আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘সংবাদমাধ্যমকে সত্য এড়ানোর প্রবণতা বা নীরবতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ, মানুষের সত্য জানার পথ যেখানে বন্ধ হয়ে যায় ফেইক নিউজের পথচলা সেখান থেকেই শুরু হয়।’
শনিবার রাজধানীর কসমস সেন্টারে ‘‘ফেইক নিউজ অ্যান্ড হেট স্পিচ, কজেস অ্যান্ড কনসিকুয়েন্সেস: হাউ ইট সাবভার্টস আওয়ার ডেমোক্রেটিক সিস্টেমস’’ শীর্ষক আলোচনায় একথা বলেন তিনি।
আইনমন্ত্রী বলেন: ‘ফেইক নিউজ বা ভুয়া খবর বাংলাদেশে নতুন কোনো শব্দ বা ধারণা নয়। খবর ও ভুয়া খবর অনেকটা সত্য ও মিথ্যার মতোই সমান্তরালভাবে ব্যবহার হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীনতা বিরোধী গোষ্ঠী অনেক ফেইক নিউজ ছড়িয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান নিয়ে ফেইক নিউজ ছড়িয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে ফেইক নিউজ ছড়িয়েছিল। এমনকি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য তারা দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন প্রকৃতিতে অনেক ফেইক নিউজ ছড়িয়েছে।’
আইনমন্ত্রী আরো বলেন: ‘বিগত প্রায় দুই দশকে আমাদের গণমাধ্যমের প্রকৃতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ফেইক নিউজের প্রকৃতির পরিবর্তন হয়েছে। এখন শুধু ট্র্যাডিশনাল সংবাদ মাধ্যম নয় বরং অনলাইন সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া খবর, ইমেজ এবং ভিডিও বা হেট স্পিচ ছড়িয়ে পড়ছে। আর বড় উদ্বেগের বিষয় হলো বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির কণ্ঠস্বর নকল করে ভুয়া খবর তৈরি করে প্রচার করা হচ্ছে। আবার সুপ্রতিষ্ঠিত নামিদামি সংবাদ মাধ্যমগুলোর ওয়েবসাইট নকল করে তার মাধ্যমে ফেইক নিউজ ছড়ানো হচ্ছে। ফলে সাধারণ পাঠক এই সকল ফেইক নিউজ থেকে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কেউ কেউ এমন সব সংবাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন যার সাথে কোন সুপ্রতিষ্ঠিত সংবাদ প্রতিষ্ঠানের লোগো যুক্ত করা থাকে। এতে পাঠক বিভ্রান্ত হচ্ছেন এবং ধরনের বিভ্রান্তির ফলেই অনেক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক, জাতিগত, ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে দেশে-বিদেশে।’
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন: ‘আমাদের দেশে প্রধানত পাঁচটি উদ্দেশ্যে ফেইক নিউজ চর্চা করা হয়। ১) সাম্প্রদায়িক গুজব ছড়ানো ২) রাজনৈতিক-ধর্মীয় মিথ্যাচার প্রচার ৩) রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা ৪) জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং ৫) অবৈজ্ঞানিক জল্পনা-কল্পনা প্রচার করা।
তিনি বলেন: ফেইক নিউজের প্রভাব জনজীবনে কিভাবে পড়ে তার স্পষ্ট উদাহরণ আমরা দেখেছি ২০১২ সালে কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধপল্লীতে। ২০১৩ সালে পাবনার সাঁথিয়ার বনগ্রাম বাজারে এবং ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে কিভাবে ভয়াবহ হামলা চালিয়ে নিরীহ নিরপরাধ মানুষের বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছিল তা ভুলবার নয়। আর ২০১৮ সালে রাজনৈতিক হীন স্বার্থ হাসিলের জন্য কিভাবে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নামে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে ঢাকা শহরকে অচল করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল সেটাও আমাদের মনে আছে।’
আইনমন্ত্রী বলেন: ‘ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদি সাংবাদিকতা বহির্ভূত যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া খবর প্রচারের বড় বিপদের দিকটা হলো এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য অতি দ্রুত গতিতে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপদজনক হচ্ছে অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলো। যাদের অধিকাংশই তথ্যের সত্য-মিথ্যা খতিয়ে দেখে না। তাদের দ্বারা যে কোন চাঞ্চল্যকর ভুয়া খবর মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো সংবাদ মাধ্যমে। বাংলাদেশ সহ অনেক দেশের মূল ধারার সংবাদ মাধ্যম এখন সংবাদের প্রাথমিক উৎস হিসেবে ফেসবুক ও টুইটার ব্যবহার করে। কাজটা দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্বের সাথে করলে ঝুঁকির আশঙ্কা কম থাকে। কিন্তু অধিকাংশ অনলাইন সংবাদমাধ্যম তা করে না।’
আইনমন্ত্রী আরো বলেন, ‘ফেইক নিউজ এর প্রচার এবং প্রকাশ বন্ধে সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট প্রণয়ন, এবং গুজব প্রতিরোধ ও অব্যহতিকরন সেল গঠনের পাশাপাশি অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য রেজিস্ট্রেশনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ও অনলাইন নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। এছাড়া ফেইক নিউজ প্রচার ও প্রকাশ বন্ধে জন্য সরকারের আইসিটি ডিপার্টমেন্ট, বিটিআরসি, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। তবে সরকারের একার পক্ষে ফেইক নিউজ বন্ধের কাজ সফলভাবে করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে মূল ধারার গণমাধ্যমের ভূমিকা রয়েছে। মূল ধারার সংবাদমাধ্যমকে দ্রুত বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রস্তুত করে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে, যাতে পাঠক সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বারস্থ না হয়। আর সংবাদমাধ্যমকে সত্য এড়ানোর প্রবণতা বা নীরবতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষের সত্য জানার পথ যেখানে বন্ধ হয়ে যায় ফেইক নিউজের পথচলা সেখান থেকেই শুরু হয়।’
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন: ‘ফেইক নিউজ চিহ্নিতকরণের জন্য নতুন টেকনোলজি ডেভলপ করা উচিত। কারণ প্রযুক্তিকে প্রযুক্তি দিয়েই মোকাবেলা করা সমীচীন। তাছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া গুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে এবং যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে ফেইক নিউজ তৈরি করে প্রচার করে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে এবং তাদের অর্থের উৎস খুঁজে বের করতে হবে।’
কসমস ফাউন্ডেশন আয়োজিত এ আলোচনা অনুষ্ঠানে কসমস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইনায়েতুল্লাহ খান, সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্ট্যাডিসের (আইএসএএস) প্রধান গবেষক ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী, অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাকাউন্টিবিলিটি এন্ড ইন্টারনেট ডেমোক্রেসির প্রেসিডেন্ট ডান সেফট বক্তব্য রাখেন।