শিশু সাহিত্যিক আমীরুল ইসলাম চেয়েছেন, সপ্তাহে একদিন বইমেলা হোক। দারুণ ব্যাপার! কর্তা ব্যক্তিরা একটু মনোযোগ দিয়ে ভাবলে এর যৌক্তিকতা খুঁজে পাবেন। নিশ্চিত এটি হয়ে যাবে একসময়। এর সঙ্গে যদি একটি বইয়ের বড় বাজার থাকতো! একটি বিশাল ভবন। সেখানে লাইব্রেরি ও পাঠাগার। সেখানেই বড় বড় বইয়ের দোকান। সেখানেই থিয়েটার হল। দেশে সুন্দর সুন্দর বইয়ের দোকান হচ্ছে। পাঠক সমাবেশ, বাতিঘর, বেঙ্গল বুকস। তারা সুন্দর ভাবনা ও বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে। সৃজনশীলতার সঙ্গে সাহস ও বিনিয়োগ যুক্ত হলেই এসব সম্ভব।
একসময় শাহবাগের আজিজ মার্কেট ছিল লেখক কবি পাঠকদের প্রাণকেন্দ্র। বহু বইয়ের দোকান। ক্রয়েটিভ ও স্বপ্নচারী তরুণদের স্বপ্ন দেখার করিডোর। দোকানে দোকানে কবিতা। দোকানে দোকানে গল্প উপন্যাস। লিটল ম্যাগজিন। কবিসভা। চলচ্চিত্র ভাবনা। যেন এক জ্ঞানালোক। এখানকার কোনো দোকানই দোকান ছিল না। সবই ছিল জীবন বিকাশের প্রয়াস। এখানে বাণিজ্য এসে হোঁচট খেত। লেখক কবিরা সকাল দুপুর রাতের সংসার খুলে বসতো। ব্যবসাদাররা বিরক্ত হয়ে যেত। কবিদের প্রাণ খুলে যেত। সেই আজিজ মার্কেট থেকে একদিন বই বেরিয়ে গেল। লেখক কবি বেরিয়ে গেল। গেঞ্জি টি-শার্টের সঙ্গে দাঁড়াতে শুরু করলো বাণিজ্য। এখন কাব্য ছাড়া টি-শার্ট, চেতনা ছাড়া জিন্স প্যান্ট, কী কথা বলে?
আজিজ মার্কেটের সেই দিনগুলি হারিয়ে গেছে। সেখানকার সিঁড়িতে সামনের ফুটপাতে আর কোনো দামী মানুষ শতভাগ আস্থা নিয়ে ল্যাটা গেড়ে বসে যান না। আজিজের সেই কবিরা কোথায় গেছেন? সেই প্রাণিত মানুষেরই এখন কোথায় বসেন? আসলে নদী শুকিয়ে গেলে মাছ থাকে না। গাছ না থাকলে পাখি আসে না। কিছু জীবনের উপকরণ থাকতে হয়। তা না হলে কী নিয়ে বাঁচবে প্রাণি!
আমরা বইমেলা থেকে এসব ভাবতে থাকি। আমাদের স্বপ্ন দেখার সাহস বাড়িয়ে দেয় প্রাণের বইমেলা। নিশ্চিত করেই বিশ্বাস হয়, বইমেলায় যারা সময় কাটান তারা জীবনে অসাধারণ কিছু পেয়ে যান। শুধু মনোযোগের ব্যাপার। যারা বইমেলায় প্রতিদিন আসেন, তারা যেন ফিরে পান হারানো নদী। ফিরে পান জীবনের হারানো সুর। কিন্তু বইমেলার দিনগুলো যখন ফুরোতে থাকে তখন এই মানুষগুলোই আবার কিছু খুঁজতে থাকেন। কিছু গভীরভাবে তাদের টানতে থাকে। শুধু তৃষ্ণাই বাড়তে থাকে। নিবারণের ব্যবস্থা নেই। আমরা খটমটে পুঁজি আর টাকা নির্ভর জীবনের পথেই হাঁটতে থাকি। বিশ্বাস করি যা হারিয়েছি তা আর পাবো না।
শাহবাগের আজিজ মার্কেটের পর কাঁটাবনের কনকর্ড নিয়ে কেউ কেউ স্বপ্ন দেখলেন। ক্ষুদ্র বিনিয়োগরারীদের অনেকেই দোকান খুললেন। কিন্তু গত এক দশকেও বিন্দুমাত্র জমলো না মার্কেট। বাস্তবতা হচ্ছে আজকের দিনে কুটির শিল্প করে বড় প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা যায় না। পরিকল্পনাবিহীন ক্ষুদ্র বিনিয়োগ শুধু লোকসানের ফর্দই বড় করে। বড় কিছুর জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা, বিনিয়োগ, আর অবিরত নিষ্ঠা প্রয়োজন। দেশের বড় বিনিয়োগকারীরা নানা পণ্যের যেমন পসরা খুলে বসেছে, সেখানে তারা ছাড় দিয়ে বাণিজ্য করছে। ভোক্তাকে তৃপ্ত করেই অল্পদিনে বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছে। বইকে ঘিরে এমন বড় চিন্তা করার সময় এসে গেছে। বড় আকারে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া হলে এখন সাফল্য নিশ্চিত করা যায়।
কারো কারো মতে, বাংলাবাজার তো আছেই। বইয়ের বড় এক কেন্দ্র। যারা বোঝার তারা ঠিকই বুঝছেন, বাংলাবাজার লেখক, পাঠক, প্রকাশক ও সাধারণ দর্শকের সম্মিলন ক্ষেত্র হতে পারে না। এটি প্রকাশকদের বাণিজ্যিক আড়ত। বাণিজ্য যতটা এগিয়ে থাকে, ভোক্তা বা পাঠক ততটা নয়।