প্রথম স্ত্রী রিতা প্যাটেলের সঙ্গে পাঁচ বছরের দাম্পত্য জীবনের ইতি টেনে হতাশায় মুষড়ে পড়া রাহুল দেব বর্মন আশ্রয় নিয়েছেন এক নির্জন হোটেলে। কয়েকদিনের স্বেচ্ছা বন্দীত্ব কাটিয়ে তিনি হোটেল ছাড়লেন নিজের সৃষ্টি দূর্দান্ত এক গান নিয়ে,‘মুসাফির হো ইয়ারো, না ঘার হ্যায় না ঠিকানা’। ১৯৭২ সালে সেই গান কিশোর কুমারের কণ্ঠে ব্যবহার করা হলো হিন্দি ছবি ‘পরিচয়’ এ’। বোদ্ধাদের প্রশংসা আর বাণিজ্যিক সাফল্য দুটোই এসেছে হাত ধরাধরি করে। এভাবেই দুঃখ হতাশা থেকেও দুর্দান্ত সৃষ্টি দিয়ে উপমহাদেশের গানের জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন রাহুল দেব বর্মন।
ভারতের সংগীতের ইতিহাসে অবিস্মরনীয় এক সুরসষ্টা, যার সৃজনশীলতা ফিল্মিক/নন ফিল্মিক সংগীতকে নিয়ে গেছে অসাধারণ উচ্চতায়। ১৯৬০ থেকে ১৯৯৪, তিন দশক সংগীত পরিচালক হিসাবে তার অনবদ্য সৃষ্টি মুগ্ধ করেছে গোটা উপমহাদেশকে।
বাংলাদেশের কুমিল্লা পূর্বপুুরষের ভিটা। ত্রিপুরার রাজপরিবারের সন্তান। বাবা শচীন দেব বর্মন ছিলেন ভারতীয় রাগ সংগীত ও বাংলা গানের দিকপাল, মা মীরা দেবী বর্মনের সুখ্যাতি গীতিকার হিসাবে। কলকাতা-মুম্বাই চলচ্চিত্রে ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের সঙ্গে বাংলার চিরায়ত লোকগান, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি সুর’কে ব্যবহার করে নতুন এক মাত্রা দিয়েছেন ‘শচীন-কর্তা’। একমাত্র সন্তান রাহুল উপমহাদেশীয় সংগীতের সঙ্গে পাশ্চাত্যের ওয়েস্টার্ন রক, স্প্যানিশ ও আরবীয় সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে নিজেদের সংগীত পরম্পরা’কে করেছেন সমৃদ্ধ। শুদ্ধ সংগীত চর্চার অবারিত সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন, পাশপাশি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মন বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ঝুঁকেছেন। কখোনো দু’হাত ভরা সাফল্য, আবার কখোনোবা ব্যর্থতা। মৃত্যুর আগে আরো একবার দুর্দান্ত সৃষ্টি দিয়ে সব অবহেলার জবাব দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন তিনি । মৃত্যুর দুই যুগ পরও আরডি’র সৃষ্টি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংগীত জগত।
তার চটুল গান যেমন এখোনো রেস্টুরেন্ট, বার, ডিস্কো’তে ব্যবহার হয়, তেমনি তার ফিল্মিক গানের রিমিক্সও হয়েছে। ইউরোপে জনপ্রিয় ভারতীয় সুরকার বালি সাগু আরডি’র জনপ্রিয় গানের রিমিক্স করে নিজের পরিচিতি বাড়িয়েছেন। রাহুল দেবে’র জনপ্রিয় গানগুলোর রিমিক্স করে ২০১২ সালে ব্যবহার করা হয় বলিউডের সুপার হিট ‘দিল-ভিল পেয়ার-ভিয়ার’ ছবিতে। ১৯৩৯ সালের ২৭ জুন কলকাতায় জন্ম, ১৯৯৪’র ৪ জানুয়ারি মুম্বাইয়ে মৃত্যু তাঁর। ৫৫ বছরের ঘটনাবহুল বর্ণাঢ্য জীবনের বাঁকে বাঁকে রয়েছে নানা উত্থান-পতন, সাফল্য-ব্যর্থতার কাহিনী।
নানি’র দেয়া ডাকনাম টুবলু হারিয়ে গেছে পঞ্চম নামের আড়ালে। তার ডাকনাম পঞ্চম হওয়ার ইতিহাসটাও মজার। শচীন কর্তার সদ্যোজাত পুত্র সন্তান’কে কোলে নিয়েছেন প্রখ্যাত বাঙ্গালি অভিনেতা অশোক কুমার। শিশুর কান্নার সুরে তিনি খুঁজে পেলেন উপমহাদেশীয় সপ্তক সুরের পঞ্চম সুর,পা..। সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু’র সংগীতে উজ্জল সম্ভাবনা খুঁজে পাওয়া অশোক কুমার শচীন-তনয়ের নাম রাখলেন পঞ্চম। উস্তাদ আলি আকবর খাঁ’র কাছে সারোদ আর সমতা প্রসাদের কাছে তাবলায় হাতে খড়ি পঞ্চমের। তবে তিনি আজীবন গুরু মেনেছেন আরেক বাঙ্গালি কিংবদন্তী সুরস্রষ্টা সলিল চৌধুরীকে।
নয় বছর বয়সের ‘বিস্ময়-বালক’ বাবা’র বিরুদ্ধে আনেন গুরুতর অভিযোগ! ১৯৫৬ সালে মুক্তি পাওয়া মুম্বাই’র হিন্দি চলচ্চিত্র ফান্টুস’র সুরারোপের জন্য সেরা সুরকারের পুরস্কার জেতেন শচীন দেব বর্মন। পুত্র রাহুলের অভিযোগ, ছবি’র জনপ্রিয় গান ‘আয় মেরে টোপি পালাট কে আ’ তারই সুর করা। পরের বছর গুরু দত্ত’র পরিচালনায় মুক্তি পাওয়া ছবি পিয়াসার ‘স্যর যো তেরা চাকরায়ে’ নিয়ে পিতা সুরকার শচীন দেবে’র বিরুদ্ধে একই অভিযোগ আনলেন পুত্র। পিতা অবশ্য গর্ব ও আনন্দের সঙ্গে ছেলের অভিযোগ কবুল করেছেন। ছেলের সৃষ্টি পিতার গ্রহণ করার ঘটনা এই দু’জনের জীবনে পরবর্তীতেও ঘটেছে, তবে সেটা অনিবার্য ছিলো ভিন্ন কারণে। ১৯৬৯ সালে হিন্দি ছবি আরাধনা’র সংগীত পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন শচীন দেব। গানের রেকর্ডিং’র সময় তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে শচীন-কর্তার সহকারি হিসাবে সুরকারের দায়িত্ব নেন পুত্র রাহুল ।
কথিত আছে মেরি স্বপ্নকি রানি কব আয়োগি তু (মোর স্বপ্নের রাণি তুমি কাছে এসো) এবং ‘রূপ তেরা মাস্তানা’ রাহুলের সুর করা গান, যা গেয়ে প্রশংসা ও ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান কিশোর কুমার। গানের জোরেই আরাধনা কাঁপিয়ে দেয় বক্স অফিস। পাশাপাশি ফিল্মফেয়ারসহ একাধিক পুরস্কার জেতেন ছবি’র কলাকুশলীরা। এই ছবির সাফল্য নায়ক রাজেশ খান্না’কে এনে দেয় বলিউড চলচ্চিত্রের প্রথম সুপার স্টারের স্বীকৃতি। টানা ১৭টি সুপার হিট ছবি উপহার দেয়ার নতুন রেকর্ড গড়েন রাজেশজি। সবাই কিছু না কিছু পেলেও সাফল্যের অন্যতম কুশীলব আরডি বর্মন এই ছবি থেকে পিতার আর্শীবাদ ছাড়া পাননি কিছুই। পুরস্কার বা স্বীকৃতি প্রাপ্তিতে বরাবরই বঞ্চিতদের দলে ‘ছোটে-বর্মন’।
কালজয়ী এই সুরকার তার ৩৩ বছরের ক্যারিয়ারে ৩৩১টি ছবিতে সুর দিয়ে মাত্র তিনবার জিতেছেন ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। ১৯৮৬ সালে তার সঙ্গীত পরিচালনায় মুক্তি পায় প্যারালাল সিনেমা ‘ইজাজাত”। ক্ল্যাসিকাল সুরের উপর ভিত্তি করে তৈরী করা এই ছবি’র গান সমালোচকদের প্রশংসা কুড়ায়। সেরা গীতিকার হিসাবে গুলজার ও প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসাবে আশা ভোঁসলে পান জাতীয় পুরস্কার। ভাগ্য বিড়ম্বিত আরডি সেবারও বঞ্চিত! সুরকার পিতার অর্কেস্ট্রায় তবলা বাদক ও হারমোনিকা প্লে দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু রাহুলের।
১৯৫৮ সালে শচীন দেবে’র সুরে মুক্তি পাওয়া ছবি ‘সোলভা সাল’ এ কিংবদন্তীর গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া বিখ্যাত গান ‘হায় আপনা দিল তো আওয়ারা’র গুরুত্বপূর্ণ অংশে মাউথ অর্গান বাজিয়েছিলেন রাহুল, সেই বাদনের চমৎকারিত্ব আজো মুগ্ধ করে সংগীত পিপাসুদের। তার সুরারোপিত ২৯২ টি হিন্দি ছবি’র এমন সব সুপার হিট গান রয়েছে যা একই সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে সফল ও কালোত্তীর্ণ সৃষ্টি হিসাবে স্মরণীয়।
পড়োশান ছবি’র ‘ইয়ে চতুর নার বড়া হুশিয়ার, আশা ভোঁসলের কণ্ঠে পিয়া তু আব তো আযা, দাম মারো দাম, ‘চুরালিয়া হ্যায় তুমনে যো দিলকো, লতার কণ্ঠে আরাধনার কোরা কাগজ থা ইয়ে মান মেরা, রিমঝিম গিরে সাওয়ান, আঁধি’র তেরে বিনা জিন্দেগী সে কোই শিকওয়া তো নেহি, পারিন্দা ছবি’র ‘তুমসে মিলকে অ্যায়সা লাগা তুমসে মিলকে, নাইন্টিন ফরটি টু এ লাভ স্টোরি’র কুচ না কাহো,শোলে’র ইয়ে দোস্তি হাম নাহি তোরেঙ্গে,কাটি পতংগ ছবি’র ইয়ে জো মোহাব্বত হ্যায়’ ভারতীয় চলচ্চিত্রের সংগীতে অন্যতম সেরা সৃষ্টি। সুরারোপিত ৩১টি বাংলা ছবি’র গানেও আছে তার সোনালী পরশ:‘কি আশায় বাঁধি খেলাঘর’,‘আশা ছিলো ভালোবাসা ছিলো,এই যে নদী যায় সাগরে’, ‘মনে পড়ে রুবি রায়’,যেতে যেতে পথে হলো দেরী’।
ভারতের সিনে মিউজিক তার সুরের ছোঁয়ায়ই পেয়েছে স্বর্ণযুগের সন্ধান। গুলজার, মজরুহ সুলতানপুরি, আনন্দ বক্সি’র মতো গীতিকার, কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রফি, লতা-আশা’র গায়কি’তে রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন, জিনাত আমান, তনুজা, হেমা মালিনির অভিনয়,শক্তি সামন্ত হৃষিকেশ মুখার্জির চিত্র পরিচালনার কেমিস্ট্রির সঙ্গে যোগ হয়েছে রাহুল দেবের অতুলনীয় সুর। উপমহাদেশীয় সুরের সঙ্গে ওয়েস্টার্ন রক, মেক্সিকান, আরাবিক, ল্যাটিন সুরের দুর্দান্ত যুগলবন্দীই হলো আরডি’র সাফল্যের রেসিপি।
নিত্যব্যবহার্য দ্রব্য যেমন চিরুনি’র ঘর্ষণ কিংবা খালি লম্বা বোতলের মুখে শিস দিয়ে স্পেশ্যাল এফেক্ট ও সাউন্ড তৈরী করে (সোলে ছবিতে মেহবুবা..মেহবুবা গানে) একের পর এক হিট গান উপহার দেয়ার পরীক্ষা নিরীক্ষায় হামেশাই সাফল্য পেয়েছেন। নতুন সম্ভবনাময় প্লে-ব্যাক সিঙ্গারদের ব্রেক দেয়ার ক্ষেত্রে তার দুঃসাহস যে ব্যর্থ হয়নি তা কুমার শানু, অভিজিৎ, হরিহরন, কবিতা কৃষ্ণমুর্তি, মোহাম্মদ আজিজের মতো শিল্পীদের রাজসিক উত্থানে প্রমাণিত। তার অর্কেস্ট্রায় বাজিয়ে হাত পাকিয়েছেন লক্ষীকান্ত-পেয়ারেলালের মতো লিজেন্ড কম্পোজার জুটি। আশির দশকে শেষদিকে ব্রেক ডান্স ও ডিস্কো মিউজিকের আগ্রাসনে মার খায় রাহুল দেবের রোমান্টিক মেলোডিয়াস সুর।
পাশপাশি আশা ভোঁসলের সঙ্গে অসফল দাম্পত্য জীবন তাকে ফেলে দেয় চরম হতাশা আর নিসঙ্গতায়। জীবনের কঠিন সময়ে প্রিয়জনদের কাছে রাহুল পাননি সহানুভূতি তা তার দ্বিতীয় স্ত্রী আশা ভোঁসলে’র অকপট স্বীকোরক্তিতে পরিস্কার, ‘উই আর ব্যাসিকালি পার্টনার অফ মিউজিক্যাল জার্নি, মোর দ্যান আ কাপল।’
১৯৯৪ সালে পরিচালক বিধু বিনোদ চোপড়া তার ‘১৯৪২ আ লাভস্টোরি’র’ সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব রাহুল’কে দেন সকল বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে। আরডি’কে সুরকারের দায়িত্ব থেকে না সরালে ছবির মিউজিক ট্র্যাক কিনতে অস্বীকার করেন অনেক ডিস্ট্রিবিউটার। কিন্তু টলেননি বিধু বিনোদ। আরডি’র মৃত্যুর তিন মাস পর মুক্তি পায় ‘১৯৪২ এ লাভ স্টোরি’। ছবি’র হৃদয় ছোঁয়া গান আবারো তাকে ফিরিয়ে দেয় বক্স অফিসে সফল সুরকারের স্বীকৃতি, তৃতীয়বারের মতো ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, সর্বোপরি সংগীত বোদ্ধাদের অকৃপন প্রশংসা। মৃত্যুর পর ফিল্মফেয়ার কর্তৃপক্ষ সেরা উদীয়মান সুরকারের জন্য তার নামে প্রবর্তন করে ‘ফিল্মফেয়ার অ্যানুয়াল প্রমিজিং মিউজিশিয়ান অ্যাওয়ার্ড।’ মুম্বাইয়ে সান্টাক্রুজে তার বাড়ীর সামনের রাস্তার নামকরণ হয়েছে রাহুলের নামে। ততদিনে তিনি জাগতিক চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে।