বছরের পর বছর ধরে বিশ্বনেতাদের দফায় দফায় হুঁশিয়ারি আর অবরোধকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে হুমকি দেয়া, প্রতিবেশীদের ‘শত্রু’ বলে প্রকাশ্যে কথা বলা, ‘স্বৈরাচারী’ নামে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি (বা কুখ্যাতি) পাওয়া একজন ব্যক্তি হুট করেই হাস্যোজ্জ্বল, কোমল আর স্নেহশীল বনে গেলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক।
এমনটাই ঘটেছে নর্থ কোরীয় নেতা কিম জং উনের বেলায়।
চিরবৈরিতার সম্পর্ক যার সাথে, সেই সাউথ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায় ইনের সঙ্গে ঐতিহাসিক সাক্ষাতে কিমের অতি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ দেখে তা নিয়ে ভ্রু কুঁচকাচ্ছেন সমালোচকরা। ভাবছেন, কিম কি সত্যি সত্যিই এমনটা করছেন?!
২৭ এপ্রিল নর্থ ও সাউথ কোরিয়ার সীমান্তবর্তী ডিমিলিটারাইজড জোনে (ডিএমজেড) নর্থ কোরিয়ার কিম জং উন এবং সাউথ কোরিয়ার মুন জায় ইনের সাক্ষাৎ ও বৈঠকের প্রায় পুরোটা সময়ই গণমাধ্যমের অসংখ্য ক্যামেরা তাদের দিকে তাক করা ছিল।
বহু বছর পর একটা সময় কিম সাউথ কোরিয়ার ভূমিতে পা রাখলেন। মুনও আবার খুব অল্প সময়ের জন্য পা ছোঁয়ালেন নর্থ কোরিয়ার মাটিতে। সকালে প্রায় দু’ঘণ্টার হাসিখুশি বৈঠক করলেন দু’জন।
বৈঠকের পর দু’জনে মিলে সম্প্রীতির প্রতিকী চারা রোপন করলেন। তারপর দু’জনে হাত ধরে ছোটবেলার বন্ধুর মতো হেঁটে বেড়ালেন গাছে ঘেরা সবুজের মধ্য দিয়ে। সেখানে নিজ নিজ কর্মকর্তা ছাড়াই শুধু দু’জনে আধঘণ্টার মতো গল্প করলেন হাঁটতে হাঁটতে।
পুরোটা সময়ে পরস্পর শত্রু বলে পরিচিত দুই দেশের রাষ্ট্রনায়ক কখনো একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছেন, কখনো হাত ধরেছেন, কখনো নানা উপহার আদান প্রদান করেছেন। এমনকি গণমাধ্যমকে কড়া ভাষায় ভর্ৎসনাকারী কিমই গণমাধ্যম কর্মীদেরকে উপস্থিতির জন্য ধন্যবাদ জানালেন!
সব মিলিয়ে পানমুনজাম বা ‘শান্তি গ্রাম’-এ কিম-মুনের প্রতিটি আচরণ আর কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছিল যেন জটিলভাবে সাজানো কোনো নাটকের দৃশ্য এটি।
বিকেলের শেষ প্রান্তে গিয়ে দুই কোরিয়ার পক্ষ থেকে এলো ‘কোরীয় উপদ্বীপে পানমুনজাম শান্তি, সমৃদ্ধি ও একীভবন বিষয়ক ঘোষণা’ (Panmunjom Declaration for Peace, Prosperity and Unification on the Korean Peninsula)। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে দুই কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত হওয়া এবং দু’দেশের মধ্যকার দ্বন্দ্ব আনুষ্ঠানিকভাবে নিরসনের লক্ষ্যে আলোচনা শুরুর জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে।
বিষয়টা ইতিবাচক হলেও কয়েক দশকের দ্বিপাক্ষিক অবিশ্বাস আর বৈরিতার পর হুট করে শান্তি – একে বাস্তব বা বাস্তবায়নযোগ্য প্রেক্ষাপট হিসেবে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না অনেকেই। বিশেষ করে যেখানে ক’টা মাস আগেও দুই প্রতিবেশী যুদ্ধ শুরুর দ্বারপ্রান্তে ছিল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভাবুক ধারার টুইট পোস্ট করেছেন এ নিয়ে: ভালো ভালো কিছু ঘটনা ঘটছে, কিন্তু এর পরিণতি শুধু সময়ই বলতে পারবে!
হোয়াইট হাউজের আনুষ্ঠানিক বিবৃতি এক্ষেত্রে আরও ঠাণ্ডা ছিল:
নর্থ কোরীয় নেতা কিম জং উনের সঙ্গে রিপাবলিক অব কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায় ইনের ঐতিহাসিক বৈঠক উপলক্ষে কোরিয়ানদের জন্য আমাদের শুভকামনা। আমরা আশাবাদী, এই আলোচনা সমগ্র কোরীয় উপদ্বীপের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বয়ে আনবে।
তবে নর্থ কোরিয়াকে বরাবর ছোট চোখে দেখা জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে নিজের বক্তব্যে তার সন্দেহ লুকোতে পারেননি। তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রবলভাবে আশা করি নর্থ কোরিয়া এবার দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। আমি এখন থেকে নর্থ কোরিয়ার কর্মকাণ্ডের ওপর কড়া নজর রাখব।’
সোজা কথায় বললে দাঁড়ায়, ‘পারমাণবিক অস্ত্রমুক্তি নিজ চোখে না দেখে আমি বিশ্বাস করব না।’
নর্থ কোরীয় নেতার হাসিখুশি চেহারা দেখে ভুলতে চান না বেশ কয়েকজন পর্যবেক্ষক। হঠাৎ করে একজন মানুষ সাধু হয়ে যেতে পারেন বলে তারা বিশ্বাস করেন না।
‘এমন কতগুলো ছবি কি দেখেছেন কিমের যেখানে তিনি পারমাণবিক মিসাইলের পরীক্ষা দেখছেন খুশিখুশি হাসিমুখে?’ মিডলবারি ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ অ্যাট মন্টারি’র জেমস মার্টিন সেন্টার ফর নন-প্রলিফারেশন স্টাডিজ-এর গবেষক ক্যাথরিন ডিল এভাবেই তার সন্দেহের কথা তুলে ধরেন।
সিএনএন’কে ক্যাথরিন বলেন, শুধু দেখতে হাসিখুশি একজন মানুষ মনে হওয়ার মানে এই নয় যে তার উদ্দেশ্য সৎ বা তিনি আর কখনো মিসাইল ছুড়তে পারবেন না।
একইভাবে আরও অনেকেরই ধারণা, ভেতরে ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে অভিনয় করছেন কিম জং উন। তার বর্তমান কথাবার্তা কাজে রূপান্তরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এর কোনোকিছুই বিশ্বাস করা বুদ্ধিমানের কাজ নয় বলেই মনে করছেন এই বিশ্লেষকরা।