দেশে শিশু সংগঠনগুলোর কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়ায় আর স্কুলগুলোতে সংস্কৃতি চর্চা-খেলাধুলা কমে যাওয়ায় শিশুদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। মোবাইল ফোন-ভিডিওগেমস-ফেসবুক তাদের অবসরের সঙ্গী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে তাদের মনের বিকাশ হচ্ছে না, তারা স্বপ্ন দেখতে পারছে না। এসব কারণে তাদের জীবনধারা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধে বড় পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে।
স্কুল-কলেজে পড়ে এমন কয়েকজন শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম অবসরে তারা কী করে। বেশিরভাগেরই উত্তর, তারা মোবাইলে সময় কাটায়। তরুণ প্রজন্ম, এমনকি শিশুদেরও এখন অবসরের প্রধান অনুষঙ্গ স্মার্টফোন, ভিডিওগেম, ফেসবুক, ইউটিউব। মাঠে খেলাধুলা, সাহিত্যের বই পড়া, দেশাত্মবোধক সঙ্গীত চর্চা, বিতর্ক, আবৃত্তি এখন বেশিরভাগ শিশু বা তরুণদের পছন্দের বিষয় নয়।
এ বিষয়ে শিশু সাহিত্যিক ও সংগঠক আলী ইমাম বলেন, ‘আমাদের শিশু সংগঠনগুলোর কার্যক্রম কমে যাচ্ছে সামাজিক বন্ধ্যাত্বের কারণে, সামজিক অস্থিরতার কারণে। মাঠ হারিয়ে গেছে, শিশুদের সোনালি শৈশব হারিয়ে গেছে, ছেলেমেয়েদের পাঠ চেতনা কমে গেছে। শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক পড়ে একটি শিশু বিকশিত হতে পারে না। এখন তারা ছোট্র একটা স্ক্রিনের মধ্যে নিজেদের বড় করে তুলছে। এতে তার মনের বিকাশ লাভ হচ্ছে না। আমাদের চারপাশে বেঁচে থাকার জন্য অনেক উপকরণ রয়েছে। সেটি শিল্পের মাধ্যমেই হোক, সঙ্গীত, গল্প-কবিতা লেখা বা পাঠচক্রের মাধ্যমেই হোক, যার মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তোলা। এই গড়ে তোলার কাজটিইতো এখন হচ্ছে না। ফলে শিশুরা আর স্বত:স্ফুর্তভাবে কথা বলতে পারছে না, বড় চিন্তা করতে পারছে না, স্বপ্ন দেখতে পারছে না। শিশু সংগঠনগুলো স্বপ্ন দেখতে উদ্ধুদ্ধ করতো।’
বাংলাদেশ শিশু একাডেমির পরিচালক আনজীর লিটন বলেন, ‘আমাদের সময় বিনোদনের একমাত্র সঙ্গী ছিল বইপড়া। বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিন। এখন কিন্তু বই বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম নয়। এখন যোগ হয়েছে অনেক ধরনের ডিভাইস-মোবাইল, টেলিভিশন, ল্যাপটপসহ প্রযুক্তির নানা কিছু। ফলে তাদের সাহিত্য চর্চার দিকটিও কমে গেছে।’
শিশুরা সংস্কৃতিমনা না হয়ে রোবোটিক চিন্তাভাবনার হয়ে বেড়ে উঠছে। এতে কী কী সমস্যা তৈরি হচ্ছে? জিজ্ঞেস করা হলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘শিশু সংগঠনগুলো আর আগের মতো নেই। তারা আর সামাজিক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে না। এই শূন্যতার ফলে হত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা ইত্যাদি বেড়ে গেছে। শিশুদের মধ্যে উচ্ছৃংখলতা, মারামারি, দুইজন শিশু মিলে একজনকে খুন করে ফেলা-ইত্যাদি প্রতিনিয়ত ঘটছে।’
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: মোহিত কামাল বলেন, ‘প্রযুক্তির উপকারিতা আছে, কিন্তু একইসাথে সমানতালে এর অপকারিতাও রয়েছে। বাচ্চারা অপ্রয়োজনীয় জিনিসের দিকে বেশি ঝুঁকছে। বাচ্চাদের উৎসাহ, আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা এসব দিকে ঝুঁকে গেছে। তারা পড়াশোনায় আর মনোযোগী নয়, আগ্রহ নেই। বাজে ওয়েবসাইটগুলোর কারণে তাদের মনোযোগ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। একটা মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকার কারণে তারা আর সামাজিক হতে পারে না। এককেন্দ্রিক হয়ে যায়, মায়া-মমতা কমে যায়। এর মাধ্যমে আমাদের জীবনধারা, নৈতিকতা, মূল্যবোধে বড় পরিবর্তন ঢুকে গেছে। আমরা ভোগবাদী অস্তিত্ব নিয়ে আমাদের সন্তানদের বড় করছি। এরা যখন বড় হবে, আমাদের দেশের ধারাবাহিক সংস্কৃতি থাকবে কী থাকবে না, আামি শঙ্কিত।’
এমন অবস্থা থেকে উত্তরনের উপায় তাহলে কী? এ বিষয়ে ডা: মোহিত কামাল বলেন, শিশু সংগঠনগুলোকে আবার জাগিয়ে তোলা দরকার। এ কাজটা সবাই মিলে করতে হবে। আর আমরা কোন ক্লাস থেকে বাচ্চার হাতে একটা স্মার্টফোন তুলে দেব, তার একটা নীতিমালা হওয়া দরকার। যে কোন একটা পর্যায় থেকে এটি ঘোষণা করতে হবে। নয়তো একটা বয়সে কেউ পাবে, কেউ পাবে না, এটা নিয়েও সমস্যা তৈরী হবে। বাজে ওয়েবসাইটগুলো ফিল্টার করতে হবে, সরকারিভাবে। তাহলে আমরা তাদেরকে রক্ষা করতে পারবো। আর সন্তানদের প্রতি মা-বাবার নিবিড় মনোযোগ থাকতে হবে। অনেক মা-বাবা বড় চাকরি করে, ব্যস্ত থাকে। আর বাচ্চারা বড় হয় ড্রাইভার বা কাজের বুয়ার সাথে মিশে। ফলে তাদের দ্বারা ওরা প্রভাবিত হয়।’
শিশু একাডেমির পরিচালক আনজীর লিটনও তার সাথে একমত। বলেন, ‘পরিবারের মনোযোগের পাশাপাশি মা-বাবাকে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। সময় দিতে হবে।’
এ বিষয়ে শিশু সাহিত্যিক ও সংগঠক আলী ইমাম কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের আক্ষেপ করলে চলবে না, পদক্ষেপ নিতে হবে। এই দায়িত্ব সবার, তবে শুরু করতে হবে পরিবারকে। শিশুদেরকে আবদ্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তি দিতে হবে। ভিডিওগেমের বীভৎসতা না দেখিয়ে ওয়ার্ল্ড ক্লাসিকের অ্যানিমেশনগুলো বাচ্চাদের দেখাতে হবে। আমাদের যে শিশু সংগঠনগুলো অতীতে কৃতিত্ব দেখিয়েছে, তাদের ধারাবাহিক ইতিহাসকে অবলম্বন করে পাড়ার তরুণ, যুবক ও অভিভাবকরা মিলে শিশু সংগঠন গড়ে তুলতে পারে। পরিকল্পিতভাবে সংগঠনের তৎপরতাকে নতুন করে কোন ভিন্ন আঙ্গিকে যদি ফিরিয়ে আনতে হয়, তার চেষ্টাও করতে হবে।’
আর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের পরামর্শ, ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আরো সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটাতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যবসায় ভিত্তিক এবং ইঞ্জিনিয়ারিং-এই বিষয়গুলো প্রধান হয়ে উঠেছে। ফলে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি হচ্ছে না। আর শিশু সংগঠনগুলোকে আবার এমনভাবে গড়ে তোলা দরকার, যাতে তরুণরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে দেশকে নেতৃত্ব দিতে পারে।’
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হতে হলে শুধু পাঠ্যবইয়ের পড়াশোনা যথেষ্ট নয়। এজন্য খেলাধুলার পাশাপাশি সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা প্রয়োজন। তাদের চাওয়া, পড়াশোনার চাপ আর মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে শিশুদের সোনালী শৈশব যেনো হারিয়ে না যায়।