একাত্তরে নারীদের ভূমিকার কথা উঠলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে পাকবাহিনীর লালসার শিকার আমাদের বধু জায়া ভগ্নীদের ছবি অথবা শরণার্থী শিবিরে ক্ষধার্ত,কণকালসার সন্তানকে বুকে আগলে রাখা কোনো জননী, সুহাসিনীর অবয়ব।কিন্তু এর বাইরেও তাদের আরেকটি রূপ লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে গেছে অনেকটাই। জোয়ান অফ আর্ক, অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা, ঝাসির রাণী লক্ষীবাইয়ের মতো আমাদের অনেক মেয়েরাই ছিলেন দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধা।
ভাইদের পাশাপাশি বোনেরাও রাইফের উচিয়ে “জয় বাংলা”নিনাদে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন হানাদার নিধনে।পাকবাহিনীর চোখে দেখা দিয়েছিলেন মূর্তিমান দুঃস্বপ্ন হয়ে।আমাদের সেদিনের জোয়ান অফ আর্কদের সম্মানে কিঞ্চিত স্মৃতিচারণের প্রচেস্টা এই লেখাটি।
মুক্তিযুদ্ধে নারী গেরিলাদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে বেগম ফোরকানের কথা যার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল প্রথম গেরিলা স্কোয়াড। তার নেতৃত্বে প্রথম দলে ছিলেন আটজন। তারা ফেব্রুয়ারী মাস থেকেই অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। নারীদের গেরিলা ট্রেনিংয়ের জন্য বিভিন্ন শরনার্থী শিবির থেকে শতাধিক মহিলাকে নির্বাচন করা হয়।
প্রথম এদের বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র সর্ম্পকে ধারণা দেওয়া হয় এবং তাদের মধ্যে থেকে সুইসাইড স্কোয়াডের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পূর্বঞ্চালীয় হাই কমান্ড জনাব শেখ ফজলুল হক মনির নির্দেশে তাঁর সেকেন্ড ইন কমান্ড জনাব আ.স.ম.আব্দুর রব কিশোর তরুনী নেত্রীদের গেরিলা ও সুইসাইড স্কোয়াডের আধুনিক অস্ত্রের উচ্চতর প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা করেছিলেনলেম্বুচোরা ক্যাম্প, আগারতলায়। সূত্র: স্বাধীনতা সংগ্রাম ওমুক্তিযুদ্ধে নারী, ফোরকান বেগম।
মুক্তিযুদ্ধে শব্দ সৈনিকদের অনুপ্রেরণা আজও যেন জেগে উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে। জাতীয় জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্যালারিতে মোট ৮৮ জন শব্দ সৈনিকদের মধ্যে ১১ জন নারী শব্দ সৈনিক রয়েছে। তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো কল্যাণী ঘোষ, মালা খান, শাহিন সামাদ, বুলবুল মহালানবীশ, রূপা ফরহাদ, নাছরীন আহমেদ, নমিতা ঘোষ, মঞ্জুলা দাশ গুপ্ত, শিলা ভদ্র, উমা খান। মুক্তিযোদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রায় ৬০ টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচিত্র নির্মিত হয়। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে তার কেন্দ্রীয় চরিত্র রয়েছে নারী।
যেমন: সেলিনা হোসেনের “হাঙ্গর নদী গ্রেনেড”, খান আতাউর রহমান এর ‘জীবন থেকে নেয়া’ হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুণের পরশমণি’, নাসির উদ্দিন ইউসুফ এর ‘গেরিলা’। যদিও ১৯৭১- ৯০ পর্যন্ত এদেশের পত্র পত্রিকা সিনেমা নাটকে মেয়েদের হয়ে ধর্ষিতা, নির্যাতিতা অথবা ছেলে, স্বামী বা প্রেমিকের জনন্য প্রতীক্ষারতা নারী চরিত্র হিসেবেই শুধু আঁকা হয়েছিল। তবে নব্বই এর পরে এর ভিন্নরূপ চোখে পড়ে। সূত্র : বাংলার নারী সংগ্রামের ইতিহাস অদিতি ফাল্গুনী।
নারীদের মধ্যে যারা সংগঠক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে বেগম মতিয়া চৌধুরী, জাতীয় পরিষদের সদস্য বেগম নূরজাহান মুরশিদ, তৎকালীন জাতীয় সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম অন্যতম। পরবর্তীতে মমতাজ বেগম “মহিলা আওয়ামীলীগ সেচ্ছাসেবক বাহিনী” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। মহিলা সংগ্রাম পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বেগম, আমেনা পন্নী, জাহানার আঙ্গুর, সেলিনা হোসেন, আয়শা খানম, মুনিরা আক্তার, রোকেয়া বেগম প্রমুখ উল্লেখযোগ্যভূমিকা পালন করেছেন।
এছাড়াও মহিলা সংগ্রাম পরিষদের নেত্রী কবি বেগম সুফিয়া কামাল, ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম, জাহানারা ইমাম নেতৃস্থানীয় সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সূত্রঃ আবুল মাল আব্দুল মুহিত এর “স্মৃতি অম্লান ১৯৭১”।
যদ্ধ শুরু হওয়ার পরে সংগ্রামী যোদ্ধা মেয়েদের জন্য বাংলাদেশের তৎকালীন সংসদ সদস্যা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিচালনায় ‘গোবরা ক্যাম্প’ চালু হয়েছিল। সেই ক্যাম্পে মেয়েরা অস্ত্র চালনা শিখতো। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রায় ৩০০ তরুনী ও কিশোরী সংগঠক গোবরা ক্যাম্পে অবস্থান করতেন। এছাড়াও সিভিল ডিফেন্স ও নার্সিং এর প্রশিক্ষণ দেওয়া হত সেখানে। সূত্রঃ মুক্তিযোদ্ধে নারী মালেকা বেগম।
তারামন বিবি বীরপ্রতীক মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজীবপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে রাধুনী হিসেবে যোগ দেন। তখন তিনি ১৪/১৫ বছরের কিশোরী। শরীরে শক্তিমত্তা ছিল অন্যরকম। কোনো ভারী কাজেও তাকে পিছপা হতে দেখা যায়নি। পুরুষ সহযোদ্ধাদের পাশাপাশি সর্বদা অগ্রকদম ফেলে এগিয়েছেন। রাজীবপুর ওয়ার ফিল্ডে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করে গেছেন।
একের পর এক এসাইনমেন্ট সে পাকিস্থানী সেনাদের অবস্থানস্থল কোদালকাঠী ইউনিয়নে ঢুকে যেতেন। রাতের বেলা পাক সেনা শিবিরের কাছাকাছি ঢুঁ মেরে বের করে আনতেন সব হাঁড়ির খবর। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই মুক্তিবাহিনী প্রথম পাকসেনা শিবিরে হামলা চালায়। এছাড়া ওই রনাঙ্গানে যুদ্ধ শুরুর আগে তারামন বিবি অসংখ্য বাঙ্গালী পরিবারকে পাকবাহিনীর কবল থেকে নিরাপদ স্থানে আনার এসাইনমেন্টও অংশ নেয়।
একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা আলমতাজ বেগম ছবি মুক্তিযুদ্ধ শিবিরে যোদ্ধাদের রান্নাবান্নার পাশাপাশি অস্ত্র চালনা ও গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। ৭/৮ একসময় পাক সেনারা ঘিরে ফেলেছিল ঐ মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পটি। ৭/৮ দিন অবরুদ্ধ অবস্থায় যুদ্ধ করেছিলেন তিনি।বরিশালের মুলাদী থানার কুতুব বহিনীতে করুণা বেগম অন্য মহিলাযোদ্ধাদের সাথে অস্ত্র শিক্ষা নিয়েছিলেন। এই বাহিনীর অধীনে ৫০ জন মহিলা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি এই বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন।ছদ্মবেশে থেকে শত্রু ছাউনির ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে অপারেশন চালিয়েছেন।
এছাড়াও স্টেনগান রাইফেল চালানো এবং যে কোনো ধরণের বিস্ফোরক দ্রব্য সর্ম্পকে বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন। পুরুষের পোশাক পরে যুদ্ধ করেছিলেন আলেয়া বেগম।তিনি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থানা কমান্ডের ইউনিট কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। “রাইফেল বন্ধুক এস.এম,জি এস,এল অর সবকিছু চালানোতেই আলেয়া সমান পারদর্শী ছিলেন। শত্রুপক্ষের শক্তি ও অবস্থান বুঝে তাদের মোকাবেলা করার জন্য এসব সমরাস্ত্র হাতে নিয়ে তিনি ছুটতেন। নিমিষে ঝাঁঝরা করে দিতেন পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের বুক। গুড়িয়ে দিতেন শত্রুর ঘাঁটি।একাধিক সম্মুখ সমরে তার ছিল উজ্জ্বল উপস্থিতি। তিনি ভারতেরচাপড়া ট্রেনিং ক্যাম্পে যুদ্ধ কৌশল ও সমরাস্ত্র চালানো শেখেন।পিরোজপুর জেলার “অপারেশন স্বরুপকাঠীর বাহিনীর অকুতোভয় দুই নারী মুক্তিযোদ্ধা বীথিকা বিশ্বাস এবং শিশির কনা গ্রেনেড চার্জ করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন গানবোর্ড। নৌকা থেকে পানিতে নেমে সাঁতরে কচুরিপানার সাথে মিশে ভাসতে ভাসতে ভিড়েছিলেন লঞ্চের গায়ে। ছুড়ে মেরেছিলেন গ্রেনেড। পিরোজপুরে এক অখ্যাত গ্রামের মেয়েগুলো হয়ে উঠেছিলে এক একজন দুর্ধর্ষ গেরিলা।বীথিকা গেরিলা ও গুপ্তচরবৃত্তির ট্রেনিং দেয়ার জন্য মেয়েদের সংগ্রহ করে আনতো। শেষ পর্যন্ত প্রায় ১০০ মেয়েকে ট্রেনিং দেয়া হয়েছিল। সূত্র: দৈনিক জনকন্ঠ, ১৩ ডিসেম্বর ১৯৯৮ ও সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ ও নারী, মালেকা বেগম।
ডঃ ফৌজিয়া মোসলেম আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের চিকিৎসকের এবং চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালনা করেন। এছাড়াও জনমত তৈরি ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করেন। সূত্রঃ নারী প্রগতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রোকেয়া হল
১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার নিন্দা করে মুসলিম ছাত্রীসংঘের সভানেত্রী শওকত আরা ও সাধারণ সম্পাদিকা শাহানা এক মুক্ত বিবৃতিতে অবিলম্বে অধিবেশন আহ্বানের দাবি জানান। ৫ মার্চ নিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতির পূর্বাঞ্চল শাখা সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করার তীব্র নিন্দা করে। ৬ মার্চ কবি সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব বাংলার নারীসমাজ এই সভা থেকে চলমান গণ আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছিল। সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে নারী, মালেকা বেগম।
‘বাঙালির জাতিয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে, ডঃ ফজলুর রহমান লিখেছেন, ‘‘৯ মার্চ চট্টগ্রামে জেএম সেন হলে মহিলা আওয়ামী লীগের সভা হয়। এতে বক্তৃতা দিয়েছিলেন মেহেরুন্নেসা বেগম সরাফত উল্লাহ, বেগম নাজনীন, বেগম কামরুন্নাহার বেগম মুছা খান, কুন্দপ্রভা সেন প্রমুখ।”
১১ই মার্চ চট্টগ্রামে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে নগরে বিরাট মিছিল হয়। বিকেলে জে এম সেন হলে মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এক বিরাট সভা হয়। ১২ মার্চ, চট্টগ্রাম মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শহরে লাঠিমিছিল হয়। ১৬ মার্চ ১৯৭১ পূর্বে পাকিস্তান মহিলা পরিষদের উদ্যোগে বিকেল চারটায় ১২ নম্বর তোপখানায় মহিলাদের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত। সূত্র : দৈনিক পাকিস্তান, ২য় খন্ড, পৃ: ৮৩০।
১৭ মার্চ – ১৯৭১ ঢাকায় বিভিন্ন দল ও সংগঠনের অসহযোগ আন্দোলনকালীন কর্মসূচি পালন করা হয়। এদিন বিকেলে পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের উদ্যোগে নিয়মিত কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত ও প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়। সূত্র : ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ।
শ্রমিক দলের সাবেক মন্ত্রী মিসেস জুডিথ হার্ট। ভারতে অনুষ্ঠিত অন্য এক সমাবেশে মুম্বাইয়ের বান্দ্রা সেন্ট জোসেফ কনডেন্টের ছাত্রী ইয়ং ক্রিশ্চিয়ান স্টুডেন্ট গ্রুপের সভানেত্রী কুমারী নোয়েলার ঘোষণা ৪ নভেম্বর (১৯৭১) অনুষ্ঠেয় এক পদযাত্রায় প্রায় ২ হাজার ছাত্রী বাংলাদেশের সমর্থনে অংশ নেবে। সূত্র : বাংলার বাণী, ৭ম সংখ্যা।
১২ জুলাই ১৯৭১ বিশ্বের নারী সমাজের প্রতি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের অন্তিম আবেদন ‘বাংলার নারীদের বাঁচান’। সূত্র : সংবাদপত্র : স্বাধীন বাংলা, ১ম বর্ষ ৭ম সংখ্যা।
২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ নয়া দিল্লিতে আয়োজিত বাংলাদেশ সম্মেলনে যেসব বিশ্বনেতার অবদান ছিল, তাঁদের মধ্যে ছিলেন অসলোর মিসেস মিগরিড, সুচেতা কৃপালনী, বিজয়-লক্ষ্মী পন্ডিত প্রমুখ। সূত্র : সংবাদপত্র জয়বাংলা ১ম বর্ষ- ২০ সংখ্যা।
এছাড়াও মহিলা পরিষদের সদস্যরা পরাধীন দেশে মুক্তিকামী বাঙ্গালী নারীর উপর পাকসেনাদের অত্যাচারের বিভিন্ন আলোকচিত্র ও বিবরণ সহ ” To the conscience of people ” নামক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে সারা দেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। পল্টন ময়দানে পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে ১০ প্লাটুন বিশিষ্ট জয় বাংলা বাহিনীর এক প্লাটুনে ছিলেন ছাত্রী। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল ডামি রাইফেল। সূত্রঃ দৈনিক পাকিস্তান, ঢাকা, ২৪ মার্চ ১৯৭১।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম নারী গেরিলা স্কোয়াডের নেতৃী ফোরকান বেগম তার “স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নারী” গ্রন্থে বলেন- ২৩ মার্চ আমরা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বাহিনীর পাকিস্থানের বুকে পাকিস্থান ডে-এর বিপরীতে স্বাধীন বাংলাদেশ ডে পালন করি। মেয়েদের মধ্যে শামনুন্নাহার ইকু পতাকা হাতে প্যারেডের সামনে চলে, তারপর আমি সাকী আপা,কাওসার ঝুনুসহ অন্য মেয়েরা। আমরাই প্যারেডের নেতৃত্ব দেই। আমাদের অনুসরণ করে ছেলেদের দল। তিনি তার গ্রন্থে আরো উল্লেখ করেন ৭ই মার্চের ভাষণ, ২৩শে মার্চে আমাদের কুচকাওয়াজ ও বঙ্গবন্ধুর পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার বাস্তব রুপ লাভ করে।
তাই ২৩ মার্চের ঘটনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। যার অগ্রভাগে ছিলেন মেয়েরা।১ এপ্রিল ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তির সমর্থনে ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন হলে ভারতীয় ফেডারেশনের উদ্দ্যেগে মহিলাদের এক সভা হয়। সূত্র: দৈনিক যুগান্তর। ১২ খন্ড পৃঃ৩১। সূত্র : জাতীয় জাদুঘরের মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারী, Courtesy: অদিতি ফাল্গুনী গায়েন।
খেতাবপ্রাপ্ত মোট ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ২ জন নারী বীর প্রতীক রয়েছেন। তাঁরা হলেন মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি ও ক্যাপ্টেন সিতারা। কিন্তু নারী ও পুরুষ মুক্তিযোদ্ধা অনুপাত ১:৩৩৮ হলেও অংশগ্রহণের অনুপাতটি এতটা ব্যবধান সূচক নয়। অনুমান করা যায় অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি স্বীকৃত নারীযোদ্ধার সংখ্যাগত এ দৈন্য পরবর্তী সময়ের ইতিহাস প্রণেতাগণকে নারীযোদ্ধাদের অনুসন্ধান ও মূল্যায়নে প্রবৃত্ত না হতে প্রভাবিত করে থাকবে।
২০১৪ ইং সালের মার্চের ১ তারিখ প্রথম আলো কার্যালয়ে ছয় নারী মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধণা দেয়া হয়। তাঁরা হলেন পুষ্পরানী শুল্কবৈদ্য, মালতী রাণী শুল্ক বৈদ্য, হীরামনি সাওতাল, ফারিজা খাতুন, সাবিত্রী নায়েক ও রাজিয়া খাতুন।
ভাবনার বিষয় হচ্ছে বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে এতো মেয়েরা ট্রেনিং নিয়েছে যুদ্ধ করেছে কোথাও থেকে ৫০/১০০ অথবা ৩০০ বা তারও বেশি এভাবে হাজার হাজার নারীরা ট্রেনিং নিয়েছেন যুদ্ধ করেছেন। অথচ তালিকাভুক্ত নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ২০৯ জন।
আমাদের চরম দূর্দিনে আমাদের এই মায়েরা অসুর নিধনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন দূর্গতিনাশিনী দূর্গার রূপ নিয়ে। ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন ইতিহাসের বীরাঙ্গনা সখিনাদের।প্রত্যেকেই হয়ে উঠেছিলেন এক একজন জোয়ান অফ আর্ক।এদের অপরিসীম আত্মত্যাগ আর বীরত্বের কাহিনী স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায় পাতায়।
তথ্যসূত্রঃ
১। মুক্তিযুদ্ধে নারীঃ মালেকা বেগম
২। স্বাধীনতা যুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রোকেয়া হল।
৩। সূত্র : বাংলার নারী সংগ্রামের ইতিহাসঃ অদিতি ফাল্গুনী।
৪। আবুল মাল আব্দুল মুহিত এর “স্মৃতি অম্লান ১৯৭১”
৫। সূত্র: স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নারী, ফোরকান বেগম।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)