চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সত্যি কি তারেকের সিদ্ধান্ত?

বিএনপির পাঁচজন সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন। নির্বাচনে ছয়জন বিজয়ী হলেও দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া বাকিরা শপথ নিয়েছেন। চারমাস ব্যাপী অনিশ্চয়তা আর নানা আলোচনা শেষে সময়সীমা শেষের আগের দিন বিএনপি দলীয় চারজন শপথ নিয়েছেন, এর আগে অন্য একজন শপথ নিয়ে দল থেকে বহিস্কৃত হন।

৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের বিজয়ী সকল সদস্যের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে শপথের বাধ্যবাধকতা ছিল। নিয়ম অনুযায়ী সংসদের প্রথম অধিবেশনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সাংসদ হিসেবে শপথ না নিলে আসন শূন্য হয়ে যাবে। ফলে সর্বশেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা শেষে দেখা গেল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাকিদের পথে হাঁটেননি, একা একাই থেকেছেন।

ফল প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন বাতিলের দাবি জানালেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত গণফোরাম ও বিএনপির নেতারা শপথ নিয়েছেন। এর আগে বিভিন্ন সময়ে গণফোরামের সুলতান মনসুর, মোকাব্বির খান শপথ নেন। তাদের বিরুদ্ধে দল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এরপর শপথ নেন ঠাকুরগাঁও থেকে নির্বাচিত বিএনপি দলীয় সাংসদ জাহিদুর রহমান জাহিদ। তিনিও দলের সিদ্ধান্তবিরোধী কাজ করায় দল থেকে বহিস্কৃত হন।

বিএনপি জাহিদুর রহমানের শপথকে ‘দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে’ শপথগ্রহণ বলছে, এর বিরুদ্ধে দলীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে তারা। আবার অপর চারজন শপথ নেওয়া দলীয় সাংসদের ব্যাপারে বলছে ‘তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে’ তারা শপথ নিয়েছেন। একসঙ্গে চারজন সাংসদ শপথ নিলেও মির্জা ফখরুল শপথ নেননি। তার শপথ নেওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, ‘দলের স্বার্থে শপথ নেননি’।বিএনপি

‘দলের স্বার্থে, দলের সিদ্ধান্তে’ মির্জা ফখরুল শপথ না নিলে বাকি চারজনের শপথ ব্যক্তিগত স্বার্থে- বিএনপির এই দ্বৈত ভূমিকা কি এমন কথা বলছে না? একজনের শপথ না নেওয়া যদি হয় ‘দলের স্বার্থে’ তবে বাকিদের শপথ নেওয়া কীভাবে দলের স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়? এই চারজন এবং আগের একজন কি তবে দলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলেন? একসঙ্গে চারজনের শপথের পর বিএনপি কি বেকায়দায় পড়ে বলছে এখন, তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে তাদের শপথ? তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে বিএনপির সাংসদরা যদি শপথ নিয়েই থাকেন, তাহলে একই সিদ্ধান্ত তো হওয়ার কথা মির্জা ফখরুলের ক্ষেত্রেও। সাংসদ হিসেবে শপথ ও সংসদে যোগ দেওয়ার এক বিষয়ে সিদ্ধান্ত তো তিন ধরনের হওয়ার কথা নয়। বাস্তবতা হলো এই শপথ বিষয়ক তিন ধরনের ঘটনা ঘটে গেছে বিএনপিতে; রহস্য কী!

‘দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে’ জাহিদুর রহমানের শপথের পর দল থেকে বহিস্কার; চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের হারুনুর রশীদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের আমিনুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উকিল আবদুস সাত্তার ভুঁইয়া ও বগুড়া-৪ আসনের মোশাররফ হোসেন- এই চারজন বিএনপি নেতার শপথ নিয়ে সংসদে যোগদান এবং এটাকে তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে শপথ এমন দাবি; আর মির্জা ফখরুলের শপথ না নেওয়া- এই তিন ঘটনা পরস্পরবিরোধী, একইসঙ্গে এ বিষয়ে দলটির নেওয়া পদক্ষেপগুলোও।

শুরুতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত গণফোরাম ও বিএনপির নেতারা শপথ না নিলেও তারা যে শপথ নিতে পারেন এই ধারণা করা মানুষের সংখ্যা ছিল বেশি। এরপর একে একে সুলতান মনসুর, মোকাব্বির খান, জাহিদুর রহমান জাহিদ, হারুনুর রশীদ, আমিনুল ইসলাম, উকিল আবদুস সাত্তার ভুঁইয়া এবং মোশাররফ হোসেন শপথ নেওয়ার পর মানুষের পূর্বধারণা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। যদিও গণফোরাম এবং বিএনপি একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই শপথের বিরোধিতা করে এসেছে। নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে তারা নতুন নির্বাচনের দাবিও জানিয়েছে। ধারণা ছিল ‘জনগণের কথা বলতে’ নির্বাচিতরা শপথ নেবেন এবং সেটাই হয়েছে। এখানে আরও এক বিষয় লক্ষণীয় যে প্রত্যেকেই শপথের আগে ‘দলের সিদ্ধান্তে শপথ’ নিয়েছেন বলে জানান, যদিও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের সেই দাবি অসত্য বলে প্রমাণ হয়েছে; অন্তত তাদের বিরুদ্ধে দলীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁওয়ে তার নিজস্ব নির্বাচনী এলাকায় পরাজিত হয়েছিলেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি ঠাকুরগাঁও ছাড়াও চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার আসন বগুড়া-৬ আসন থেকেও নির্বাচন করেছিলেন। দুই আসনে লড়ে বগুড়ায় খালেদা জিয়ার আসন থেকে তিনি বিজয়ী হন। তবে বিজয়ী হলেও নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শপথ গ্রহণ না করায় তার আসন এখন শূন্য। এখন নির্বাচন কমিশন ওই সংসদীয় আসনে উপ-নির্বাচনের আয়োজন করবে।

সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিজয়ী হলে কে হতে পারেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী- এমন আলোচনার বিপরীতে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে কিছু বলা না হলেও ধারণা করা হচ্ছিল মির্জা ফখরুলই ছিলেন ওই পদের দাবিদার। কারণ ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেন নির্বাচন না করায় শুরুতেই সংসদে যাওয়ার সুযোগ ছিল না তার। নিজের আসন নিশ্চিত করতে তাই মির্জা ফখরুল খালেদা জিয়ার আসনে নির্বাচন করেন। কারণ খালেদা জিয়ার ওই এলাকা সবসময়ই বিএনপির নিশ্চিত আসন বলে মনে করা হয়। নির্বাচনের ফলাফলেও ঘটল সেই ঘটনা। সারাদেশে বিএনপির চরম ভরাডুবি ঘটলেও খালেদার জিয়ার আসনে ধানের শীষ বিজয়ী হয়।

প্রধানমন্ত্রীত্বের হাতছানি, কিংবা নিশ্চিত বিজয়ী হতে বিএনপির নিশ্চিত আসনে যে মির্জা ফখরুল লড়ছিলেন সেই ফখরুলই সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেননি, অথবা শপথ নিতে পারেননি। শপথের ব্যাপারে বিএনপি শুরু থেকেই ছিল নেতিবাচক, এবং শেষ মুহূর্তে নিজস্ব সিদ্ধান্তে জাহিদুর রহমানের শপথ এবং অপর চারজন ‘তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে শপথ’ নিলেও মির্জা ফখরুলের ক্ষেত্রে না ছিল নিজস্ব সিদ্ধান্ত, এমনকি ছিল না তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত! ফলে আসন শূন্য তার; ওখানে হবে আবার নির্বাচন।

শপথ না নেওয়ার কারণ হিসেবে ‘দলের স্বার্থের, দলের সিদ্ধান্তের’ কথা বলছেন ফখরুল। আবার চারজনের শপথের কারণ হিসেবে বলছেন ‘তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে’। এখানে বড় প্রশ্ন সামনে চলে আসে- তবে মহাসচিব কি বলতে চাইছেন চারজনের শপথের ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে তারেক রহমান দলের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেন? তারেকের সিদ্ধান্তে চারজন শপথ নিলে ফখরুলের ক্ষেত্রেও সেই সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য হওয়ার কথা। সত্যি যদি তারেক সিদ্ধান্ত নিয়েই থাকেন মির্জা ফখরুলের সেই সিদ্ধান্ত অমান্য করার সাধ্য থাকার কথা নয়। তারেকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা মির্জা ফখরুলের। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। ফলে তারেক রহমান ও বিএনপির সিদ্ধান্তে চারজনের শপথ- শেষ মুহূর্তে বিএনপির এমন বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য হয় না।

মির্জা ফখরুলমির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাদে বিএনপির সর্বশেষ চারজনের শপথের পর আদতে দলটি তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না। এধরনের কোনো ব্যবস্থা নিলে দলটির মধ্যকার বিরাজমান অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার বিষয়টির আনুষ্ঠানিক দলীয় স্বীকৃতি হয়ে যেত। জাহিদুর রহমানের পরিণতি তাই ভোগ করতে হচ্ছে না শেষ চারজনের। আর ওদিকে জাহিদুর রহমানও চলে গেছেন সুবিধাজনক অবস্থানে, কারণ এখন দলও তার বিরুদ্ধে দেওয়া বহিস্কারাদেশ তুলে নিতে পারে।

দলের সিদ্ধান্তে চারজনের শপথ, দলের সিদ্ধান্তে একজনের শপথ না নেওয়া, দলের সিদ্ধান্তে শপথ নেওয়া সাংসদকে বহিস্কার- বিএনপির এই রাজনীতি হাস্যকর এক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী লন্ডনে থাকা তারেক রহমান, যার কারণে দেশে থাকা বিএনপির নেতারা দলের রাজনীতিতেও ভূমিকা রাখতে পারছেন না। দেশের রাজনীতি এভাবে বিদেশমুখী আর অযোগ্য নেতৃত্বের অধীনে পরিচালিত হলে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাও তাই নড়বড়ে হয়ে যায়। বিএনপি এখন এই ক্রান্তিকালে।

সরকারের নানা দমননীতি ও বিরোধিতা বিএনপির রাজনীতির প্রধান সমস্যা নয়। তাদের প্রধান সমস্যা নেতৃত্বের দুর্বলতা, নেতৃত্বের অযোগ্যতা এবং সেটার দায় একমাত্র তারেক রহমানের। আন্দোলন, রাজনীতি, নির্বাচন এবং শপথ নিয়ে তারেক রহমানের নেতৃত্ব যেসব কাণ্ড ঘটিয়েছে সেটা দলটির ভবিষ্যতকে কেবল অন্ধকারেই নিপতিত করা নয়, হাস্যকরও করেছে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)