বিশ্বজুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের অন্যতম উদাহরণ রোহিঙ্গা সংকট। রাখাইন রাজ্যের অধিবাসীদের ওপর সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি মিয়ানমার সরকার অস্বীকার করলেও পুরো বিশ্ব এর সাক্ষী।
২৫ আগস্ট থেকে নতুন করে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর এ নির্যাতনকে জাতিসংঘ ‘পাঠ্যবইয়ে যোগ করার মতো জাতিগত নিধনের উদাহরণ’ বলেও অভিহিত করেছে অনেক আগেই। এবার জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ওসিএইচএ ইস্যুটিকে সংখ্যার সাহায্যে ব্যাখ্যা করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাদের ওয়েবসাইটে। যেখানে রোহিঙ্গা সংকটের ভয়াবহতা ফুটে উঠেছে তীব্রভাবে।
১৯৮২
এ বছর মিয়ানমার সরকার একটি নতুন আইন পাস করে, যে আইনে ১৩৫ টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে মিয়ানমারের ‘জাতীয় নৃগোষ্ঠী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। রাখাইন রাজ্যের অধিবাসী রোহিঙ্গা মুসলিমরা এই তালিকায় স্থান পায়নি। বর্তমানে এরা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠী। তাদের কোনো নাগরিকত্ব নেই।
রোহিঙ্গাদের জন্য সব ধরনের স্বাধীনতা এবং অধিকারের আন্দোলন নিষিদ্ধ। এমনকি রাখাইনে স্থানীয় স্কুল, হাসপাতাল বা বাজারেও প্রবেশাধিকার নেই তাদের।
২৫ আগস্ট, ২০১৭
রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর বহুদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতা সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালের আগস্টে গঠিত হয় অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ওই কমিশন এক বছরের তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের প্রধান অং সান সু চির কাছে জমা দেয় চলতি বছরের ২৪ আগস্ট।
৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তার পরদিনই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। সেনাবাহিনীর ওই হত্যাযজ্ঞে এ পর্যন্ত ৬ লাখেরও বেশি মানুষ পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
৮,০৯,০০০
এটি হচ্ছে জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী সেসব রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা, যারা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছে বা ইতোমধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে ৬ লাখ ৩ হাজার ইতোমধ্যে ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে সফল হয়েছে। তাদের বর্ণনা থেকেই প্রকাশ পেয়েছে রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমারে চলমান হত্যা, নির্যাতন, লুটপাট, ধর্ষণ ও সহিংসতার ভয়াবহ তথ্য।
২৮৮
কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত ২৮৮টি গ্রাম ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ধ্বংস করে দিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
৪৩ কোটি ৪০ লাখ
বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রায় ১২ লাখ মানুষকে প্রয়োজনীয় সরবরাহ দেয়ার জন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো এখন পর্যন্ত ৪৩ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার সহায়তা চেয়েছে। এদের মধ্যে শুধু রোহিঙ্গা শরণার্থী নয়, তাদের আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীও রয়েছে। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি তাদেরও জরুরি ত্রাণ এবং সুরক্ষা দরকার।
সহায়তার ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, আশ্রয়, খাদ্য এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে শিশুদের জন্য কাউন্সেলিং সেবা।
২৯ শতাংশ
কাঙ্ক্ষিত ৪৩ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারের মধ্য থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র ১৩ কোটি ডলার হাতে পেয়েছে ও সহযোগিতা সংস্থাগুলো, যা মোট চাহিদার ২৯ শতাংশ। দাতা সংস্থাগুলো গত ২৩ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে বাকি ৭৬ শতাংশ অর্থও সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এখন অপেক্ষা জরুরি ভিত্তিতে সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের।
১০,৩৩৩
গত ২৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এটি তাদের দৈনিক গড় সংখ্যা। এদের অধিকাংশই কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প এবং তার আশপাশে তৈরি অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে।
৭,০০,৪৮৭
কক্সবাজারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকার যৌথভাবে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত ৭ লাখেরও বেশি শরণার্থীকে কলেরা প্রতিষেধক ক্যাপসুল খাওয়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এই কর্মসূচি বর্তমানে চলমান আছে। এটি এখন পর্যন্ত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কলেরা টিকাদান কর্মসূচি।
৫,৩৬,০০০
এখন পর্যন্ত এই সংখ্যক মানুষের কাছে খাদ্য সহায়তা নিয়ে পৌঁছাতে পারার কথা জানিয়েছে ত্রাণ সংস্থাগুলো। যদিও বরাদ্দ স্বল্পতার কারণে এখন পর্যন্ত এই জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশই পেয়েছে আংশিক রেশন। খাদ্যদ্রব্য ছাড়াও বিশুদ্ধ খাবার পানি, পয়ঃনিষ্কাশন সেবা, ওষুধপত্র, অস্থায়ী আবাস তৈরির সরঞ্জাম এবং রান্না করার জিনিসপত্র সরবরাহ করছে ত্রাণ সংস্থাগুলো।