সন্দেহজনক ঘোরাফেরা! দুনিয়া জুড়ে এখন এটি বিশেষ আলোচিত একটি শব্দ! বিশেষ করে ইসলামী জঙ্গি সমস্যা মহামারীর রূপ নেবার পর এমন কিছু নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে সর্বত্র! সন্দেহজনক ঘোরাফেরার অভিযোগে অমুককে গ্রেফতার করা হয়েছে, এমন নিউজ হয় প্রায়!
গুলশান হত্যাকাণ্ডের পর রিলিজ করা ফুটেজে দেখা গেল ঘটনার আগে ওই এলাকা দিয়ে কয়েকজন সন্দেহজনক ঘোরাফেরা করছিল! তাদের মাঝে একজন ছিলো নারী! পরে ওই সন্দেহভাজন ওই নারীকে নরসিংদী থেকে গ্রেফতারের পর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে গুলশানকাণ্ডের হোতাদের শনাক্তের খবর!
আমার পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমনের বিষয়টি এই সময়ে হলে আমিও হয়তো এমন সন্দেহজনক ঘোরাফেরার অভিযোগে আটক অথবা কোনো মামলায় পড়ে যেতাম! সেই সময়টা আজকের মতো খারাপ সময় ছিলো না বলে পার পেয়ে গেছি!
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাকে যে শান্তিবাহিনী আটক করেছিল সেটিকে তারা তাদের কৌশলগত স্পর্শকাতর এলাকায় সন্দেহজনক ঘোরাফেরার কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছিল।
ঘটনাটা এখানে একটা রিলিফ স্টোরি হিসাবে লিখছি। একই ধরনের হাঙ্গামা, অপরাধ বিষয়ক খবর পড়তে পড়তে পাঠকদের অনেকে এখন বিরক্ত-ক্লান্ত! এটি পড়ে তাদের কেউ কেউ হয়তো কিছুটা রিলিফ পেতে পারেন।
সেদিন আমি খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার তাইন্দং থেকে পানছড়ি যাচ্ছিলাম। গভীর পাহাড়ি জংগলের ভিতর দিয়ে মাটির রাস্তা। পার্বত্য চট্টগ্রামের ওই এলাকাগুলোতে আজকাল এমন জংগলাকীর্ন পথ তেমন নেই আর। বেশিরভাগ এলাকার গাছ কেটে সব সাবাড়! ওই এলাকাগুলোর মাটির রাস্তা সবও এখন পাকা অথবা পীচ ঢালা পথ হয়ে গেছে। আমার সেই সময়ে এমন ঘোরাঘুরির সময়টায় একা একা অনেক ভয় করতো। কারণ অনেক সময় কয়েক কিলোমিটার হেঁটে গেলেও কোনো মানুষ দেখতাম না।
কিন্ত ধারণা করতাম আশেপাশে মানুষের বসতি আছে! রাস্তার পাশে ছোট ছোট গর্ত দেখে সে ধারণা হতো। অভাবের জনপদে সেসব গর্তে পানি ঢেলে এক ধরনের পোকা বের করতো মারমা ছেলে-মেয়েরা। আমাকে অনেকে বলেছেন অভাবী পরিবারের ছেলে-মেয়েদের সেটি ছিলো সকালের খাবার! সেগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে মচমচে করে তাদের খেতে দেয়া হতো! সত্য মিথ্যা বলতে পারবো না। কারণ এভাবে কাউকে সামনসামনি খেতে দেখিনি।
এমন পথ দিয়ে হেঁটে যেতে ভয় তাড়াতে আমার হ্যাড়ো গলায় গলা ছেড়ে গান গাইতাম আমি। ভূপেনের ‘আমি এক যাযাবর’ আর বাংলা সিনেমার গান ‘কত দূরে আর কত দূরে ভালো্বাসার ঠিকানা’ গান দুটি গাইতাম আমি। আমার বেসুরো গানের সুর পাহাড়ে প্রতিধবনিত হয়ে ফিরে আসতো আমার কাছে! এ নিয়েও ভয় করতো!
সেদিন সে পথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে পিছন থেকে কর্কশ কন্ঠে একটি আদেশ শুনতে পাই, ‘হ্যান্ডস আপ’! পিছন ফিরে দেখি অস্ত্রহাতে তিন পাহাড়ি দাঁড়িয়ে! পর্যটক হিসাবে সারাদেশে আমি বেশ আদর-আপ্যায়ন পাচ্ছিলাম। আদর-খাতির-যত্ম পাচ্ছিলাম পার্বত্য চট্টগ্রামেও। কিন্তু এমন আদরতো আর কোথাও পাইনি! বিশেষ করে ওদের হাতের অস্ত্রগুলো দেখেতো আমার জান তখন অর্ধেক!
আমি হাত তুলে দাঁড়িয়েছি। তখন পিছন থেকে আরও কয়েকজন এসে আমাকে ঝাপটে ধরে! এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি মারতে মারতে শার্ট খুলে আমার চোখ-হাত বেঁধে ফেলে! পিঠ থেকে এক ঝাপটায় খুলে আমার হ্যাভারশেক ব্যাগ। সবুজ রঙের ওই ব্যাগটি পার্বত্য অঞ্চলের কোনো একটি ক্যাম্পে তৎকালীন বিডিআর আমাকে উপহার হিসাবে দিয়েছিল। শাদা রঙে সোহাগে লিখে দিয়েছিল আমার নাম, ‘পরিব্রাজক বদরুল’।
পাহাড়ি অস্ত্রধারীরা আমাকে মারতে মারতে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটা দিয়েছে! আমি ধারণা করতে পারি শান্তি বাহিনীর কবলে পড়েছি! এ বাহিনীর লোকজনের সঙ্গে যদি দেখা হয় এমন একটি গোপন বাসনা আমার মনের মধ্যে ছিলো। কিন্তু দেখা হলে এরা যে আমাকে এমন মারবে তা আগে ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি।
সেই পাহাড়ি পথ দিয়ে চোখ বাঁধা আমাকে টেনে যাবার সময়ও অনেকে ইচ্ছামতো মারছিল। তাদের কেউ কেউ গালি দিয়ে বলছিল, ‘বাঙালি কুত্তা’! এর আগে পাহাড়ে ভয় তাড়াতে আমি গান গাইতাম। আর তখন ভয়ে কাঁপছি আর কাঁদছি! বেশি জোরে কাঁদতেও পারি না। কারণ জোরে কাঁদলে তাদের গালি আর মারের জোর বাড়ে!
অনেক পথ হাঁটাতে হাঁটাতে পরে এক জায়গায় আমাকে একটা গাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে বসালো। আগে থেকে আমার চোখ বাঁধা ছিল। সেখানে আমাকে বাঁধা হলো গাছের সাথে। আমার প্যান্টও খুলে নেয়া হয় এক হ্যাচকা টানে। পাহাড়ির নিজস্ব ভাষায় তাদের নিজেদের মধ্যে কথোপকথনের শব্দ শুনি। কিন্তু ভাষাটি জানি না বুঝি না বলে ধারণা করতে পারি না তারা কী বলছে। এক পর্যায়ে আমার চোখের বাঁধন খুলে দেয়া হয়।
চোখ খোলার পর দেখতে পাই সেখানে পাঁচজন লোক। সবার পরনে সবুজ রঙের পোশাক। একজনকে আমার তাদের অফিসার মনে হয়। অন্য চারজন চারটি অস্ত্র তাক করে আমার দিকে দাঁড়িয়ে ছিলো। অফিসার লোকটি জানতে চায় আমি কে, এখানে কী করতে এসেছি। আমি বলি আমি একজন পর্যটক। ফেনী পলিটেকনিকে পড়তাম। এখন পায়ে হেঁটে বাংলাদেশ ভ্রমনে বেরিয়েছি। এ পথ দিয়ে পানছড়ি যাচ্ছিলাম।
আমার কথাবার্তায় সাক্ষ্য দেয় আমার ব্যাগে থাকা কাগজপত্র। বিশেষ করে একটি বাঁধাই করা খাতা। যার সঙ্গে যেখানে দেখা হতো সে আমাকে নিয়ে তার অনুভূতি প্রতিক্রিয়া সে খাতায় লিখতো। এছাড়া ততদিনে যত পত্রিকায় আমাকে নিয়ে যত নিউজ ছাপা হয়েছিল সেগুলোও আমি কেটে সে খাতায় পেষ্ট করে লাগিয়ে রেখেছিলাম।
এক পর্যায়ে আমি বুঝতে পারি আমি তাদেরকে আস্থায় আনতে পেরেছি। আমাকে তারা পানি খেতে দেয়। প্যান্ট পরে নিতে বলে। কিন্তু আমিতো তখনও গাছের সঙ্গে বাঁধা। বসে বসে প্যান্ট পরতে গিয়ে টের পাই আমার সারা শরীরে ব্যথা। বিশেষ করে মুখের নানা অংশ ফোলা। মারের চোটে ঠোঁট ফেটে রক্তও বেরিয়েছে। ওরা স্বাভাবিক হয়েছে আর মারছে না দেখে ওই পরিস্থিতি ভালোও লাগে!
আমি অনেক পর্যটকের ভ্রমন কাহিনী পড়েছি। তাদের পথে পথে অনেক বিপদ হয়েছিল। আমার কোন বিপদে পড়ার ঘটনা নেই। খালি মানুষের আদর আর আদর! মনে মনে বলি এখান থেকে যদি বেরিয়ে যেতে পারি তাহলে সবাইকে বলার লেখার মতো একটা ঘটনা ঘটছে! অফিসার লোকটা আমার কাগজপত্র পড়ছিল। এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করে তুমি মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করছো কেনো। আমি জবাব দিয়ে বলি, এটি আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল। অফিসার বলে তারাও মুক্তিযোদ্ধা।
আমি তাকে একটি প্রশ্ন করার সুযোগ চেয়ে নেই। তাকে বলি তুমিতো বুঝেছো আমি মুক্তিযোদ্ধাদের কত শ্রদ্ধা করি। তোমরা মুক্তিযোদ্ধা হলে তোমাদের লোকজন মানুষকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করছে কেনো। এটাতো কোনো মুক্তিযোদ্ধার কাজ হতে পারে না।
এতে করে ক্ষেপে যায় অফিসার। স্টপ ননসেন্স’ বলে আমাকে সে ধমক দিয়ে শাসায়। তার সঙ্গী চারজনের অস্ত্রগুলো আমার আরো কাছাকাছি চলে আসে। এক পর্যায়ে তাদের সরে যাবার ইশারা দেয়। আমাকে সে বলে আমাদের পাহাড় থেকে তোমরা বাঙালিরা সবকিছু উজাড় করে নিয়ে যাচ্ছো। আমাদের তোমরা আমাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেছো। কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে আমাদের ভিটেমাটি, জমি সব ডুবিয়ে দিয়েছো। এখন আবার সেটেলার বাঙালিদের এনে বসিয়েছো! আমরা আমাদের পাওনা আদায় করে রাখছি। এটা কী কেউ সেঁধে দেয়?
অফিসার আমাকে শাসিয়ে বলে আর এমন উলটাপালটা কথা বললে তারা আমাকে গুলি করে মারবো। তার কথায় ভয় পেয়ে যাই আমি। মনে মনে ঠিক করি আর এভাবে কথা বলা যাবে না। আমাকে এখান থেকে যে কোন মূল্যে বেরিয়ে যেতে হবে।
এক পর্যায়ে অফিসার সেখান থেকে কিছুক্ষণের জন্যে চলে যায়। অন্যরা তাদের অস্ত্র তাক করে আগের মতো দাঁড়িয়েই ছিলো। অফিসার ফিরে এসে আমাকে বলে তোমাকে আমরা ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু কোনো চালাকি করবেতো মরেছো। তোমাকে আমাদের লোকজন গোটা পার্বত্য এলাকায় অনুসরণ করবে।
আমি কিরা-কসম যা জানি সবসহ তাদের কথা দেই আমি তাদের কোনো ক্ষতি করবো না। তারা আমার বাঁধন খুলে দেয়। কিন্তু শার্ট পরতে দেয়না। একজন একটা ফ্লাক্স নিয়ে আসে। আমাকে তারা কিছু পানীয় খেতে দেয়। পানীয়টা নাকের কাছে নিলে আমার বেশ দূর্গন্ধ লাগে!বুঝতে পারি এটি পাহাড়ি মদ! আমাকে আদেশ দিয়ে বলে, এটি এক ঢোকে খেয়ে ফেলো। আদেশ পালনের পর আবার দিয়ে আদেশ করে আমাকে খাওয়ায়। এভাবে পরপর তিনবার! আমার তখন টালমাটাল মাতাল অবস্থা!
এরপর আমার শার্ট দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলা হয় আবার। অফিসার আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বলে গুডলাক। এরপর আমার খাতাটি আমার দেয়। আমার ব্যাগ-ক্যামেরা কিছু দেয়না। একজন আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। আমি ভয়ে আমার ব্যাগ-ক্যামেরা এসব চাইতেও পারি না। যদি আবার রেগে যায়! মনে মনে বলি, আগে জান বাঁচাই। অনেক পথ হাঁটিয়ে আমাকে তোলা হয় রাস্তায়।
আমাকে একজন পিছন থেকে আদেশ করে বলে, ওয়ান-টু-থ্রি এভাবে টুয়েন্টি পর্যন্ত বলে বলে হেঁটে যাও। এরপর চোখ খুলবে। আগে খুলেছোতো মরেছো। আমিতো তখন মাতাল। ওয়ান-টু-থ্রি এভাবে থ্রি পর্যন্ত বলে হেঁটে মাথা ঘুরিয়ে মাটিতে পড়ে যাই। কিছুক্ষণ ওই অবস্থায় বসে থেকে ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে দেখি আশেপাশে কেউ নেই!
আমার তখন ভয় আরও বেড়ে যায়। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না তারা আমাকে সত্যি সত্যি কী ছেড়ে দিয়েছে? আমার ভয় ঢুকে যায় তারা কী আমাকে রাস্তায় মারবে? ভয়ে আমি দৌড়াতে থাকি। দৌড়াতে গিয়ে মাতাল আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাই রাস্তার ওপরে। আবার উঠে আবার দৌড়াই। এভাবে সন্ধ্যা নাগাদ পানছড়ি বাজারের কাছে পৌঁছি।
একটি খরস্রোতা পাহাড়ি ছড়া পেরিয়ে বাজার। ওই এলাকায় তখনো বিদ্যুৎ পৌঁছেনি অথবা তখন বিদ্যুৎ ছিলো না। কোথাও কোথাও জ্বলছে হ্যাজাক বাতি অথবা জেনারেটরের বিদ্যুতের আলো। কোনো নৌকা ছিলো না ছড়া পেরোনোর। পানিতে নেমে ওভাবে পেরোতে গিয়ে ভিজে যায় আমার কাপড়। ছড়া পেরিয়ে সামনে যে চায়ের দোকান পেয়েছি সেটিতে ঢুকে একটি খালি বেঞ্চের ওপর শুয়ে পড়ি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলি আমি।
জ্ঞান ফেরার পর দেখি অনেক লোকজন চারপাশে। পুলিশের কিছু লোকজনও। একজন নিজেকে পানছড়ি থানার ওসি পরিচয় দিয়ে আমার ঘটনা জানতে চান। শান্তি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিলাম সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে এসেছি বললে তারা আমাকে থানায় নিয়ে চলেন। থানায় উপজেলার ডাক্তার ডেকে এনে আমার শুশ্রুষার ব্যবস্থা করা হয়। আমার জন্যে আনানো হয় রাতের খাবার।
ওসি আমাকে বলেন ভাগ্য ভালো বাইচা আইছেন। দেশ দেখা আর লাগতোনা। কাইল আপনারে গাড়ির ব্যবস্থা করি দিমু আম্নি রাঙ্গামাটি চলি যাইবেন। পরের সকালে আমি আর ওসির কথামতো রাঙ্গামাটি যাইনি। এতে তিনি বেশ রাগ হন। আমি তা গায়ে না মেখে আমার বাকি সব ঘুরে আস্তে আস্তে কয়েকদিনে পৌঁছেছি রাঙ্গামাটি। আমি টের পাচ্ছিলাম শান্তি বাহিনীর সোর্সরা আমাকে অনুসরণ করছে। কিন্তু তাদের পাহাড়ে সন্দেহজনক ঘোরাফেরার দায়ে তারা আমার ক্ষতি করেনি। কারণ তারা কোনো জঙ্গি গোষ্ঠী ছিলো না। সেই ঘটনা নিয়ে আমার ‘শান্তি বাহিনীর সঙ্গে সাড়ে তিন ঘণ্টা’ লেখাটি পরে বেশ পাঠক প্রিয় হয়েছিলো।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)