কিছুদিন আগে সিডনি থেকে আমার নাতনি জানিয়েছিল যে তাদের বাড়ির কাছে একটি বইয়ের দোকান উঠে যাবার কারণে গুদাম খালি করার জন্য সস্তায় বই বিক্রি করে দিচ্ছে। এই ঘটনা এখন নৈমিত্তিক হয়ে গেছে। ২০১৪ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুটো বইয়ের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। সম্ভবত এর বড় কারণ ই-বুক।
এদেশে বইয়ের এখন নানা সংস্করণ প্রকাশিত হয়, যেমন- শক্তমলাট সংস্করণ, বুক ক্লাব সংস্করণ, পেপারব্যাক সংস্করণ, অডিও সংস্করণ, বৃদ্ধদের জন্য বড় হরফ সংস্করণ ইত্যাদি। সম্প্রতি এসেছে ইলেক্ট্রনিক বুক বা ই-বুক সংস্করণ। ই-বুক এত সহজলভ্য ও সুলভ যে ইচ্ছা না থাকলেও পাতা উলটিয়ে দেখার জন্য অনেকে কিনে ফেলে। ফলে কাগজের বই যেখানে ১০টা বিক্রি হয় ই-বুক বিক্রি হয় ১০০টা।
বাংলা ই-বুকের সম্ভাবনা ছিল বিশাল, বিষয়টি নিয়ে হয়তো অনেকে চিন্তাভাবনা করছে। তবে যারা বাংলা বইয়ের প্রকাশক তারা তেমন গুরুত্বের সাথে চিন্তা করছেন বলে মনে হয় না। কারণ তারা সত্যিকারের প্রকাশক না। তবে একবার কেউ আরম্ভ করলে সকলে তখন তাকে নকল করে দৌড়াতে আরম্ভ করবে। বাংলা ই-বুকের বাজার সারা দুনিয়ায়, কারণ বিদেশে কয়েক কোটি বাংলাভাষী শিক্ষত মানুষ রয়েছে। তারা বই পড়ে, ইংরেজি বই পড়ে। তাদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। বাংলা বই সহজলভ্য হলে তারা বাংলা বই পড়ত। অথচ বাংলা বই সহজলভ্যতো নয়, দামও তুলনামূলক বেশি। দেশে যে বইয়ের দাম ৩০০/- টাকা সে বই কানাডায় ২০ ডলার মানে ১৪০০ টাকা। এই বইটি যদি আমাজনে ই-বুক হিসেবে পাওয়া যেত তাহলে বিশ্বের যেকোন দেশে থেকে অনেক কম দামে মাত্র ২ ডলারে কিনতে পারতাম। যদিও ২ডলার মানে প্রায় ১৩০ টাকা। তবু বিদেশে ২টাকার সমান, অনেক সস্তা; প্রায় বিনামূল্যে। এদেশে কাগুজে বইয়ের বাজার ছোট হয়ে আসছে, বড় হচ্ছে ই-বুকের বাজার।
বাংলাদেশে বাংলা বইয়ের বাজার থাকলেও পরিবেশক না থাকার করণে দেশের সর্বত্র পাওয়া যায় না। অল্প কপি, বেশি টাইটেল ও লেখকের পুঁজি দিয়ে বাংলাদেশের প্রকাশকগণ ভালোই আছেন। তাই তারা বেশি কপি বিক্রির ঝুঁকি নিতে চান না। এই কারণে আমাদের ৯৯% লেখক ভালো নেই। অন্যদিকে তাঁরা লজ্জায় এসব কথা বলতেও পারেন না।
কাগজের বইয়ের বাজার যত বড় তার চেয়ে সম্ভাব্য ই-বুকের বাজার হাজার গুণ বড়। এর সুবিধা এই যে এটা অনলাইনে পাঠানো যায়, অনলাইনে কেনা যায়। অনলাইনে অর্ডার ও টাকা নিয়ে আমাজন ডট কম সারা দুনিয়ায় বই সরবরাহের ব্যবসা আরম্ভ করেছিল। এখন উত্তর গোলার্ধের সকল ভাষার কাগজের বই ও ই-বুক তারা অনলাইনে বিক্রি করছে। কিন্তু দূঃখের বিষয় বাংলা তারা পারে না। তাদের কিন্ডেল বাংলা ফন্ট নিতে পারে না। বিশ্বের নানা দেশের নানা ভাষার ভাষার ই-বুক আছে, কিন্তু আমাজন বাংলা ই-বুক তৈরি করে না। বিনামূল্যে বাংলা পিডিএফ বই পাওয়া যায়, পড়া যায়। সেগুলো জনপ্রিয় বই বা ধর্মীয় বই। বিজ্ঞাপনের জন্য সেগুলো ছাড়া হয়। লেখকের তাতে কোন লাভ হয় না। আমাজন বাংলা গ্রহণ না করার কারণ সম্ভবত তাদের সমস্যা অনেকগুলো- ইউনিকোড ভিত্তিক স্ট্যান্ডর্ড কীবোর্ড লেআউটের অভাব, লেখকের সাথে প্রকাশকের চুক্তি না থাকা, ভুলভাল আইএসবিএন নাম্বার ইত্যাদি।
তদুপরি ই-বুক প্রকাশের চাহিদা না থাকাও বড় কারণ। দুনিয়ার অধিকাংশ ভাষার বই আমাজনে পাওয়া যায়, অথচ বাংলা বই তারা নেয় না। এর চেয়ে অপমানের আর কী হতে পারে? আমাজনে পাওয়া গেলে আমাদের মত সাধারণ লেখকের বই বিক্রি হতো, কারণ সেটা দুনিয়ায় যেকোন জায়গা থেকে যে কেউ ইচ্ছা করলে কিনতে পারত। ই-বুক হওয়া মানে বই সহজলভ্য ও সুলভ হওয়া। তার মানে লেখকের লাভ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)