সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে সর্বোচ্চ আদালত এমন কিছু প্রশ্নের অবতারণা করেছেন, যেগুলো বছরের পর বছর ধরে সাধারণ মানুষের মনেই ছিল, কিন্তু সেসব প্রশ্ন তোলার কেউ সাহস করেননি। তবে দেশের রাজনীতি, সরকার, নির্বাচন, সংসদ সদস্যদের যোগ্যতা এবং তাদের মত প্রকাশ সম্পর্কিত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কে আপিল বিভাগ যেসব প্রশ্ন তুলেছেন, যেসব সংকট চিহ্নিত করেছেন, তার জন্য এককভাবে কাউকে দায়ী করার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের এখন যে রাজনৈতিক সংকট তার জন্য কেবল ত্রয়োদশ সংশোধনী তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল যেমন এককভাবে দায়ী নয়, তেমনি পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মূল চেতনা নস্যাৎ কিংবা অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে দেশকে ধর্মীয়করণও পুরোপুরি দায়ী নয়। অথবা চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েমকেও আজকের সংকটের জন্য এককভাবে দায়ী করা চলে না।
আমরা প্রায়ই দেখি, নানা ইস্যুতেই সরকার ও বিচার বিভাগ মুখোমুখি দাঁড়ায়। বিশেষ করে ২০১২ সালে আপিল বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে তার অপসারণের দাবি ওঠে সংসদে, এমনকি ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করার সুপারিশ করেন সংসদ সদস্যরা।
মূলত সেই ধারাবাহিকতায়ই ২০১৪ সালে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে ৯৬ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করা হয় এবং সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বদলে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হয় সংসদের ওপর। শুধু তাই নয়, এই বিধানের আলোকে একটি আইনের খসড়াও মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেয়। সেই আইন অনুযায়ী একজন বিচারকের অপসারণ বেশ জটিল হলেও বিচার বিভাগ মনে করেন, এর মাধ্যমে সরকার বিচার বিভাগের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়। যে কারণে বাতিল করা হয় ষোড়শ সংশোধনী।
এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক যে ভাষায় বিচারকদের সমালোচনা করেছেন, সেটি অভূতপূর্ব। মনে রাখা দরকার, প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন তিনিই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানসম্বলিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করেছিলেন এবং মনে করা হয় যে, দেশের বর্তমান সংকটের পেছনে এই রায়টি অনেকাংশে দায়ী। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর সরকার যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাও দেশের ইতিহাসে বিরল। আবার সংসদের বাইরে থাকা সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বিএনপি সম্ভবত এই রায়কে নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ হিসেবে দেখছে।
বাস্তবতা হলো, দেশের অনেক সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি কিংবা জিইয়ে রাখার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগও তার দায় এড়াতে পারেন না। অনেক অসাংবিধানিক সরকার বৈধতা পেয়েছে বিচার বিভাগের কারণে। আদালত যদি অসাংবিধানিক সরকারের পক্ষে না দাঁড়াতেন, তাহলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে বাংলাদেশের চেহারাটা অন্যরকম হতে পারতো। সুতরাং এককভাবে কাউকে দায়ী করার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গই রাজনৈতিক সংকটে নিজেদের দায় এড়াতে পারে না। বরং এর জন্য সম্মিলিতভাবে দায় আছে ক্ষমতাসীন, অতীতে ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যেতে না পারা রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, সিভিল সমাজ এমনকি সাধারণ নাগরিকদেরও।
সংবিধানের ৭ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ কিন্তু সমস্যা হলো জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ করতে গিয়ে সংসদ সদস্যরা এমন সব কর্মকাণ্ড করেন যার দায় জনগণের নয়। কিন্তু সংসদ মনে করে তারা যেকোন আইন করার এখতিয়ার রাখে এবং তারা সার্বভৌম। অর্থাৎ জনগণের মালিকানার প্রশ্নটি খুবই গোলমেলে। জনগণের ভোট পেয়ে অথবা না পেয়ে অনেক সময় বিতর্কিত, অসৎ এবং অযোগ্য লোকেরা সংসদ সদস্য হয়ে থাকেন এবং জনগণের পক্ষে তথাকথিত ক্ষমতার প্রয়োগ করেন। সেই সংসদ সদস্যদের কর্মকাণ্ডে নাগরিকরা ক্ষুব্ধ হলে তাকে রিকল করা অর্থাৎ তাকে বাদ দিয়ে নতুন কাউকে নির্বাচিত করার বিধান নেই। অর্থাৎ রাষ্ট্রের কথিত মালিক জনগণ এমন লোকদের নির্বাচিত করে আইনসভায় পাঠায়, যাদের একটা বড় অংশেরই আইন-কানুন সম্বন্ধে ভালো ধারণা থাকে না এবং তারা যথেষ্ট গণবিরোধী হলেও ৫ বছরের আগে সাংবিধানিকভাবেই তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার কোনো ক্ষমতা জনগণের নেই। যদিও জনগণই নাকি সকল ক্ষমতার মালিক।
সংবিধান নাগরিকের যেসব অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে তার অনেকগুলোই প্রচলিত অন্যান্য আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। এর একটা বড় কারণ এখনও আমরা ব্রিটিশ আইনের লিগ্যাসি বহন করে চলেছি। পুলিশিং এবং বিচার ব্যবস্থা চলছে ব্রিটিশ আইন দিয়ে। সময়ে সময়ে সেখানে কিছু সংশোধন আনা হলেও বাংলাদেশের উপযোগী করে সাধারণ মানুষের অধিকার ও ন্যায়বিচারকে প্রধান বিবেচ্য রেখে একটি জনবান্ধব পুলিশ আইন বা বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলা এখনও সম্ভব হয়নি। ফলে সংবিধান যতই বলুক যে, আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান এবং ন্যায়বিচার লাভের অধিকারী-বাস্তবে আইনের বিবিধ মারপ্যাঁচে সেটি সম্ভব হয় না।
দেশের যে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক সংকট-সেখানে কেবল সংবিধানের ভাষাগত দুর্বোধ্যতা, ধোঁয়াশা কিংবা বিভিন্ন সংশোধনীই দায়ী নয়, বরং বাংলাদেশের উপযোগী গণতান্ত্রিক এবং জনাবন্ধব আইন প্রণয়নে ব্যর্থতাও বহুলাংশে দায়ী। আমরা যখন ষোড়শ সংশোধনী বাতিল কিংবা বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে থাকা না থাকা নিয়ে তর্কে লিপ্ত-তখন আমরা বেমালুম ভুলে যাচ্ছি আমাদের মাথার উপরে ঝুলছে ব্রিটিশ আমলের শত শত আইন।
বিচারকদের বিচার কে করবেন কিংবা আদৌ কোনো বিচারকের অপসারণ প্রয়োজন হবে কি না-এ মুহূর্তে তার চেয়ে অনেক বড় প্রশ্ন, আমরা আমাদের আইনগুলোকে জনবান্ধব করার ক্ষেত্রে কী প্রস্তুতি নিচ্ছি বা আদৌ এ বিষয়ে আমাদের ভাবনা-চিন্তা আছে কি না? সেই সাথে এটিও আমাদের বিবেচনায় রাখা দরকার হবে যে, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে সংবিধান আমরা পেয়েছি, সেটি কতটা গণতান্ত্রিক? ক্ষমতাসীনরা বিভিন্ন সময়ে সংবিধানে তাদের প্রয়োজনমতো এবং নিজেদের স্বার্থে সংশোধনী আনলেও একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের পথে এ যাবত কেউ হাঁটেননি। ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে যখন আমরা আলোচনা আর তর্কে মুখর– তখন এই বিষয়গুলোও আমাদের সামনে নিয়ে আসা জরুরী।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)