চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

সরকারি ডাক্তারদের এই অবস্থা কেন?

সম্পদে ও সম্ভাবনায় ভরপুর আমাদের প্রিয় দেশ আজ থেকে ৪৬ বছর আগে একটি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ আমরা আস্বাদন করতে পারছি না। দেশ কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগুতে পারছে না। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে নানা রাজনৈতিক সঙ্কট তো আছেই, এর সাথে যোগসাজশ আছে এদেশের শিক্ষিত মানুষদের একাংশের তৈরি আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার। আমলাতন্ত্রের চরিত্র নির্ধারণ করার কথা সংশ্লিষ্ট সমাজের। কিন্তু বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রই যেন সমাজ ও রাজনীতির চরিত্র নির্ধারণ করতে চলেছে! আমলাতন্ত্রের কোন কোন অংশ আজ এতটাই আধিপত্যবাদী হয়ে উঠেছে যে স্বাস্থ্যের মত মহা জনগুরুত্বপূর্ণ খাতেও নানা খাদ এবং খুঁত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দাফতরিক আমলাতন্ত্র যখন একটি  দেশের ক্ষমতা, মর্যাদা আর সুযোগ সুবিধার স্থায়ী কেন্দ্র হয়ে যায়, তখন সমাজের মেধাবী মানুষগুলোর একটা বিরাট অংশ যথাযথ রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক মূল্যায়ন পান না। তেমনি একটি মেধাবী পেশাগত শ্রেণী হচ্ছে সরকারী ডাক্তাররা। সবচেয়ে মেধাবী হয়েও যারা এই রাষ্ট্রের সবচেয়ে কম সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন চাকরি করে থাকেন তারা হলেন এদেশের সরকারী ডাক্তারগণ।  

একটি জাতির অন্যতম দরকারি মানব সম্পদ হচ্ছে চিকিৎসকগণ। দুর্বল স্বাস্থ্যের জনতা দিয়ে কোন জাতি উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারেনি। জনতার শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রেখে একটি উৎপাদনশীল জাতি যারা নির্মাণ করবেন সেই ডাক্তারদের যারা সিভিল সার্ভিসে আসেন তাঁদেরকে রাষ্ট্র এবং সমাজ কী হালতে রেখেছে তা নিয়ে আজকের আমার এই লেখা। একজন পড়তে-লিখতে জানা নাগরিক হিসেবে আমি যা প্রত্যক্ষ করেছি, যা জেনেছি, অনুধাবন করেছি তার উপর ভিত্তি করে এই লেখা।

যারা ডাক্তার হিসেবে সিভিল সার্ভিসে আসেন তাঁদের অভিজ্ঞতা, সুবিধা-অসুবিধা অন্য কোন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সাথে মেলেনা। ডাক্তারদের অবস্থা দেখে বোধ করি স্বয়ং ঈশ্বরও দেশের রাজনীতি ও জনপ্রশাসনের মুন্সিয়ানায় (!) অবাক না হয়ে পারেন না। এই ডাক্তাররা চাকুরীতে জয়েন করার আগের জীবন এবং  পরের জীবন কোনভাবেই মেলাতে পারেননা। বিশেষ করে সদ্য এমবিবিএস পাশ করা মেডিক্যাল স্টুডেন্টরা বিসিএসে জয়েন করার আগে কল্পনাও করতে পারেননা সামনের দিনগুলোতে জীবন কতবার, কীভাবে রঙ পালটাবে! 

স্কুলের যে ছেলে/মেয়েরা ট্র্যাডিশনালি সবচেয়ে মেধাবী তাদেরকে বিজ্ঞান শাখায় পড়াশুনার জন্য অভিভাবক এবং শিক্ষকরা বেছে নেন। অঙ্ক, বিজ্ঞান, সমাজ, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে বেশি পারদর্শী হন বলেই এরা অন্যদের তুলনায় মেধাবী বলে বিবেচিত হন। সবচেয়ে মেধাবীদের মধ্য থেকে অনেকে ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার হন। বিজ্ঞান ভালো বুঝেন এমন কেউ যদি সাহিত্য বা সিনেমা-নাটকেও আসেন তাহলে কীরকম সৃজনশীল এবং উৎপাদনশীল হতে পারেন বাঙ্গালীর জগতে তাঁর বড় উদাহরণ তো আমাদের দেশের হুমায়ূন আহমেদই আছেন। যাইহোক মূলকথায় আসি। এই সবচেয়ে মেধাবীরা যতদিন পড়াশুনা করেন ঠিক আছে, কিন্তু যখনি সরকারি চাকুরীতে আসেন শুরু হয় দুর্গতি। এ লেখায় ফরেন ক্যাডাররা আলোচনায় আসবেন না। কারণ তাঁদের কাজের ধরণ এবং ধারণা এমনি এলিট যে ঢাকায় সদর দফতরে অফিস করেও ওনাদের মন খারাপ থাকে। ইউরোপ এবং মার্কিন মুল্লুকে পোস্টিং পাওয়াকেই এখানে ভালো পোস্টিং হিসেবে ভাবা হয় ।ফলে আমার আলোচনা ঘুরপাক খাবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যারা কাজ করছেন তাদেরকে নিয়ে। জুডিশিয়াল সার্ভিসে আসার পরীক্ষা-পদ্ধতি ভিন্ন হলেও এ সার্ভিসের অফিসাররাও এ আলোচনায় আসবেন।  

জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ বা তথ্য কর্মকর্তার পোস্টিং হয় জেলা লেভেলে; নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের পোস্টিং হয় উপজিলা লেভেলে। প্রকৌশলীদের পোস্টিংও হয় উপজিলা লেভেলে। সবার জন্য গোছানো অফিস থাকে; যার যার কর্মচারীর বহর থাকে। বিশেষ করে জুডিশিয়াল ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের অফিস স্ট্যাটাস আর স্টাইলের সাথে বাকিদের কোনভাবেই মেলানো যায়না। অফিসিয়াল নিরাপত্তা, খেদমতে ওস্তাদ কর্মচারী বাহিনী, সন্ধ্যা হলে টেনিস কোর্ট, গাড়ি, জনমানুষে এবং জনমানসে অবতার-সম ‘শ্রদ্ধা’ অথবা ‘ভয়’- কী নেই এই মহামহিমদের জীবনে!        

এই প্রশাসনিক অভিজাতদের সাথে সরকারি ডাক্তারদের জীবন একটু মিলিয়ে দেখুন। অনেক সরকারি ডাক্তার চাকুরী জীবনের প্রথম দু বছর যেসব জায়গায় পোস্টিং পান, যে ধরণের স্থাপনায় বসে অফিস করেন, সেখানে একজন এএসপি/জুডিশিয়াল/নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এর জীবনে গাড়ি নিয়ে ঘুরতেও যাওয়ার কথা না। অনেক জায়গায় গাড়ি নিয়ে যেতেও পারবেন না। কারণ রাস্তা নাই। অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরও সেখানে যাওয়ার কথা না। ইউনিয়ন লেভেলে কমিউনিটি ক্লিনিক কিংবা সাব-সেন্টারে অফিস থাকে সিভিল সার্ভিসে আসা ডাক্তারদের। এসব অফিসের অনেকগুলোতে আবার  আসবাবপত্র থাকে ভাঙ্গাচোরা। তিনপেয়ে চেয়ার আর ভাঙ্গা গ্রিলের জানালা এসবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অনেক  ক্ষেত্রে অফিসে বিদ্যুৎ থাকেনা। যেখানে অফিস থাকে সে এলাকায় গ্যাস নাই, ইন্টারনেট নাই, হোটেল নাই, রেস্টুরেন্ট নাই, পার্ক, খেলার মাঠ কিছুই নাই। সাব-সেন্টারের সবকিছুর ‘মালিক’ থাকেন একজন ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার ভিজিটর (এফডব্লিউভি) নামে পরিচিত একজন সরকারি স্বাস্থ্যকর্মী যার সাথে এই ডাক্তারদের অফিস শেয়ার করতে হয়। এফডব্লিউভিরা আবার স্বামী-স্ত্রী নিয়ে সাব-সেন্টারের উপরেই বসবাস করেন। তদুপরি, এই এফডব্লিউভিরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন কেউ নন।ইনারা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আওতাধীন। ফলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিসিএস কর্মকর্তা হিসেবে একজন ডাক্তার এফডব্লিউভিকে কোন কিছুর জন্য অধিকার বা নিয়ন্ত্রন নিয়ে কিছু বলবেন, সে সুযোগ থাকেনা বললেই চলে। আর অব্যবস্থাপনা দেখে ডাক্তার যদি কোন কিছুর শেকায়েত করেও বসেন সবসময় তার মনোলোভা উত্তর পাবেন তার নিশ্চয়তা নাই। অথচ, একজন এফডব্লিউভি আমলাতান্ত্রিক হিসেবে সম্ভবত তৃতীয়/দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন কর্মচারী।  

কী পরিমাণ কষ্ট করে, সময় ব্যয় করে একজন ডাক্তার তাঁর কর্মস্থলে পৌঁছান স্বচক্ষে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে বলে আমার বিশ্বাস হয়না। এমন জায়গায় অনেকে পোস্টিং পান যেখানে শুধু হেলিকপ্টারে গিয়ে প্যারাসুট দিয়ে নেমে অফিস করে আবার হেলিকপ্টারে করে ফিরে আসা যাবে। সরকারি কোন ট্রান্সপোর্ট সুবিধা থাকেনা। হয় হেঁটে অফিসে যান, নতুবা সারাদিনের জন্য রিক্সা ভাড়া করে নিন। অনেক জায়গা আছে যেখানে যেতে হলে নৌকা ছাড়া যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ কিংবা শেরপুরের ঝিনাইগাতির পাহাড় আর জঙ্গলে যাদের পোস্টিং হয় তারা আমার কথাগুলো ভালো অনুধাবন করতে পারবেন।

শেরপুরের পাহাড়ের কোলে যেখানে গোধূলির সাথে নেমে আসে বুনো হাতির পাল কিংবা আরেকটু অন্ধকারে ‘ক্রান্তিকারি’দের দল, সেখানে পোস্টিং হয়েছিল আমার পরিচিত এক প্রেমিক সাংবাদিকের সদ্য মা হওয়া স্ত্রীর। ৫/৬ মাসের নবজাতককে নিয়ে সেই ডাক্তার মা না-জানি কীভাবে বিদ্যুৎবিহীন একেকটা রাত পার করেছিলেন! জীবনে প্রথমবারের মত বাবা হওয়া সেই সাংবাদিককে তখন দেখেছি ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে ঢাকায় কাজ করে যেতে। অন্য কোন ক্যাডারের কর্মকর্তা পারবেন ঐ জঙ্গলের মধ্যে এভাবে একা থেকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে? সার্কিট হাউজের এসি রুমে বসে বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ পড়ে হলিডে উদযাপনের পরিকল্পনা করা আর ঝি ঝি পোকা আর শিয়ালের পিলে চমকে দেয়া ডাকসমেত বসবাস করে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করা এক জিনিস নয়।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের দাফতরিক এবং অবস্থানগত অবস্থা প্রায় একইরকম। সাধারণত কর্মকর্তারা যেখানে অফিস করেন সেখানে, বা তার আশেপাশে সরকারি থাকার বন্দোবস্ত থাকে। অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য থাকেও। উপজেলা লেভেলে থানার ওসি কিংবা এসিল্যান্ডের ভালো থাকার জায়গা নেই একথা কেউ বলবেনা, বললে বিশ্বাসও করবেনা। জেলা লেভেলে তো নির্বাহী/জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, এএসপিরা বেশ ভালো জায়গায় থাকেন। আর সরকারি সব থাকার জায়গাতো প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দখলেই থাকে। তারা যাকে যতক্ষণ থাকতে দেন ততক্ষণই থাকা যায় সেগুলোতে। নতুন যারা বিসিএস ক্যাডার হিসেবে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যোগদান করেন তাঁদের কোন ধরনের সরকারি থাকার ব্যবস্থা থাকেনা। উপজেলা/জেলা লেভেলের হাসপাতালের কিছু কোয়ার্টার থাকে কিন্তু সেগুলো আগে থেকেই সিনিয়র সরকারি ডাক্তারদের দ্বারা ফিল-আপ থাকে। আর ইউনিয়ন লেভেলে সরকারের ব্যবস্থায় থাকার কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। একটা ছেলে তাও লজিং মাস্টারের মত গ্রামের মেম্বার বা চেয়ারম্যানের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করতে পারলেও মেয়েদের জন্য কি এটা সম্ভব?

আমাদের প্রশাসনিক অভিজাতরা কাদেরকে সেবা দেন? এএসপি বা এসপি দূরের কথা, সাধারণ মানুষ একজন ওসির কাছেই কি খুব সহজে পৌঁছাতে পারেন? বিচারকদের কাছেতো আমাদের মত উচ্চশিক্ষিত মানুষই কথা বলা বা যোগাযোগ করার আগে একশবার ভেবে কথা বলেন। অন্যভাবে কথাটা বলা যায়। সাধারণ মানুষের তো প্রতিদিন প্রতিনিয়ত পুলিশ কিংবা বিচারকের কাছে যাওয়ার দরকারও পড়েনা। অনেক মানুষ আছে বাংলাদেশে যারা জীবনে একবারের জন্য হলেও থানায় কিংবা আদালতে যাননি। দেশে নানামাত্রায় এবং প্রকৃতিতে অপরাধ প্রবণতা থাকেলও আমাদের সমাজব্যবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনো বেশ শক্তিশালী। সাম্প্রতিককালে দেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতা থামাতে পুলিশ, র‌্যাব বেশ পরিশ্রম করছেন, শহীদ হচ্ছেন এটা সত্যি। আবার এটাও সত্যি যে, মুষ্টিমেয় কিছু অপরাধী বাদ দিলে দেশের প্রায় সব মানুষই শান্তিপ্রিয় এবং প্রগতিশীল বলেই বাংলাদেশ টিকে আছে এবং এগিয়ে যাচ্ছে। যাই হোক স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কথায় ফিরে আসি।

বাঁশ বাগান, পাড়ভাঙ্গা পুকুর; আধা নেংটা, ময়লা কাপড় আর অপুষ্টির শিকার ময়লা-নাকের একদল ছেলে-মেয়ে আর তাঁদের জীর্ণদশার মা-বাবা নিয়ে অফিস কাটে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন সাব-সেন্টার কিংবা উপজেলা সদরে কাজ করা স্বাস্থ্য ক্যাডারের বিসিএস কর্মকর্তাদের।

ইউনিয়ন সাব-সেন্টার, কমিউনিটি ক্লিনিকে কাজ করতে গিয়ে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন পেরিফিরিতে কাজ করা এসব ডাক্তার। ক্লিনিকে আসতে দেরী হলে বা ওষুধ না থাকলে গ্রামের মেম্বার পর্যন্ত ঝাড়ি মারে, বাজারের একমাত্র ফার্মেসির মালিক ডাক্তার দেখলে নিজের ভবিষ্যৎ সঙ্কটাপন্ন ভেবে প্রমাদ গুনে পায়ে হেঁটে আসা-যাওয়া করা সরকারি ডাক্তারদের দিকে দু/একটা তির্যক মন্তব্যও ছুঁড়ে দিতে কার্পণ্য করেন না । গ্রামের রাস্তায় পায়ে হেঁটে একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা এএসপি অফিস করতে যাচ্ছেন, এ কথা কেউ ভাবতে পারবেন?

উপজিলা বা জেলা লেভেলের হাসপাতালে সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত আউটডোরে প্রতিদিন কী বিশালসংখ্যক গরীব মানুষের সমাগম ঘটে তা কি আমাদের জনপ্রশাসনের বড় কর্মকর্তা বা এমপি, মন্ত্রীরা ভাবতে পারেন? আর যেসব রোগী আসেন তারা প্রায় সবাই একেবারে দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর। কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে শুরু করে জেলা হাসপাতাল সবখানে একই চিত্র। যাদের পকেটে বৈধ/অবৈধভাবে উপার্জিত টাকার অভাব নেই তারাতো পারতপক্ষে সরকারি হাসপাতালের দিকে খুব একটা যান না। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডাক্তাররা সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে যাদেরকে সেবা দেন তাদের মধ্যে ভিক্ষুক থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালা, সুইপার, সরকারি-বেসরকারী অফিসের নিম্নপদস্থ কর্মচারী, গ্রামের গরীব কৃষক ও তাদের ছেলে-মেয়েরা, ফুটপাতের ফলের দোকানী, পান-সিগারেট বিক্রেতা, কাজের বুয়া, আহত গরীব মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি অভাবগ্রস্থ মানুষজনই বেশী আসে।

ডাক্তারের কাজটাই এমন যে ‘ব্যক্তিগত সহকারীর কাছে কাগজ রেখে যান’ টাইপের কথা বলে সেবা প্রত্যাশী মানুষকে এড়িয়ে চলার সুযোগ নেই। একজন ডাক্তার নিজ হাতে সরাসরি এসব গরীব মানুষকে সেবা দিয়ে যান। বিশেষ করে কমিউনিটি ক্লিনিকে এমন সব মানুষ আসেন যাদের সেবা করা অবস্থায় কোন ডাক্তারকে দেখলে মনে হয় মাদার তেরেসা আবার পৃথিবীতে কাজ করতে এসেছেন। হয়ত পাশের ক্ষেতে কাজ করছিলেন কোন কৃষক ভাই, ডাক্তার দেখে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। গ্রামের মধ্যেও যারা সবচেয়ে গরীব তারা আসেন কমিউনিটি ক্লিনিকে। এরা এমন সব মানুষ যারা নিজে থেকে কোনদিনও হাসপাতালে যাবেন না। এরা খুবই গরীব। এদের পকেটে নগদ অর্থ খুবই কম থাকে। জেলা/উপজেলা পর্যায়ে যাওয়া-আসার মত, দরকারি- অদরকারি নানা টেস্ট করানোর জন্য অনেক টাকা-পয়সা এদের কাছে থাকেনা। চিকিৎসা না পেতে পেতে অনেক ক্ষেত্রে এরা বিনা চিকিৎসায় জীবন কাটিয়ে দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। গ্রামীণ নারীদের অধিকাংশই স্বামীর ভয়ে কিংবা সংসারের খরচ বেড়ে যাবে ভয়ে শহরে ডাক্তারের কাছে যেতে চান না। ঘরের পাশে বড় ডাক্তার এবং ফ্রি ওষুধ পেয়ে গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের সিংহভাগ এই কমিউনিটি ক্লিনিক বা সাব-সেন্টারে আসেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশে অবকাঠামোগত এবং অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজে হাত দেয়ার পাশাপাশি দেশজুড়ে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের কাজ শুরু করেছিলেন। জাতির পিতা হিসেবে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে জাতির অর্থনৈতিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন টেকসই হবেনা। ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট দেশীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক অশুভ শক্তির ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধু শাহাদাত বরণ করলে অন্যান্য প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনার মত কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পও বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ অচলাবস্থার পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ আবার ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো আবার চালু করার কাজ হাতে নেয়া হয়। বিএনপি-জামাত জোট ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে এই কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহ আবার বন্ধ করে দেয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে জিতে আওয়ামীলীগ আবার ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো চালু করে। বর্তমানে এগারো হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। গরীব মানুষের দোরগোড়ায় মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে এসবের বিকল্প নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমনও পরিকল্পনা করেছিলেন যে, ঢাকার বড় বড় ডাক্তাররা ছুটির দিনে বাধ্যতামূলক ভাবে গ্রামে যাবেন এবং গরীব মানুষকে ফ্রি চিকিৎসা দিয়ে আসেবেন। ১৯৭২ সালের ৯ অক্টোবর তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) এ এক অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “যখন ছুটি দেওয়া হবে, যে বড় ডাক্তাররা আছেন, যারা স্পেশালিষ্ট, তারা গ্রামের দিকে কেন যাবেন না। গ্রামে তো শতকরা ৯৫ জন লোক বাস করে। তারাই তো সম্পদ দিয়ে আপনাদের সবকিছু দেখেছে।…তাদের দিকে কেন নজর দেবেন না?”

ডাক্তারদের কাজই হল মানুষের সেবা দেয়া। তবে আজ এত বছর পরেও কেন এত অসংগতি? সরকারী ডাক্তারদেরকে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান না করলে তাঁরাও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবেন না। সরকারের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হয়েও যারা প্রায় ঘরে ঢুকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বিশেষজ্ঞ সেবা দেন তাদের প্রতি রাষ্ট্র বাড়তি যত্ন নিবেন এটাই কাম্য। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে মাস শেষে বেতন ছাড়া আর কিছু এই প্রান্তিক সরকারী ডাক্তাররা যথাযথভাবে পান না। বসবাস, নিরাপত্তা এবং যাতায়াতের সুবিধা বাদ দিলাম, চাকুরী জীবনে প্রোমোশনটা পর্যন্ত পান না ঠিকমত। শুধু কি সার্ভিস দেন তাঁরা? ভালো চিকিৎসক হওয়ার পথে এমবিবিএস তো এদের কাছে প্রাথমিক কোন ডিগ্রী। আসল পড়ালেখা শুরু হয় তো পরে। কী অমানবিক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে এফসিপিএস, এমএস/এমডি’র মত ডিগ্রী অর্জনের জন্য সংশ্লিষ্ট কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয় তা শুধু ডাক্তাররাই জানেন।  আর কিছুটা টের পান তাদের পরিবার পরিজনরা।

সোনার বাংলা গড়তে হলে সরকারী ডাক্তারদেরকে যথাযথ সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। রাষ্ট্র এবং সমাজ পরিচালিত হতে হবে মেধা এবং সেবার হিসেবে। সমাজকে যে যত সেবা দিবেন, যে ধরণের সেবা দিবেন, তার উপর ভিত্তি করে সেবা প্রদানকারী রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন- এটাই হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলমন্ত্র। একদল আমলা সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করবেন, আর বাকি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সাধারণ মানুষ যথাযথ সুযোগ সুবিধা পাবেন না, সন্মান পাবেন না- এটা হতে পারেনা। বঙ্গবন্ধু  এ জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন করেননি। তিনি সিস্টেম বদলাতে চেয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৯ জুন তারিখে বঙ্গভবনে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) এর কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে দলীয় চেয়ারম্যান রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ প্রদান করেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, “যে সিস্টেম আজকে আমরা দেখি, সেই সিস্টেম ব্রিটিশ কলোনিয়াল সিস্টেম, এতে দেশের মঙ্গল হতে পারেনা।…সেই এডমিনিস্ট্রেশন, সেই সিস্টেম, সেই আইন, সেই সব কিছু পরিবর্তন করার নামই বিপ্লব”।  চলুন সবাই একটু চিন্তা করি, বঙ্গবন্ধু যে সিস্টেমের সমালোচনা করে তাকে বদলাতে চেয়েছিলেন, সেই সিস্টেম কতখানি বদলেছে? আরাম আয়েশ আর দাফতরিক আনুগত্যের সিস্টেম বদলেছে নাকি দিন দিন আরও শক্তিশালী হচ্ছে?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)