ঢাকা স্কুলের একটি শ্লোগান আছে- ‘শিশুর সাথে হ্যাঁ বলি, শিক্ষক হোক শিশুর প্রথম শ্রেনির বন্ধু।’ অন্য একটি স্কুলে শিক্ষক পাঠদান করছেন প্লে গ্রুপের শিশুদের। শিক্ষিকা বলছেন- বলো ‘এ’, শিশুরা বলছে- ‘এ’ বলবো না। শিক্ষিকা বলছেন- বলো ‘বি’, শিশুরা বলছে- ‘বি’ বলবো না। একইভাবে শিক্ষিকা বলছেন- বলো ‘সি’। শিশুরা বলছে, ‘সি’ বলবো না।
সুন্দর এক আনন্দঘন পরিবেশে শিশুরা প্রত্যেকটা অক্ষর মুখে উচ্চারণ করে শিখে নিল। এ থেকে জেড পর্যন্ত। স্বভাবতই শিশুরা “না” বলতে কিংবা বিপরীত কাজ করতে পছন্দ করে। যেমন, বেশিরভাগ শিশুই উল্টাভাবে স্যান্ডেল পায়ে দিতে শিখে। অনেক শিশু বাম হাতে লিখতে চায়। শিক্ষিত বাবা-মা সেভাবেই অগ্রসর করছেন তার সন্তানকে। কিন্তু অসচেতন বাবা-মা মনে করেন বাম হাতে লেখা দমন করতেই হবে। নাহয় সন্তান ভুল পথে অগ্রসর হবে; জীবন নষ্ট হবে।
অনেক শিশুই খেতে চায় না। এই নিয়ে করা হয় শিশুর প্রতি জোরজবরদস্তি। এই প্রবণতা শহরে বেশি। গ্রামের শিশুরা নিজের হাতে অভ্যস্ত। এমন অনেক ক্ষেত্রেই গ্রামের শিশুর সাথে শহরের শিশুর পার্থক্য রয়েছে; যা শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের অন্তরায়।
শহরের, বিশেষ করে বিত্তবান পরিবারের শিশুরা চার দেয়ালের ভেতর বসবাস করে, ফাস্টফুড -চিপস-চকলেট-কোল্ড ড্রিংকস ইত্যাদি খেয়ে বেড়ে ওঠে। পড়াশোনা চলে কিন্ডারগার্টেন, ইংরেজি মাধ্যম, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি অতপর বিদেশ।
গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের শিশুরা তাজা ফল, সবজি, মাছ-ভাত, ঘি, গরুর খাঁটি দুধ খেয়ে বেড়ে ওঠে। মুক্ত আলো বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। ফলে এসব শিশু কিশোরেরা হয় সাহসী ও উদ্যমী। পড়াশোনা করে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, উচ্চবিদ্যালয়ে। তারা সুযোগ পায় মেডিকেল-বুয়েট আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক গ্রামে বেড়াতে যেয়ে নদীর ঘাটে ট্রলার ভিড়ল আমরা নেমে নৌকায় উঠলাম। বাড়ি থেকে নৌকা বেয়ে নিয়ে এলো প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছেলে। দেড়-দুই কিলোমিটার রাস্তার বিল পেরিয়ে বাড়ি পৌছে নিয়ে গেলো আমাদের।
গ্রামের ছেলে-মেয়েরা সাঁতার কাটা, গাছে ওঠায় পটু। কিন্তু শহরের ছেলে মেয়েরা সাঁতার শিখে সুইমিংপুলে।
আবার দেখা যায়, বিভিন্ন রকমের বই, পত্র-পত্রিকা, নানারকম সাংস্কৃতিক সংঘের সাথে গ্রামীণ শিশুরা পিছিয়ে। শহর-গ্রামের এমন ব্যবধান দুর করে উভয় স্থানের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা আবশ্যক। কেবল আলোচনায় সীমাবদ্ধ থেকে সরকার এবং জনগণকে এসব কাজে এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন।
শিক্ষা মানুষ হওয়ার জন্য। সার্টিফিকেট সংগ্রহের জন্য নয়। ‘এ প্লাস’ পেতেই হবে, এই মানসিকতায় সন্তান কিংবা ছাত্রের হাতে ফাঁস প্রশ্নপত্র তুলে দেয়া নয়।
নকল প্রত্যাশিদের কাছে নকলের ধরণ পাল্টেছে, পাল্টে নাই নকলের মানসিকতা। ৮০/৯০এর দশকে যখন নকলের ছড়াছড়ির সময় ময়মনসিংহের একটি স্থানীয় পত্রিকা ‘আজকের বাংলাদেশ’-এ একটি গল্পে লেখা ছিল, “আপনার সন্তান কী ষোল বছরে উত্তীর্ণ হয়েছে? আসুন এখানে সুলভ মূল্যে এস.এস.সি পাশের সার্টিফিকেট পাওয়া যায়।”
অন্যায় পথে, ভুল পথে সন্তানকে দুর্জন না বানিয়ে মানুষ বানানোর সঠিক চেষ্টা নিলে তা বৃথা যাবে না। ভ্রমণ শিশুর ধারণার বিকাশ ঘটায়। এক একটা ভ্রমণ পাঠ বই এর এক একটা অধ্যায়ের তুলনা কম সহায়ক নয়। প্রকৃতি থেকেও শিক্ষা গ্রহণের বহু উপকরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
সুনির্মল বসুর, “সবার আমি ছাত্র”র মত-
আকাশ আমায় শিক্ষা দিল উদার হতে ভাইরে
কর্মী হবার মন্ত্র আমি বায়ুর কাছে পাইরে
পাহাড় শেখায় তাহার সমান হই যেন ভাই মৌন মহান
বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র,
নানান ভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)