অর্থের সদ্ব্যবহারে বাধ্য করতে পারলো না? সিন্ডিকেটের ক্ষমতা কি তাদের ক্ষমতার চেয়ে বেশী?
জনতার অর্থ অপচয়কারীদের মূল হোতাদের জনতার সামনে তুলে ধরতে হবে৷ আরও উন্মোচন করতে হবে তাদের ক্ষমতার উৎসকে৷ বাবা-মার যে সন্তান বাবা-মার কাছ হতে টাকা নিয়ে নেশা-ভাঙ করে ও সে অর্থ জুয়ারির হাতে তুলে দেয়৷ বাবা-মা তা জানতে পারলে কি সে পুত্রের হাতে দ্বিতীয়বার অর্থ দিতে চায়?রাজকোষ ও সরকার জনতার বাবা মার মত নয় কি?
তাই এ দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে৷ যাদের মাধ্যমে রাজকোষ হতে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে সে টাকার হিসাব প্রথমে তার কাছে চাওয়াই সংগত নয় কি? কোটি কোটি টাকার বরাদ্দ নিয়ে গড়ে উঠছে সিন্ডিকেট৷ ঠিকাদারকে সামনে রেখে নেপথ্যে থাকে তারা৷ পছন্দের ঠিকাদারকে দিয়ে আড়ালে থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই চক্র৷ শুধু ঠিকাদাররাই এই দুর্নীতির মূলে নয়৷ মূলে রয়েছে অনেক ক্ষমতাধর হোমরা-চোমরা৷
এদের তালিকা করবে কে? দুদক কি তা পারবে? মনে হয়না, কারণ ওখানে সর্ষেতেই ভূত আছে৷ দায়িত্বটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় নয় খোদ প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হবে৷ আর সেটা শুরু করতে হবে যাদের মাধ্যমে বরাদ্দ ছাড় হয়েছে তাদের কাছেই হিসাব চাওয়ার মধ্য দিয়ে৷ এমনটি না করতে পারলে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান কেবল মুখে বলাবলিতেই রবে কাজের কাজ কিছুই হবে না৷
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)