২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারিদের জন্য কোনো সুখবর নেই, শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে একটি দৈনিকে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারিদের জন্য বাড়তি কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে কঠোর আন্দোলনে যাচ্ছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারিরা। প্রতিবেদনে কয়েকজন শিক্ষাবিদ, বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষক নেতাসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য রয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। জাতীয় স্কেলের অন্তর্ভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা নতুন পে-স্কেলের অন্তর্ভুক্ত না করার কারণ কী? এতোদিন যারা প্রতিটি পে-স্কেলের আওতায় ছিলেন, এখন কী এমন মহা-বিপর্যয় ঘটেছে যে, তাদেরকে পে-স্কেলের আওতায় আনা যাবে না?
বাজেট বক্তৃতায় মাননীয় অর্থমন্ত্রী শিক্ষা সংক্রান্ত অনেক কথা বলেছেন। বক্তব্যের একপর্যায়ে মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ে তিনি তার হতাশার কথাও সংসদে উত্থাপন করেছেন। মাননীয় মন্ত্রী নিশ্চয়ই অবগত আছেন, আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা মূলত: বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্ভর।
দেশে প্রায় ২৬ হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা সরকারের এমপিও কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তিন লাখের বেশি কর্মচারির মাসিক বেতন-ভাতার শতভাগ এমপিওর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দেওয়া হয়। জাতীয় বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারি চাকরি জীবনে এক ধরণের নিরাপত্তাবোধ করে থাকেন, যা তাদের সামাজিক মর্যাদা, পারিবারিক নিশ্চয়তাও প্রদান করে।
যদিও এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারিদের সঙ্গে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারিদের সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত বিস্তর পার্থক্য রয়েছে তারপরও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারিদের জন্য এমপিও এক বড় পাওয়া।
সরকার নিয়ম অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর পে-স্কেল প্রদান করে। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারিদের কখনোই এসব পে-স্কেলের বাইরে রাখা হয়নি, কিন্তু এ বছর এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান পরিস্কার নয়। প্রস্তাবিত বাজেটে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পে-স্কেলভুক্ত করার জন্যও কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি!
বিষয়টি অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য বিধায় বেসরকারি শিক্ষকদের মাঝে এক ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। শিক্ষক-কর্মচারিরা দাবি আদায়ে আন্দোলনে যাওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারিদের আন্দোলনমুখি করার মতো পরিস্থিতি কেনো তৈরি করা হচ্ছে তা শিক্ষদের বোধগম্য নয়।
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে সরকারের লাভ কী? এমনিতেই বিরোধীদলীয় জোটের লাগাতার হরতাল-অবরোধে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম যথেষ্ট ক্ষতির শিকার হয়েছে। এখন যদি আবার অনাকাঙ্খিত আন্দোলন শুরু হয় তা হলে শিক্ষা কার্যক্রমের আরো ক্ষতি হবে। কিন্তু আন্দোলন ছাড়া শিক্ষক-কর্মচারিরাও তো কোনো উপায় দেখছেন না।
অতি উৎসাহী কিছু কর্মকর্তার বুদ্ধিতে লাখ লাখ শিক্ষক-কর্মচারিকে আন্দোলনমুখি হতে বাধ্য করে, একটি কল্যাণকামী সরকার প্রকৃত অর্থে কী অর্জন করতে চায়, তা অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়।
অর্থমন্ত্রী সংসদে এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় অংকের বাজেট প্রস্তাব করেছেন। আবার অর্থ সংকটের কথা বলে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারিদের পে-স্কেলের বাইরে রাখার কথাও বলা হচ্ছে। কিন্তু দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা যখন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্ভর তখন তাদেরকে অবহেলার চোখে দেখে রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা কতোটা শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করানো যাবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
সরকারের পরামর্শদাতাদের মধ্যে যারা বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারিদের পে-স্কেলের বাইরে রাখার বুদ্ধি দিয়েছেন, আশাকরি তাদের শুভ বুদ্ধি উদয় হবে।
সরকারের মনে রাখা উচিত, পে-স্কেলে অন্তর্ভুক্তির সাথে সাড়ে তিন লাখ শিক্ষক-কর্মচারির সামাজিক ও পারিবারিক মর্যাদাও জড়িত। সুতরাং তাদেরকে সামাজিক ও পারবারিকভাবে হেয় করে দেশে মানসম্পন্ন শিক্ষাতো দূরে থাক, ন্যুনতম শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখা কঠিন হবে।
তাছাড়া মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে হলেও, ক্রমবর্ধমান নিত্য নৈমিত্তিক চাহিদা মেটাতে শিক্ষক-কর্মচারিদের পে-স্কেলের আওতািই আনা উচিত।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে শিক্ষাসচিব ও শিক্ষামন্ত্রীকে বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট আন্তরিক মনে হলেও, অর্থমন্ত্রীকে ছাড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া হয়তো বিষয়টি সুরাহা হবে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)