বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এর আগে অন্তত তিনবার দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে আলোচনা কিংবা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে দু’বার হয়েছে বিদেশিদের মধ্যস্থতায়। সেই সংলাপগুলো সফল না হলেও সব পক্ষ এবারের সংলাপের ধারা অব্যাহত রাখলে সফলতা আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
১৯৯৪, ২০০৬ এবং ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে সংলাপ হয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালে জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারি মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় হয় আলোচনা। কিন্তু সবশেষে দেখা গেছে ‘যেই লাউ সেই কদু’। উভয়পক্ষ তাদের দাবিতে অনড় থাকায় শেষ পর্যন্ত কোন সমাধান ছাড়াই শেষ হয়েছে সংলাপ। তৈরি হয়েছে আন্দোলন, সহিংসতা, নৈরাজ্য। মানুষ পড়েছে অনিশ্চয়তায়, পড়েছে দুর্ভোগে।
এবার সংলাপের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ পেয়ে আশা পায় ঐক্যফ্রন্ট, একই ঘটনায় উজ্জীবিত হয় বিএনপি। কিন্তু এরই মধ্যে উচ্চ আদালত থেকে রায় আসে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে। পরপর দুটি মামলায় সাজা হয় খালেদা জিয়ার। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় ৭ বছর এবং জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার সাজা ৫ বছর বাড়িয়ে ১০ বছর করেন উচ্চ আদালত।
এরপর নিমিষেই সমস্ত আশা ধুলোয় মিশে যায় বিএনপির। স্তম্ভিত, বিস্মিত ও হতাশায় মুহ্যমান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংলাপ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলেন: বেগম খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধির ফলে সংলাপ ফলপ্রসু হওয়া নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হলো। সরকার বিএনপিকে ধ্বংস করার পায়তারা চালাচ্ছে। সে জন্যেই সরকার খালেদা জিয়াকে আবারও সাত বছরের সাজা দিয়েছে। প্রতিদিন গড়ে দেড়শ বিএনপি নেতাকে গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। সরকার এভাবে দমনপীড়ন বন্ধের আশ্বাস ও তা বাস্তবায়ন না করলে সংলাপও সম্ভব নয় এবং তা ফলপ্রসু হবে না।’
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নাও এতে করে সংলাপ ফলপ্রসু হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। কেননা, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যে ৭ দফা দাবি জানিয়ে আসছে তার প্রথম দাবিতেই রয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি।
এভাবে সংলাপ শুরুর আগেই সংলাপ ফলপ্রসু হওয়া নিয়ে এক পক্ষের সংশয় এবং তার বক্তব্যে সংলাপের সাফল্য সম্পর্কে পূর্ব অনুমান কী?
অতীতে কোনো সংলাপ সাফল্যের মুখ দেখেনি। আওয়ামী লীগ-ঐক্যফ্রন্টের সংলাপ কতোটা সফল হতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তুনু মজুমদার চ্যানেল আই অনলাইন-কে বলেন: ‘প্রথমেই বলি, আজ যে ঘটনা ঘটবে বলে আমরা আশা করছি সেখানে সমাধানের জন্য আকুল হওয়ার কিছু নেই। বরং দেখা উচিত এভাবে যে, একটি ‘এভিনিউ ওপেন’ হচ্ছে।
প্রথম বৈঠকই সফল হয়ে যাবে এমন কিছু না। কারণ, ব্যাপারটি মনে রাখবেন যে, এটা নিছক আওয়ামী লীগ বা ঐক্যফ্রন্ট সে বিষয় নয়। এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল গণতান্ত্রিক রূপ সম্পন্ন নয়। চারটি দলের মধ্যে দুটির জন্ম বৃত্তান্ত অগণতান্ত্রিক। একটি সরাসরি যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত এবং অন্য আরেকটি ক্রমাগতভাবে গণতন্ত্রের ব্যাপারে প্রশ্নযোগ্য কিছু কর্মকাণ্ড করছে। সেখানে প্রথম মিটিংয়েই সবকিছু মিটে যাবে এটা আশা করা আমার মনে হয় না সমীচীন হবে। তাই এই জায়গায় আমি দেখতে চাই যে, সমাধান হবে না। হওয়ার কথা না। হওয়ার তেমন কোনো কারণ দেখি না।’
‘আরেকটি ব্যাপার হল, সংকট বলে যে কথাটি, সেটা তো বিরোধীদল বলছে। সরকারি দল তো সেভাবে কোনো সংকটের কথা বলছে না। আর ঐকফ্রন্টের যে ৭টি দাবি, তার মধ্যে আমার মনে হয় না যে, কালকের বৈঠকে প্রধান কয়েকটি দাবির ব্যাপারে এটুকু কোনো সুরাহা হবে। এই জায়গা থেকে এখানে আমি আশাবাদ এবং নৈরাশ্যও ব্যবহার করবো না। আমি বলবো যে, নির্বাচনে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে যদি কোনো এভিনিউ তৈরি হয়। এটাই আমার মনে হয় পাওয়া।’
পূর্বের সংলাপের পরেও দেখা গেছে সহিংসতা। এবারও যদি কোনো সমাধানে আসা না যায় তাহলে আরেকটি সহিংসতার আশঙ্কা থেকে যায় কিনা না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন: ‘সেটা বলবার জন্য আরো মনে হয় একটু সময় লাগবে। এখনই বলা যাবে না। কারণ হলো, ২০১৪ সালে যে সহিংসতা হয়েছিলো তা নির্বাচনী সহিংসতাই শুধু ছিলো না। এই সহিংসতা শুরু হয়েছিলো ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যেদিন থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আদালতের রায় আসা শুরু হলো।
২০১৩ সালে সহিংসতা শুরু হয়ে ২০১৪ সালের শুরুর দিকে এসে চূড়ান্ত রূপ নেয়। কাজেই এটি শুধু নির্বাচনী সহিংসতা নয়। এটা ছিলো মতাদর্শিক সহিংসতা। সেখানে দুটি মতাদর্শ – বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, কিংবা দ্বিজাতিতত্ত্বের সাথে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বিষয়টি এরকম ছিলো। এটি যতক্ষণ না আমরা স্বীকার করবো ততোক্ষণ পযন্ত আমরা শুধু আকুলতাই প্রকাশ করতে পারবো। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হবে না। সেজন্য আমি খুব একটা আশা-নৈরাশ্য কিছু ব্যক্ত করছি না।’
অধ্যাপক শান্তনু বলেন: ‘আমি শুধু দেখতে চাই যে, কোনো একটি এভিনিউ ওপেন হয় কিনা এবং এটাকে আমি সংকট বলতে চাচ্ছি না। এটাকে আমি মতানৈক্য বলতে চাচ্ছি। মতানৈক্য যেটা ঘটেছে, সেটাকে কিছুটা করার মতো দূরতম রেখা যদি দেখা যায়, সেটাকে ধরে নিতে পারেন যে লাভ হলা।
সংলাপ কতোটা সফল হবে বা ফলপ্রসু হবে এমন বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন অর রশিদ চ্যানেল আই অনলাইনে-র কাছে তার মতামত ব্যক্ত করে বলেন: ‘সংলাপ হলো বিরোধী ও সরকারি দলের মধ্যে একটি সম্পর্ক তৈরির মাধ্যম। তবে সংবিধানের ভেতর থেকেই সমাধানগুলো খুঁজে বের করতে হবে। এখন যদি কোনো পক্ষ সংবিধানের বাইরে গিয়ে সমাধান খুঁজতে চায় তাহলে সেখানে তো স্বাভাবিকভাবে অসম্ভব। কেননা, সংবিধান সংশোধন করবে পার্লামেন্টে। কোনো ব্যক্তি সংবিধান সংশোধন করতে পারবে না।
এই ক্ষেত্রে যদি মুক্তমন নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য, অবাধ, নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষ্যে আলোচনা হয়, তাহলে আমি মনে করি সংলাপে সুফল বয়ে আনতে পারে। আর যদি আলোচনা ‘ তাল গাছ আমার’ এটা নিয়ে এগোতে থাকে, স্বাভাবিকভাবেই ঐ জায়গায় সমাধানের পথ দূরূহ হয়ে যায়।’
তিনি বলেন: ‘সংলাপে সুফল বয়ে আনবে বলে আমরা আশাবাদী। যেহেতু রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। তিনি উদার মনের। বাংলাদেশের রাজনীতি অথবা উন্নয়ন অগ্রগতি সব কিছু মিলিয়ে উনি একজন মহান নেত্রী। শুধু বাংলাদেশে নয়, সমস্ত বিশ্বে। তার উদারনৈতিক চিন্তা, চেতনা তার যে সরকারের নীতি এই উদারনীতিকে যদি বিরোধী দলগুলো গ্রহণ করতে পারে, তাহলে নিশ্চয় বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য একটি সুফল বয়ে আনবে। তবে সমাধান আসতে হবে সংবিধানের ভিত্তি। সংবিধান লঙ্ঘন করার ক্ষমতা কারো নাই।’
ঐক্যফ্রন্ট বা বিএনপি বলছে, সরকার একদিকে দমনপীড়ন চালাচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক রায় দিচ্ছে অন্যদিকে সংলাপের প্রস্তাব দিচ্ছে। এটি সরকারের দ্বিচারিত্রিক আচরণ। এতে সংলাপ ফলপ্রসু হবে কিনা তাদের সংশয় রয়েছে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক হারুন অর রশিদ বলেন: ‘মামলা-মোকাদ্দমা আদালতের বিষয়। বেগম খালেদা জিয়ার রায় হওয়া না হওয়া পুরোপুরি আদালতের উপর নির্ভর করছে। এটি সরকারের ব্যাপার নয়। সরকারের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। দাবি দাওয়া নিয়ে কথা হতে পারে। কিন্তু এখন যদি যারা সংলাপে আসবে বা ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে এমন সব দাবিনামা থাকে, যেটি সংবিধানের আওতায় পড়ে না। সেক্ষেত্রে তাদের সেই দাবি পরিহার করতে হবে। তবেই সম্ভব একটি সমাধান। মানুষের মাঝে যে সংলাপ নিয়ে একটি সুন্দর প্রত্যাশা এবং মানুষ যে একটি সহনশীল পরিবেশ চায় দেশে, সে আশা মানুষের পূরণ হবে।’
এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন: ‘সবাইকে প্রতিহিংসার রাজনীতি ছেড়ে দিতে হবে। বিরোধী যে ফ্রন্ট রয়েছে তাদের ভেতরে কিছু কিছু দল আছে যেমন প্রতিহিংসার রাজনীতি, সন্ত্রাসের রাজনীতি করে জঙ্গিবাদী রাজনীতি করে। তারা যদি এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে তাহলে সুন্দর সমাধান হবে। মূল সমস্যা তো রাষ্ট্রের জন্য এগুলোই। এখানে জঙ্গিবাদ তৈরি করা হয়েছে। সহিংস রাজনীতি, পেট্রোল বোমার রাজনীতি, আগুন সন্ত্রাসের রাজনীতি থেকে যদি তারা বেরিয়ে আসতে পারে তাহলে অনেক কিছুই এই দেশে সমাধান সম্ভব।’