গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যম যদি ঠিকমত কাজ করতে পারে, তাহলে রাষ্ট্রের অন্য তিনটি স্তম্ভ (শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ) ঠিক থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামকে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সাজা দেয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জের রিট শুনানিতে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের সমন্বয়ে গঠিত অবকাশকালীন হাইকোর্ট বেঞ্চ সোমবার এ মন্তব্য করেন।
আজ আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন ও আইনজীবী ইশরাত হাসান। আর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল দেবাশিস ভট্টাচার্য্য।
এর আগে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে দেওয়া মোবাইল কোর্টের সাজার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রোববার বাংলা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক হারুন-অর-রশীদ জনস্বার্থমূলক রিট করেন। সে রিটে আরিফুলের জন্য ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়। এই রিটের শুনানি নিয়ে রোববার বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের সমন্বয়ে গঠিত অবকাশকালীন হাইকোর্ট বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষকে কয়েকটি বিষয় সোমবার জানাতে বলেন। বিষয়গুলো হলো:
১) অভিযান কারা পরিচালনা করেছে মোবাইল কোর্ট নাকি টাস্কফোর্স?
২) অভিযান পরিচালনার কারণ?
৩) রাতে অভিযান পরিচালনার বিষয়ে আইন অনুসারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিনা?
এছাড়া আরিফুল ইসলামকে দেওয়া সাজার আদেশটি দেখতে চান হাইকোর্ট।
গতকালের দেয়া আদেশ অনুযায়ী আজ শুনানির শুরুতেই রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল দেবাশিস ভট্টাচার্য হাইকোর্টকে জানান, ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে এক অভিযোগের ভিত্তিতেই ১৩ জনের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দুইজন সাক্ষি ও অন্যান্য মানুষের উপস্থিতিতে আরিফুলকে সাজা দেন। আর এসবকিছু আইন অনুসারে করা হয়।’
এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ভ্রাম্যমাণ আদালতের দেয়া সাজার আদেশ হাইকোর্টকে জানিয়ে বলেন, ‘মদ ও গাজা সেবনরত অবস্থান আরিফুলকে ধরা হয় এবং সে দোষ স্বীকার করেন। এরপর অপরাধ আমলে গ্রহণ করে ১০০ গ্রাম গাজা এবং ৪৫০ গ্রাম ইথাইল (বাংলা মদ) জব্দ করা হয় এবং আরিফুলকে ১ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরো ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেয়া হয়।’
তবে রিটের পক্ষের আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন আদালতকে বলেন: ‘ওই সাংবাদিক যদি তার রিপোর্ট ভুল করে থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে মানহানীর মামলা দেওয়া যেত, অথবা অন্যান্য আইনে মামলা করা যেত। কিন্তু সেখানে তা, না করে বাড়ি থেকে গভীর রাতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ক্ষমতা আছে বলে কোনো নাগরিককে রাতের বেলা ধরে এনে এভাবে সাজা দেওয়া যায় না। এটা ক্ষমতার অপব্যবহার। এমনকি ওইদিন আশপাশের আর কোনো বাড়িতে তল্লাশী করা হয়নি। এতে প্রমাণ হয় ওই অভিযান ও মোবাইল কোর্ট উদ্দেশ্যে প্রণোদিতভাবে পরিচালনা করা হয়েছে।’
এসময় আদালত বলেন: ‘আপনাদের বক্তব্য তো শুনলাম। তবে এক্ষেত্রে মূল হচ্ছে, সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম যেন ন্যায় বিচার পান সেটি। তবে এটা বলতে হবে যে, এক্ষেত্রে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর পদক্ষেপটি ভাল লেগেছে।’
তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আদালতকে বলেন: ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে। এবং অন্যদিকে গতকাল আরিফুলকে জামিন দেয়া হয়েছে।’
এরপর হাইকোর্ট জানতে চান যে, আরিফুলের জামিন কিভাবে হয়েছে? তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আদালতকে জানান, ওই সাজার বিরুদ্ধে আপিল করে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে জামিন নিয়েছেন। এসময় আদালত বলেন, পত্রপত্রিকায় লেখা দেখলাম আরিফুলের পরিবার থেকে জামিন আবেদনের আগেই নাকি জামিন হয়েছে?’
এসময় রিটের পক্ষের আইনজীবী আমিন উদ্দিন আদালতকে বলেন: ‘মাই লর্ড, আপনারা মামলার নথিটা তলব করে সবকিছু দেখতে পারেন।’
এরপর আদালত আরিফের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্টের দেয়া মামলা ও সাজা সংক্রান্ত সকল নথি আগামী ২৩ মার্চের মধ্যে হাইকোর্টে দাখিলের নির্দেশ দেন। এবং এবিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য ২৩ মার্চ দিন ধার্য করেন।
এদিকে সাংবাদিক আরিফুলের সাথে ঘটা ঘটনার বিষয়ে তার স্ত্রী মোস্তারিমা সরদার নিতু বিবিসিকে বলেন: ‘শুক্রবার গভীর রাতে অনেক লোকজন এসে আমাদের বাসার দরজা খুলে দিতে বলে। একপর্যায়ে ওনারা ধাক্কা দিয়ে দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে সাত আটজন মিলে আমার স্বামীকে মারতে শুরু করে। তাদের হাতে রাইফেল, পিস্তল সবই ছিল। তখন তারা বারবার বলছিল, কয়দিন ধরে খুব জ্বালাচ্ছিস। গুলি করে দেবো। বলে আরো মারে। ওর গায়ে কোন কাপড় ছিল না। আশেপাশের বাড়ির কাউকে সামনে এগোতে দেয়নি। সারা রাস্তা মারতে মারতে নিয়ে গেছে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তাও বলেনি। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরে জানা গেল, আমার স্বামীকে নাকি মাদকের মামলায় এক বছরের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’
সাংবাদিক আরিফুলের সহকর্মীরা গণমাধ্যমকে বলছেন: ‘কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক ও প্রশাসনের অনিয়মের বিরুদ্ধে আরিফুল বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। যার মধ্যে একটি ছিল কাবিখার টাকায় একটি পুকুর সংস্কার করে জেলা প্রশাসক কর্তৃক নিজের নামেই নামকরণ করা। সে কারণেই হয়ত প্রতিশোধমূলকভাবে গভীর রাতে দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে আরিফুলকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং কোন রকম তল্লাশি না চালিয়েই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নেয়ার পর আধা বোতল মদ আর দেড়শ গ্রাম গাজা উদ্ধারের গল্প সাজিয়ে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে আরিফুলকে সাজা দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়।’
তবে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন এ বিষয়ে বিবিসিকে বলেছেন: ‘সেটা তো একবছর আগের কথা। আর সেখানে সে স্যরি বলেছে বলে আমরা তো আর কিছুই বলি নাই। ওইটা যদি কোন বিষয় হতো, তাহলে তো তখনই আমরা কোন অ্যাকশনে যেতাম। এখন ওইটার সঙ্গে এইটা মিলাচ্ছে তারা।’