নারীদের নিয়ে আমাদের সমাজে কম কুসংস্কার প্রচলিত নয়, বরং অনেক বেশি। এর মধ্যে যেমন রয়েছে- বিয়ের আগে পালা করে মেয়ে দেখতে যাওয়া, মেয়ের যাবতীয় খুঁত ধরা, পাড়ার লোকদের কাছে মেয়ের সম্পর্কে কোনো বদনাম শুনে ছেলে পক্ষের বিয়ে ভেঙে দেওয়া ইত্যাদি। এর মধ্যে কোনো কারণে আগে যদি মেয়ের বিয়ে এবং ডিভোর্স হয়ে থাকে, তাহলে তো আর কথাই নেই। এমন মেয়েকে যেন অবিবাহিত ছেলের বউ করতে অভিভাবকসহ পুরো সমাজের জন্য একপ্রকার ‘হারাম’ ঘোষণা করা হয়েছে! যদি কখনো বিয়ে হয়ও তবুও শান্তিতে সংসার করতে পারে না সেই মেয়েরা, সমাজ তাদেরকে সবসময়ই বাঁকা চোখে দেখে থাকে!
এছাড়া আরও অনেক কুসংস্কারের শিকার হয়ে আমাদের অজান্তে লাখ লাখ নারী সমাজে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। এমনই একটি কুসংস্কারের শিকার হয়ে গোছানো সংসার, নববধু হওয়ার আশা-আকঙ্খা চুরমার হয়ে কীভাবে দুই বোনের জীবন বলতে গেলে শেষ হয়ে গিয়েছে, তা তুলে ধরা হয়েছে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ‘আলতা বানু’ ছবিতে। এ যেন মেয়েদের প্রতি আমাদের সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গির এক প্রামাণ্য দলিল।
আলতা এবং বানু। তারা দুই বোন। আলতা’র ছোট বোন বানুর জন্মের সময় মা মারা যাওয়ার পর থেকে তাদের বাবা দুই মেয়েকে অনেক কষ্ট করে বড় করেন। মেয়েদের বড় করতে গিয়ে গ্রামীণ বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে পর্যন্ত করেননি। বড় মেয়ে আলতার বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিদেশ ফেরত পাত্র সোহেল রানা রাজি থাকলেও তার বাবা বিয়ের আগের রাতে স্বপ্নে দেখেন তাকে সাপে কামড়াচ্ছে। এরপর মারা যায় রানার রমজান নানা। এর আগে রানার মা আলতার চুলের আগা লাল থাকায় তাকে ‘কুফা’ মনে করে। এখান থেকেই কুসংস্কারের শুরু। রানার বাবা-মা সহ পুরো সমাজ এবং কাঠমোল্লারা ভাবছে ‘কুফা আলতা’কে বিয়ে করলে তাদের ছেলে রানা সুখী হতে পারবে না। যেই ভাবা সেই কাজ। গায়ে হলুদের পরও তারা তারা রানাকে বলে আলতার বিয়ে ভেঙে দেয়। সেখানেও সেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিচ্ছবি। বাবার বরাতে রানা বলে, ‘বিয়ার আসরেও নাকি পুরুষ মানুষের বিয়া ভাইঙা দেওয়ার ক্ষমতা আছে!’
এরপর সাধারণ নারীদের বিপরীত চিত্র দেখা যায় ছোট বোন বানুর মধ্যে। সে প্রতিবাদী হয়ে রানার বাবা-মাকে হুমকি দিয়ে আসে। তবে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বিফল হয় রানার মামাতো ভাই। বারবার বিফল হয়ে একপর্যায়ে চড় খেয়ে সমাজে প্রচলিত ক্রাইম করে সে। গোপনে বানুর গোসলের ভিডিও করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে চায়। কিন্তু কৌশলী বানু তাকে একপর্যায়ে বেদম পিটুনি দিলে মারা যায়। আসলে তো এমনটাই হওয়া উচিৎ। সংবাদমাধ্যমে আমরা প্রায়ই নারীদের এমন ক্রাইমের শিকার হয়ে দিনের পর দিন নির্যাতিত হতে দেখি। এখানে তো নারীর কোনো দোষ নেই। কেউ গোপনে তার গোসলের ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিলে নারী কেন দোষী হবে? নারীর শরীর কি কোনো নিষিদ্ধ জিনিস? কেউ তার অমতে কিংবা গোপনে ভিডিও করে ছেড়ে দিলেই কেন সবকিছু শেষ হয়ে যাবে? এখানে ক্রিমিনালের মৃত্যুকে আমি সমর্থন করি, ভয় পেয়ে বানুর পালিয়ে যাওয়াকে নয়। কারণ, নিজেকে রক্ষা করার জন্য কোনো ক্রিমিনালকে হত্যা করা নিশ্চয়ই বেআইনি নয়। তবে এখানে বানু যেটা করেছে সেটা যেকোনো গ্রামীণ মেয়েই করতো। ক্রিমিনালকে খুন করা যে অন্যায় নয় সেটা না জানার কারণেই ভয়ে বানু পালিয়েছে। এখানেও নারী এবং এসব ক্রিমিনালদের জন্য শেখার রয়েছে।
সেই পালানোর পর বানু আর ফেরেনি। সে কোথায় আছে? এটা জানতে নিজেকে উৎসর্গ করে আলতা। থানা থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ পল্লী, তাবিজ, ‘বাটি চালান’, ফকির এমনকি গার্মেন্টস; এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আলতা যায় না। সমাজের প্রায় সবখানেই যে ভণ্ডরা স্থান দখল করে বসে আছে এই ছবি না দেখলে তা নতুন করে বুঝা যায়? ভাই হারানো এমনই এক মা এবং বোনকে ব্যক্তিগত জীবনে আমি দেখেছি, তারাও গ্রামীণ এই কুসংস্কারের ফলে একইভাবে ‘ফকির বাবা-মা’দের তাবিজ চিকিৎসার প্রতারণার শিকার হয়েছেন। অনেক টাকা খরচ করে বছরের পর বছর তারা ফকিরদের কাছে ভাই এবং সন্তানের খোঁজ চাইতেন। সেসব কথিত ‘জ্বীন গণক’দের প্রতি তখনও যেই অবিশ্বাস ‘আলতা বানু’র চরিত্রে তা আরেকবার প্রমাণ হলো। এভাবেই এগিয়ে যায় অরুণ চৌধুরীর ‘আলতা বানু’র কাহিনী।
আলতা বানুর ইউটিউব লিংক
সত্যি বলতে কি, সাবলীল অভিনয়ের কারণে আলতা চরিত্রের নায়িকা জাকিয়া বারী মম অন্যতম প্রিয় অভিনেত্রী। আনিসুর রহমান মিলনও অনেক আগে থেকে প্রিয় তার অভিনয়শৈলীর কারণে। ‘আলতা বানু’তেও তারা অভিনয়ে নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করেছেন। বানুর অভিনয়ও সাবলীল ছিল। ছবির গ্রামীণ লোকেশন অনেক ভালো লেগেছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, নারীর প্রতি সমাজের নানা অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরা ‘আলতা বানু’ অনেক দিন মনে রাখার মতো একটি চলচ্চিত্র। সমাজের আলতা এবং বানুরা সকল শৃঙ্খল থেকে ভেঙে প্রতিবাদী হয়ে বেরিয়ে আসুক, এই কামনা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)