একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে আমরা জয় পেয়েছি, স্বাধীন হয়েছি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে যে একজন ইহুদির অবদান ছিল এটা আমরা হয়ত মনে রাখি নি। তিনি ছিলেন মেজর জেনারেল জে.এফ.আর জ্যাকব।
মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অবদান সর্বোচ্চ হলেও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কৃতিত্বও কম ছিলো না। ভারত ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। ভারতের যোগদানের মাত্র তেরো দিনের মাথায় বিজয় অর্জিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দানকারীদের মধ্যে ছিলেন জেনারেল মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, মেজর জেনারেল কে এম সাইফুল্লাহ, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, জেনারেল জগজিত সিং অরোরা, ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানেকশ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাগত সিং এবং এই মেজর জেনারেল জে.এফ.আর জ্যাকব।
জে.এফ.আর জ্যাকব ছিলেন একজন ভারতীয় ইহুদি। কলকাতায় তার জন্ম। তবে তিনি বাগদাদি (ইরাক) ইহুদি বংশোদ্ভূত। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য স্বীকৃতি পাওয়া ৭৬ বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে মেজর জেনারেল জ্যাকবও ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকার জন্য তাকে সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
মুসলিমদের সঙ্গে ইহুদিদের একটি ঐতিহাসিক ধর্মীয় বিরোধ থাকলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জ্যাকব প্রমাণ করেছিলেন ধর্ম নয়, মানুষের আসল পরিচয় তার চিন্তাধারা এবং কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়।
জ্যাকব মনে করেন, জেনারেল মানেকশ বা জেনারেল অরোরা নন, তাঁর পরিকল্পনাতেই ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেছিলেন। মানেকশ বরং ঢাকাকে বাদ দিয়ে ওই সময় অন্যান্য শহর দখলের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে সেই সত্য ভারতে সরকারিভাবে স্বীকৃতি পায়নি।
নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিলটি জ্যাকবেরই লেখা। পাকিস্তানিরা সেখানে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ চাইলেও তা হতে দেননি তিনি। ঢাকায় নিয়াজীর হেডকোয়ার্টারে জ্যাকব নিজে গিয়েছিলেন তার সাথে কথা বলতে। তার লেখা ‘সারেন্ডার এট ঢাকা’ বইটিতে এ ব্যাপারে বিস্তারিত তুলে ধরেন জ্যাকব।
আত্মসমর্পণের ব্যাপারে পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি রাজি না হলে মেজর জেনারেল জ্যাকব তাকে বলেন, ‘জেনারেল, আমি আপনাকে আশ্বাস দিচ্ছি, যদি আপনি সবার মাঝে আত্মসমর্পণ করেন এবং শর্তগুলো মেনে নেন, আমরা আপনাকে ও আপনার সেনাদের দেখবো। ভারত সরকার কথা দিচ্ছে আপনার ও আপনার বেসামরিক সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।’
‘কিন্তু আপনি যদি আত্মসমর্পণ না করেন, আমরা এর কোনো দায়িত্ব নেবো না। আমি আপনাকে ৩০ মিনিট সময় দেবো। আপনি যদি মেনে না নেন, যুদ্ধ আবার শুরু করার নির্দেশ দেয়া ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই।’
অনেক সাহস দেখিয়ে এসব কথা বলে চিন্তায় পরে যান জ্যাকব। তিনি ভাবতে থাকেন, ‘যদি তিনি (নিয়াজী) মানা করে দেন, আমি কী করবো? আমার হাতে তো কিছুই নেই। নিয়াজীর আছে ২৬ হাজার ৪শ’ সেনা। আর আমাদের আছে মাত্র ৩ হাজার।’
তবে জ্যাকবের ভয় সেদিন সত্যি হয়নি। নিয়াজী আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছিলেন। কঠিন কথা বলার সাহস জ্যাকব পেয়েছিলেন ওই সময়কার পরিস্থিতি থেকে। তখন আসলে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া পাকিস্তানের আর তেমন কোনো সুযোগ ছিলো না।
পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি হামিদুর রহমান যুদ্ধ অনুসন্ধান কমিশনের প্রধানকে ছত্রভঙ্গ হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন, কেনো জেনারেল নিয়াজী জনসম্মুখে এভাবে লজ্জাজনক নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলেন, যেখানে ঢাকাতেই তার সাড়ে ২৬ হাজার সেনা সদস্য ছিলো আর ভারতের ছিলো মাত্র কয়েক হাজার?
জেনারেল নিয়াজী উত্তরে বলেছেন, ‘আমি জ্যাকবের হাতে ব্লাকমেইলড হয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হই।’ যদিও নিয়াজীর এ দাবিকে অস্বীকার করেন জেনারেল জ্যাকব।
পাকিস্তান ছাড়াও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন সরকারি দলিল ও বইপত্রে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে বেশিরভাগ সময় ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। ভারতীয় অনেক যুদ্ধবিদও এভাবেই বিষয়টিকে দেখতে অভ্যস্ত।
কিন্তু জেনারেল জ্যাকব বলেন, ‘আমি মনে করি, একাত্তরের যুদ্ধকে দু’ভাগে দেখা যায়। পশ্চিম ফ্রন্টে ভারতের সঙ্গে যে যুদ্ধ হচ্ছিলো, ওই অংশকে ‘ভারত-পাক’ যুদ্ধ বলা যায়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধকে অবশ্যই যৌথ বাহিনীর অধীনে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ’ হিসেবে দেখতে হবে।’
যুদ্ধ পরবর্তী এক বিবৃতিতে জেনারেল জ্যাকব বলেন, একাত্তরের রণাঙ্গনে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র বাহিনীর চেয়ে বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা বড় ছিলো। সম্পূর্ণ কৃতিত্ব মুক্তিযোদ্ধা ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। তারা জয়ের জন্য আসল কাজটি করেছেন। তাদের বীরত্বের জন্যই জাতি স্বাধীনতা পেয়েছে।
বাংলাদেশের সেই অকৃত্রিম বন্ধু আজ দুপুরে দিল্লিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।