সম্প্রতি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার ‘কর্তৃপক্ষের’ একটি আদেশের ছবিতে চোখ আটকে গেল। সেখানে লেখা ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও তাদের পরিবারবর্গ এবং ছাত্র-ছাত্রী ব্যতীত এখানে বহিরাগত রোগী দেখা হয় না।’ এই ছবিতে অগ্রাধিকারের যে ক্রম সেটা আক্ষরিক অর্থেই যেন সরকারি যে কোন প্রতিষ্ঠানের বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে। অর্থাৎ যাদের জন্য প্রতিষ্ঠান অগ্রাধিকারের ক্রমে তারাই সবচেয়ে নিচে অবস্থান করে।
একথা বলাই বাহুল্য যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় শিক্ষার্থীদের জন্যই এবং ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে যেকোন কিছুই প্রতিষ্ঠিত হয় শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করেই। অথচ সুবিধা গ্রহনে তারা যেন উছিলা মাত্র। অগ্রাধিকারের বিবেচনায় তারা কর্মকর্তা-কর্মচারীতো বটেই তাদের পরিবারবর্গের চেয়েও নিচে অবস্থান করে।
কেবল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ই নয় দেশের সব সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অন্য যেকোন সরকারি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা কমবেশি একই রকম। যাদের জন্য প্রতিষ্ঠান তৈরি অগ্রাধিকারের প্রশ্নে তারাই সবচেয়ে অবহেলিত শ্রেণী।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই শত শত কর্মকর্তা কর্মচারী থাকেন। কিন্তু এদের বেশিরভাগকে দেখেই বোঝার উপায় নেই যে এদের আসল দায়িত্ব আসলে কী। তারা কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির সুবিধাই ভোগ করছেন না অনেকে ক্যাম্পাসের মধ্যেই ব্যবসা খুলে বসেছেন। এবং মূল দায়িত্বেরর চেয়ে তাদের এ ব্যবসার প্রতিই মনোযোগ বেশি! হলগুলোর দোকান, মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসাসহ নানা ধরনের ব্যবসা খুলে বসেন কর্মচারীরা। কিন্তু তার চাকরির মূল যে দায়িত্ব সে ব্যাপারে তাদের তেমন কোন আগ্রহই দেখা যায় না।
কর্তৃপক্ষের অগোচরে ক্যান্টিন খুলে ব্যবসা পরিচালনা করার দায়ে কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক কর্মচারীকে বহিষ্কার করেছে। তবে চারুকলার ক্যান্টিন পরিচালনাকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই কর্মচারীকে বহিষ্কারের পেছনে রয়েছে এবারের পয়লা বৈশাখে ‘গরুর মাংস কেলেঙ্কারির’ অভিযোগ। তা না হলে আদৌ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হত কি না সেটা অবশ্য প্রশ্ন। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কর্মচারীই প্রকাশ্যে বা গোপনে পরিচালনা করছেন আরও অনেক ব্যবসা। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোন ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই।
শুধু তাই নয় ভর্তি, সনদ, নম্বরপত্র ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তুলতে গিয়েও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। কর্মকর্তাদের দ্বারা শিক্ষার্থীদের হয়রানি এমনকি অপমান হওয়ার মত গুরুতর অভিযোগও আছে প্রায় প্রতিটি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অথচ দেখার যেন কেউ নেই!
শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই নয়, অন্য প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও প্রায়ই একই রকম। সেদিন এক আত্মীয়কে চিকিৎসা করাতে গেলাম রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে দেখা গেল ডাক্তারের পরামর্শসহ প্রতিটি শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং রিপোর্ট ডেলিভারির জায়গায় স্টাফদের জন্য আলাদা লাইন রয়েছে। এমনকি সাধারণ রোগীদের লাইনেও তাদেরই অগ্রাধিকার। নিজ প্রতিষ্ঠানের স্টাফরা একটু বাড়তি সুবিধা পেতেই পারেন। কিন্তু যখন দেখলাম তাদের জন্য নির্ধারিত লাইন সবসময়ই পুর্ণ থাকছে এবং সাধারণ রোগীদের তুলনায় তাদের অনুপাত নেহাত কম নয়, তখনই প্রশ্ন জাগে যে ওই লাইন কি আসলে স্টাফরাই ব্যবহার করছে নাকি সেটি ব্যবহার করা হচ্ছে ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য।
আরেকটি ব্যাপার লক্ষনীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে। একই পরিবারের একাধিক স্টাফ দেখা যায় এখানে। একটি পরিবারের কর্মক্ষম প্রায় প্রতিটি ব্যক্তিই একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমন নজিরও রয়েছে। ফলে পেশাগত দায়িত্বের চেয়ে তাদের পারিবারিক কাজেই বেশি মনোযোগী দেখা যায়।
দেশের প্রতিটি সরকারি প্রতিষ্ঠানই সেবামূলক। কোন বিশেষ জনগোষ্ঠীকে সেবা দেওয়ার জন্যই তা প্রতিষ্ঠা করা হয়। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া এবং শিক্ষার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করার জন্য যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়, তেমনি সাধারণ রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্যই তৈরি করা হয় হাসপাতাল। কিন্তু কাগজে কলমে যাদের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি তারা কি কাঙ্ক্ষিত সেবা বা সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)