১.
বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি, কালচার ও বাঙালিত্বের ইতিহাস অন্য যে কোন দেশের তুলনায় অনন্য। আমাদের সংস্কৃতির ইতিহাস এতটাই সমৃদ্ধ যে কারোর সংস্কৃতির উপাদান ধার করার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ, সাংস্কৃতিক উপাদানের সমষ্টিগত বৈচিত্র্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। দরকার শুধু সে সব উপাদানের চর্চা করা এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে বিকশিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের কি করতে হবে? আমাদের এমন সব উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যার ভিত্তিতে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও তার গতিধারাকে প্রবাহমান রাখা যায়। সরকারি, বেসরকারি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগেও সংস্কৃতির উপাদানগুলোর বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
২.
আমার বাবা মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতেন, অভিনয়ের কৌশল ও পরিপক্বতায় মুগ্ধ ছিলাম আমরা পরিবারের সকলেই। আব্বার কোন নাটক আমরা সহজে মিস করতে চাইতাম না। সেই সময়টায় আমাদের গ্রামে মঞ্চ নাটক দেখতে হাজার হাজার লোকের সমাগম হতো। সচরাচর খেলার মাঠে মঞ্চ নাটকের আয়োজন হতো এবং মাঠগুলো দর্শকে পরিপূর্ণ হয়ে যেতো। আমি দেখেছি, গ্রামীণ সমাজে যখনই কোন ধরনের অসঙ্গতি কিংবা বিশৃঙ্খলা দেখা যেত কিংবা সমাজের মানুষের নিজেদের মধ্যে কোনরূপ সমস্যা দেখা যেত ঠিক তখনি নাটক সংগঠনগুলো মঞ্চ নাটকের আয়োজন করে সবাইকে সচেতন ও সুপরামর্শ দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাতেন নাটকে যুতসই পরিবেশনার মাধ্যমে। তবে স্রোতের বহমান ধারায় গ্রামীণ লোকজ সমাজে অশ্লীল যাত্রা পালা, গান ও নৃত্য পরিবেশনার অপসংস্কৃতির ধরুন সুস্থ ও মঞ্চ নাটক আজ বিলীনের পথে। যদিও গ্রামীণ সমাজে এখনো বেশ কিছু নাটক সংশ্লিষ্ট সংগঠন রয়েছে তথাপি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নিজেদের মেলে ধরতে পারছে না। অবশ্য সুস্থ নাটকের মঞ্চায়ন আজ খুবই প্রয়োজন পারিবারিক বিনোদন ও সম্প্রীতির স্বার্থে।
৩.
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় আমিও একটি নাটক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম। অভিনয় করেছি বেশ কয়েকটি পথ নাটকে ও মঞ্চ নাটকে। এখনো মনে আছে, পথ নাটকের মঞ্চায়নে আমরা কত কৌশল অবলম্বন করেছি দর্শক শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য। পথ নাটকগুলোতে বিভিন্ন গান, পুঁথি ও আবৃত্তি উচ্চস্বরে পরিবেশন করে ঢোল তবলা বাজিয়ে সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা হতো। মঞ্চ নাটকেও ছিল অভিনয়ের গভীরতা ও পারঙ্গমতা, দর্শকদের মনোযোগী আচরণ অভিনেতা/অভিনেত্রীদের উৎসাহ দিতো বিপুল পরিমাণে। আমরা আমাদের সংগঠনের মাধ্যমে বিখ্যাত নাটকগুলো পরিবেশনের চেষ্টা করেছি যেখানে ঐতিহাসিক কোন ঘটনা তথা বাংলাদেশের ইতিহাসকে তোলে আনা হতো। সে সব নাটকগুলোতে কোন অশ্লীলতার ছোঁয়া ছিলো না এবং অভিনয়েও থাকতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা। আমরা দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম বর্ষের ছাত্র/ছাত্রী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল ইয়ারে পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তি পেতো নাটক দেখে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে বসবাসকারী পরিবারগুলো সপরিবারে নাটক উপভোগ করতে মঞ্চের সামনে ভিড় জমাতো। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো দিনে দিনে কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত, বিষয়টি সাংস্কৃতিক উপাদান বিকাশের অন্তরায়।
৪.
বাংলা চলচ্চিত্র আমাদের বাঙালির সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাছাড়া আমাদের চলচ্চিত্রের ইতিহাস বেশ সুসংহত ও ঐতিহাসিক। কালজয়ী অনেক চলচ্চিত্রই রয়েছে আমাদের বাঙালির ইতিহাসে। সে সব কালজয়ী ছবিগুলোই আমাদের চলচ্চিত্রের সুদিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। একটা সময় আমাদের জেলা শহরগুলোতে এমনকি উপজেলা শহরেও সিনেমা হলগুলোতে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যেত। পরিবারের সবাইকে নিয়ে সিনেমা উপভোগ করার মানসে সাপ্তাহিক ছুটির দিনের জন্য সকলের অপেক্ষা ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু বর্তমানে চলচ্চিত্রের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক, সংকটাপন্ন। সিনেমার সাথে সংশ্লিষ্ট কলাকুশলীরা সিনেমা শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার কথা জানাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। মানসম্পন্ন সিনেমা তৈরি হচ্ছে না, প্রতিষ্ঠিত প্রযোজকরা সিনেমায় লগ্নি করতে সাহস পাচ্ছেন না। কেননা, জনপ্রিয় ও মানসম্পন্ন অভিনেতা অভিনেত্রীর সংকট রয়েছে চলচ্চিত্র শিল্পে। তাছাড়া অশ্লীলতার অভিযোগে পুরো এক দশক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অন্ধকার যুগের প্রভাবে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। এক কথায় বলতে, সপরিবারে সিনেমা দেখার মতো ছবি খুব কমই তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি অশ্লীলতার প্রভাবে দিন দিন বাংলাদেশে সিনেমা হলের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বেকার হয়ে যাচ্ছে সিনেমা শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই।
৫.
পারিবারিকভাবে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার পরিবেশ নষ্ট হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষ বিনোদনের খোরাক হিসেবে বাংলা নাটকের উপর নির্ভর করে থাকে। টিভিতে বাংলা নাটকের ব্যাপক প্রচারণা ও দর্শকরা উৎসাহী হওয়ায় পারিবারিক অনুষ্ঠান হিসেবে বাংলা নাটক ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। বিষয়টা অত্যন্ত ইতিবাচক ছিলো কারণ বিনোদনের জন্য পারিবারিকভাবে যে সুস্থ ও সাবলীল পরিবেশ প্রয়োজন তা কেবলমাত্র বাংলা নাটকেই বিদ্যমান। বিদেশী সিরিয়ালে আসক্ত অনেককেই আমি দেখেছি বাংলা নাটকের প্রতি তাদের আসক্ততা। পারিবারিকভাবে ঈদ কিংবা যে কোন উৎসবে বাংলা নাটকেই ছিল তাদের ভরসা। কেননা, একটি পরিবারের সব দর্শকই বিদেশী সিরিয়ালে আসক্ত নয় কিন্তু তারা সকলেই বাংলা নাটকের খুব ভক্ত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে ইদানীং বেশ কিছু তৈরিকৃত নাটকে যে ধরনের শ্রীহীন উক্তি এবং অঙ্গভঙ্গির প্রদর্শন দেখেছি তাতে পারিবারিকভাবে উপভোগের জন্য কতিপয় নাটক কাঠগড়ায় দাঁড়াবে নিঃসন্দেহে। তবে ভাল নাটক যে হচ্ছে না তা বলা যাবে না, সম্প্রতি তৈরিকৃত বেশ কিছু নাটক দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণ করেছে এবং সাধুবাদও অর্জন করেছে।
তবে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও শ্রীহীন কথোপকথন নাটকের দর্শক শ্রেণি হারাবে অচিরেই। কারণ, বাংলা সিনেমার ভক্ত, দর্শক, শ্রোতা ছিল উল্লেখ করার মতো কিন্তু বর্তমানে মোটামুটি অর্থে সেটি শূন্যের কোঠায়। কারণ, অশ্লীল সিনেমা নির্মাণ এবং মানহীন গল্পের কারণে দর্শক হারিয়েছে বাংলা সিনেমা। বর্তমানে বেশ কয়েকটি নাটকে যেভাবে ভাষা ও শারীরিক অঙ্গভঙ্গি দেখানো হয়েছে এভাবে চলতে থাকলে বাংলা সিনেমার ন্যায় বাংলা নাটকও একদিন দর্শকশূন্য হয়ে পড়বে। আমরা চাই না, বাংলা নাটক দর্শকশূন্য হয়ে যাক।
৬.
কাজেই বাংলা টিভি নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা, অভিনেত্রী ও সংশ্লিষ্ট সকলকে নাটকের ব্যাপারে আরো সতর্ক ও দায়িত্বশীল হতে হবে। অন্যথায় বাংলা নাটকের দর্শক সংখ্যা কমে আসবে নিমিষেই। পাশাপাশি বাঙালির সংস্কৃতিগত ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কারণ, আমাদের সংস্কৃতির উপাদানগুলো ছেলেমেয়েদের নানা রকম অপকর্ম ও অনাচার থেকে সহজেই রক্ষা করতে পারে। সুতরাং সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সকলের উদ্যোগে বাংলা সংস্কৃতির পতাকার স্লোগানকে জাগরূক রাখতে হবে বাংলাদেশে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)