সদকাতুল ফিতর। এই সদকার কেন্দ্র পবিত্র ঈদুল ফিতর। সহজ কথায় পবিত্র ঈদুল ফিতরের সাথে স¤পৃক্ত বলেই এটাকে ‘সদকাতুল ফিতর’ বলা হয়। প্রচলিত ভাষায় অধিকাংশ মানুষ ‘ফিতরা’ বলে থাকেন। সুরা আ‘লার ১৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে ‘সেই-ই সফলতা লাভ করেছে, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে।’ হজরত কাতাদাহ (রহ.) এই আয়াতের ‘তাঝাক্কা’ তথা ‘পরিশুদ্ধ হওয়া’ শব্দ দ্বারা ‘সদকায়ে ফিতর’কে উদ্দেশ্য করা হয়েছে বলে মত ব্যক্ত করেছেন। কেননা হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘রাসুলুলাহ সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম সদকাতুল ফিতরকে ওয়াজিব করেছেন। যাতে করে রোজাদারদের রোজার যাবতীয় ভুলত্রুটি পরিশুদ্ধ করা যায় এবং গরিব লোকেরা আহারাদি পায়’ (মিশকাত ১৬০ পৃষ্ঠা)।
সদকাতুল ফিতর কে দেবেন?
যাদের মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদ ঈদুল ফিতরের দিন সঞ্চিত থাকে, তাদের উপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। নিজের অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান বা অবিবাহিত মেয়ের পক্ষ থেকে আদায় করাও ওয়াজিব। সন্তানের নামে সম্পদ থাকলে সেখান থেকেও আদায় করা যাবে। প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের পক্ষ থেকে আদায় করা ওয়াজিব নয়। তবে আদায় করলে আদায় হয়ে যাবে। কোনো দারিদ্র্য সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ে থাকলে তার পক্ষ থেকেও আদায় করতে হবে। আর নিসাবের পরিমাণ হচ্ছে জাকাতের ন্যায় সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের সমপরিমাণ অর্থ। এ ক্ষেত্রে বছর পূর্ণ হওয়া শর্ত নয়, কেবল ঈদের দিন ঐ পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়াই ওয়াজিব হওয়ার জন্য যথেষ্ট। সামর্থবান সকলেরই এটি আদায় করতে হবে। কেননা নবীজি ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক, প্রাপ্তবয়স্ক, আযাদ ও গোলাম প্রত্যেকের পক্ষ হতে এক সা যব অথবা এক সা খেজুর সদকাতুল ফিতর হিসেবে আদায় করা ওয়াজিব করে দিয়েছেন’ (সহিহ বুখারি, হাদিস- ১৫১২)।
কাকে দেবেন?
অভাবগ্রস্ত ও ঋণগ্রস্ত, সম্বলহীন মুসাফির এক কথায় যাদেরকে যাকাত দেয়া যায়, তাদেরকে সদকায়ে ফিতরও দেয়া জায়েজ।
কী পরিমাণ দেবেন?
হাদিসে পাকে এ ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। হজরত আবদুলাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আলাহর রাসুল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম সদকাতুল ফিতর হিসেবে এক সা পরিমাণ খেজুর বা এক সা পরিমাণ যব দিয়ে আদায় করতে নির্দেশ দেন। অতঃপর লোকেরা যবের সমপরিমাণ হিসেবে দু’মুদ (অর্ধ সা) গম আদায় করতে থাকে’ (সহিহ বুখারি- ১৫০৩)।
সা’র বর্তমান পরিমাণ হচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন কেজি। উলেখ্য যে, দুর্ভিক্ষ চলাকালীন খাবার, অন্যথা নগদ অর্থ দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম বলে ওলামায়ে কেরামগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সেই হিসেবে এ বছর বাংলাদেশের জন্য ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক সর্বোচ্চ ১৯৮০ টাকা ও সর্বনিম্ন ৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে লোকেরা কেবলই সর্বনিম্ন পরিমাণটিকে গ্রহণ করে থাকে। অথচ হাদিসের আলোকে এমনটি করা মোটেও উচিত নয়। সামর্থবানদের অবশ্যই সর্বোচ্চ পরিমাণকে গ্রহণ করা উচিত।
কখন দেবেন?
ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের পরেই সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়। নবীজি ঈদের নামাজে যাওয়ার পূর্বেই তা আদায় করতেন। এটাই উত্তম। যেমনটি হাদিসে পাকে ইরশাদ হয়েছে, ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবীজি লোকদেরকে ঈদের সালাতের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন’ (আবু দাউদ-১৬০৯)।
তবে বিশেষ কারণে ঐ সময় আদায় করতে না-পারলে ঐ সময়ের আগে ও পরেও আদায় করা যাবে।
কেন দেবেন?
ইসলামের প্রতিটি বিধানের পেছনে মহান উদ্দেশ্য রয়েছে। তেমনিভাবে সদকাতুল ফিতর আদায়ের মধ্যেও ইহজাগতিক ও পারলৌকিক উভয় কল্যাণ নিহিত। এটি অনেকটা আধুনিক যুগের রিফাইনিং মেশিনের মত। যেটির মাধ্যমে পণ্যকে পরিশুদ্ধ করা হয়। অলিদের সর্দার হিসেবে খ্যাত হজরত আবদুল কাদের জিলানি রহ. রচিত বিশ্ববিখ্যাত কিতাব ‘গুনিয়াতুত ত্বালেবিন’র মধ্যে উলেখ রয়েছে, ‘রমজানের রোজার জন্য সদকাতুল ফিতর হচ্ছে নামাজের সাহু সিজদার ন্যায়। সাহু সিজদার মাধ্যমে যেমন নামাজের ত্রুটি সংশোধন করা হয় তেমনি রোজার যাবতীয় ত্রুটিকে সংশোধন করার মাধ্যম হচ্ছে সদকাতুল ফিতর’।
শুধু তাই নয়, সদকাতুল ফিতরের মাধ্যমে হতদরিদ্রের মাঝে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। সম্বলহীনরা পায় একটু সহানুভুতি। কিছুটা হলেও কেটে উঠে অভাবগ্রস্তদের অভাব। খুশির ঈদে ধনী-গরিব সবার মাঝে খুশি ছড়িয়ে পড়ে। নবীজির হাদিসেও সদকাতুল ফিতরের উদ্দেশ্য হিসেবে ইরশাদ হয়েছে, ‘গরিব লোকেরা যেন আহারাদি পায়’ (মিশকাত)।
ইসলাম চিরসুন্দর। ইসলামের এ সৌন্দর্য চির আধুনিক। সদকাতুল ফিতর এ সৌন্দর্যের একটি অংশ। যেটি একাধারে ঘটে যাওয়া ভুলের সংশোধন ও অভাবগ্রস্ত হতদরিদ্রের মাঝে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। চলুন, যথাযথভাবে ইসলামী অনুশাসন মেনে সদকাতুল ফিতর আদায় করি। তা আদায়ে কোনো প্রকার কার্পণ্য যেন আমাদের স্পর্শ না-করে। আল্লাহই উত্তম প্রতিদানদাতা।
‘যদি তোমরা (নিয়ামতের) কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো, তোমাদেরকে আরো বৃদ্ধি করে দেয়া হবে৷ আর যদি অস্বীকার করো, নিশ্চয় আমার আজাব অত্যন্ত কঠিন’ (সুরা ইবরাহীম, আয়াত-৭)।