করোনাকালীন সময়ে দেশে বিদেশে চাকরি থেকে ছাঁটাই ও বেতন কাটার খবর পত্রিকার পাতায় বেশ ফলাও করে প্রচার হয়েছে। বেসরকারি খাতে মালিকপক্ষ নিজেদের বাঁচাতে এবং খরচ বাঁচাতে কর্মী ছাঁটাই শুরু করে। কারণ হিসেবে দেখানো হয়, করোনাকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠানের আয় ভাটার দিকে এবং সেটি বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের বেতন অর্ধেক করে ফেলা হয় এবং কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই শুরু করে। এমনো দেখা গেছে ছাঁটাই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত গোপনে সম্পন্ন হয়েছে এবং কেউই এ ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারেনি। মালিকপক্ষ ও প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা কিন্তু এ বিষয়টি ক্ষুণাক্ষরেও চিন্তা করেননি যাদের শ্রম আর ঘামে প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে লাভ করে আসছে বৈশ্বিক দুর্যোগে মালিকপক্ষের উচিত ছিল তাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের পাশে থাকা। কিন্তু সেখানে তারা অবিবেচকের ন্যায় কাজ করেছে এবং যাদের চাকরি রয়েছে তাদের বেতন ১০, ১৫ এমনকি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কেটে নেওয়া হয়েছে।
আলোচ্য নিবন্ধটিতে বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে বাংলাদেশের সমসাময়িক প্রেক্ষিত বিবেচনায় সচিত্র মূল্যায়ন তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। তার মধ্যে বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া, নিয়োগের ধরণ, বেতনভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি নিয়ে সামান্য আলোকপাত করা হয়েছে। পরিশেষে সংকট উত্তরণের জন্য সুপারিশমালাও প্রদান করা হয়েছে, বাস্তবায়নের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মহলের। প্রত্যাশা থাকবে বেসরকারি সেক্টরে যথার্থ নিয়োগবিধি মানার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতা ও সুবিধাদি বর্তমান সময়ের চাহিদার সমীকরণে যুগোপযোগী করা সম্ভবপর হয়ে উঠে।
বেসরকারি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর, সরকারি খাতের লোকসান দেখে অনেকেই কিছু কিছু সেক্টরকে বেসরকারিকরণের জন্য তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বেসরকারি খাতে চাকুরীজীবী নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা মানা হচ্ছে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এ শ্রমিক নিয়োগ, মজুরীর হার নির্ধারণ, মজুরী পরিশোধ, ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা, শ্রমিকের নিরাপত্তা, চাকরির পরিবেশ, কর্মকর্তা কর্মচারীর কল্যাণ সংক্রান্তে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে বেসরকারি চাকরিতে কিভাবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, কাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, নিয়োগের ধরণ, বেতন কাঠামো কিংবা অন্যান্য সুবিধাদি সম্বন্ধে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করছে। বিপরীতদিকে দেখা যায়, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মানের স্ট্যান্ডার্ড ধরে রাখছে এবং তাদের সফলতার হারও উল্লেখ করার মতো। আমার মনে হয়, বেসরকারি খাতে নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ের কমিটি ও সুপারিশমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে, যেখানে কিংবা যার ভিত্তিতে নিয়োগে স্বচ্ছতার জন্য জবাবদিহিতার বিষয়টি সামনে চলে আসে।
বাংলাদেশে মানসম্পন্ন ও সুপরিচিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সার্কুলার প্রদানের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। তবে নামসর্বস্ব অনেক প্রতিষ্ঠানেই সার্কুলার না দিয়েই নিয়োগ প্রদান করা হয়ে থাকে এবং এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই বেশি। তাছাড়া, বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠান প্রধান তথা প্রতিষ্ঠানের মালিক নিজের খেয়াল খুশিমতো নিয়মের তোয়াক্কা না করে নিয়োগ দিয়ে থাকেন (যেখানে সার্কুলার লোক দেখানো হয়ে থাকে) এবং ইচ্ছে হলেই কোন কারণ ব্যতিরেকে কিংবা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কর্মকর্তা কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করে থাকেন। এ বিষয়টি চরমভাবে মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং অপরাধের সামিলও বলা চলে। মাঝে মধ্যে পত্র-পত্রিকায় নিউজের শিরোনাম হয় অমুক প্রতিষ্ঠানের অত জন কর্মকর্তাকে একযোগে ছাঁটাই। এ রকম ঘটনা হরহামেশাই ঘটে থাকলেও এসবের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থার চিত্র খু্বই সামান্য। বলতে চাচ্ছি, মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে কোনরূপ ব্যবস্থা কখনোই গৃহীত হয় না কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নেই।
মাঝে মধ্যে এও দেখা যায়, হঠাৎ করেই লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পত্রিকা বন্ধ করে দেয় মালিকপক্ষ। করোনাকালে সাংবাদিক ছাঁটাইয়ের হিড়িক পড়ে যায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাংবাদিকদের আর্তনাদ বিভিন্ন খবরে উঠে এসেছে। অথচ, সাংবাদিকতার মতো মহান পেশা কখনো ব্যবসায়িক মূল্যে বিবেচনায় নেওয়া উচিত নয় এবং মালিকপক্ষকেও এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রেখে মিডিয়া পাড়ায় আসা উচিত। পাশাপাশি, একটা পত্রিকা বন্ধ করার সাথে সাথে বেকার হয়ে যাচ্ছে হাজার খানেক সাংবাদিক। আচমকা বেকার হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর কি অবস্থা দাঁড়ায় তখন? এ রকম বিষয় থেকে সুরাহার জন্য প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। অন্যথায় সমস্যা আরও ঘনীভূত হবে, বেসরকারি খাতের প্রতি যুব সম্প্রদায়ের আস্থাহীনতা চলে আসবে, পরবর্তীতে মারত্নক সংকটের মুখে পরবে বেসরকারি খাত।
বিশেষ করে বাংলাদেশ পরিচালিত বেশ কিছু এনজিও ও অন্যান্য দেশি বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে মালিক তথা প্রতিষ্ঠান প্রধানের ইচ্ছেমত নিজ এলাকার লোকজন কিংবা আত্মীয়স্বজন নিয়োগ দিয়ে থাকেন যেখানে উপযুক্ত ও মেধাবী প্রার্থীদের মূল্যায়ন ব্যতিরেকে। ইজম নামক শব্দটি অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত রূপ লাভ করেছে। পাশাপাশি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানেও ইজমের ছোঁয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। এলাকা ভিত্তিক পরিচয়ের মাধ্যমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাওয়া চিরাচরিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টা অনেকটা অঘোষিতভাবে কোটাভিত্তিক। যেখানে খুব কম সংখ্যক প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে মেধার মূল্যায়ন করে নিয়োগ প্রদান করা হয়ে থাকে। সবগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যদি যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হতো তাহলেও আমাদের চাকরির বাজারের অবস্থা এবং দেশের উন্নতির মাত্রা ভিন্নতর হতো নিঃসন্দেহে।
বেসরকারি চাকরিতেও নিয়োগের ক্ষেত্রে অঘোষিত ইজম, পারিবারিক, আত্নীয় কোটা ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। কারণ, বাংলাদেশে মানবসম্পদের বেশির ভাগই বেসরকারি চাকরির সাথে সম্পৃক্ত। পাশাপাশি, মানবসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত না করতে পারলে মধ্যম আয়ের দেশের যে ট্র্যাকে আমরা উঠেছি তা ধরে রাখা কষ্টকর হবে। কাজেই সরকারি চাকরিতে কিংবা বেসরকারি চাকরিতে সব সেক্টরেই মেধার যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া উচিত। তা ছাড়া সামগ্রিক পরিবর্তন কখনোই সম্ভব নয়।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগের ধরণ হচ্ছে অস্থায়ী ভিত্তিক। অর্থাৎ মালিক পক্ষ যখন ইচ্ছে (মাসখানেক আগে একটি নোটিশও অনেক সময় দেয় না) ঠিক তখনই চাকরিজীবীকে অব্যাহতি দিতে পারেন। একবার ভাবা যায়, নিয়োগের ধরণ অস্থায়ী হলে; চাকরিজীবী মানুষটি প্রকৃতঅর্থে মেধা মননের সবটুকু প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকল্পে কাজ করে যাবেন? সহকর্মীদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেখে অন্যরাও ভয়ে অনেকটা তটস্থ থাকেন, কখন আবার ছোট কোন বিষয়ে শাস্তির খড়গ নেমে আসে। বেসরকারি কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে জরিমানার নজিরও দেখা যায় কাজের ত্রুটি কিংবা কর্মস্থলে নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হলে। অথচ, ঐ সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে কাজ করে থাকেন। অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, কোন কোন প্রতিষ্ঠানে মাসের পর মাস বেতন বকেয়ার কারণে মানবেতর জীবন যাপন করছে অনেকেই কিন্তু চক্ষু লজ্জার কারণে প্রকাশ্যে কেউই বলছে না।
বেসরকারি চাকরিতে প্রতিষ্ঠানের পদোন্নতির ক্ষেত্রে মালিক পক্ষের চিন্তা চেতনা প্রসূত বিবেচনাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে বিষয়টা অত্যন্ত গর্হিত। অর্থাৎ মালিক কিংবা সিনিয়র বসের সাথে যে কলিগের সম্পর্ক ভাল, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অন্যের তুলনায় কম থাকা সত্ত্বেও একমাত্র সুসম্পর্ক থাকায় পদোন্নতি দেওয়া হয়ে থাকে। বিষয়টা সম্পূর্ণভাবে অনৈতিক এবং চাকরির ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীলতা এবং সৃজনশীলতার পরিপন্থী। এর ফলে দেখা যায়, অফিসের নিয়মকানুন ও অন্যান্য ডিসিপ্লিনে প্রভূত সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। সেখানে জুনিয়র এবং নব্য যোগদান করা ছেলে কিংবা মেয়েটি প্রতিষ্ঠানের কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, ব্যাঘাত ঘটে উৎপাদনশীল কর্মক্ষমে।
তাই, বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ সংক্রান্ত ত্রুটি পরিহার করার জন্য বেশকিছু বিষয়ের উপর সুদৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে শ্রম আইন ২০০৬ এর সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মকর্তা কর্মচারী ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রেও নীতিমালার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। মাসিক বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদি প্রণয়নের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ও উপযুক্ত হারে বৈশ্বিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। চাকরি থেকে অবসর নেয়ার সময় একটি নির্দিষ্ট হারে বেতন ভাতা কিংবা পেনশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। নির্দিষ্ট সময় পর পর বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদির ইনক্রিমেন্ট বর্তমান বাজার ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বরাদ্দ প্রদান করতে হবে।
উল্লেখ্য যে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেক সময় চাকরিজীবীদের বেতন ভাতা সঠিকভাবে পরিশোধ করা হয় না। প্রায়শই সংবাদমাধ্যমে বেতন পরিশোধ না হওয়ার বিষয়টি নজরে আসা স্বত্ত্বেও কোনরূপ ব্যবস্থা গৃহিত হচ্ছে না ঐসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এ বিষয়টিরও সুরাহা প্রয়োজন। কর্মচারিকে যথাসময়ে এবং সঠিক হারে বেতন প্রদান করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি যে কোন একটি দায়িত্বশীল এজেন্সি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারি সেক্টরের সার্বিক দিকে নজরদারি নিশ্চিত করে বেসরকারি সেক্টরে একটি জবাবদিহীতার সংস্কৃতি চালু করা যেতে পারে। তাহলেই দেখা যাবে বেসরকারি খাতে আহূত সমস্যা সমাধানকল্পে একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন করা সম্ভব হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)