সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের পঞ্চম দিনের শুনানিতে সাংবিধানিক ও বিচারবিভাগীয় যুক্তি তর্ক উপস্থাপন হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে মঙ্গলবার এই যুক্তি তর্ক উপস্থাপন হয়।
শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, অধস্তন বিচার বিভাগ (লোয়ার জুডিসিয়ারি) কব্জা করে নিয়ে নিচ্ছেন। এখন চাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টকে নিয়ে নিতে। অধস্তন আদালতের ৮০ ভাগ বিচারকের ওপর কার্যত সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণ নেই। সুপ্রিম কোর্ট, অধস্তন আদালত পঙ্গু হয়ে গেছে। এখন উচ্চ আদালতের বিষয়টি সংসদে হাতে গেলো। তাহলে আর কি থাকলো?
সংবিধান সংশোধন প্রসঙ্গে তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমেরিকার সংবিধান কতবার টাচ হয়েছে জানেন?
জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিচার বিভাগ তখনই অকার্যকর হয়ে পড়বে যখন দেশে অরাজকর পরিস্থিতির সৃস্টি হবে। কিন্তু এখনও সে পর্যায়ে নেই দেশ। আমেরিকার মূল সংবিধান পরিবর্তন করা হয়নি, সংযুক্ত হয়েছে। আমাদেরও দোষ আছে। আমরা মূল সংবিধান সংশোধন করেছি। তা না করে সংযুক্ত করা যেতো।
প্রধান বিচারপতির কথার আপত্তি তুলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, বিচার বিভাগ বলতে পারে না যে মূল সংবিধানের এই ব্যবস্থা ঠিক না। শুধুমাত্র সংশোধনী সম্পর্কে বলতে পারে। এ মামলায় (ষোড়শ সংশোধনী মামলা-যেটির শুনানি চলছে) হাইকোর্টের রায়ে কিছু মন্তব্য রূঢ় হয়ে গেছে। আশা করি এগুলো বাদ দেবেন।
প্রধান বিচারপতি তখন বলেন, সব সময় সংবিধান বাঁচিয়ে রেখেই রায় দেওয়া হয়। প্রত্যেকটি বাক্য, সেমিকোলনের ব্যপারে বিচারকদের সঙ্গে আলোচনা করেই রায় দেই।
তিনি আরো বলেন, আমরা সংবিধান মাথায় রেখেই রায় দেবো। আপত্তিকর কিছু থাকলে সেটা বিবেচনা করা হবে। একটি গণতান্ত্রিক সভ্য দেশে, একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের অনেক কিছু চিন্তা করে রায় দিতে হয়। মানবাধিকার, সংবিধান, আইনের শাসন এসব কিছু বিবেচনায় নিতে হয়।
“আমরা বিচারকরা চিন্তাভাবনা করি, রাষ্ট্রের কাজের যেন ব্যাঘাত না ঘটে। মন্ত্রী সাহেবরা অনেক কথা বলেন। যা আমরা হজম করছি, করতে পারি। আমি প্রধান বিচারপতি হিসেবে যা বলি তা বিচার বিভাগের জন্যই বলি। আইনমন্ত্রী বলে থাকেন যে বিচার বিভাগ স্বাধীন। বিচারকদের বেতন বেড়েছে। বেতন বাড়লেই কি বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে যায়?”
এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ১৯৭২ এর মূল চেতনায় ফিরে যেতেই সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী আনা হয়েছে। দেশের স্বার্থে ১৬তম সংশোধনী আনা হয়েছে।
সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমাদের সংবিধান অনুযায়ী জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক। ৭ অনুচ্ছেদের চেতনা পুনর্বহালের জন্যই ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়েছে। সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাছাড়া বিষয়টি এমন না যে সংসদ সদস্যরা হাত তুললেই বিচারপতি অপসারিত হয়ে যাবেন। এবিষয়ে আইনে পুরো প্রক্রিয়া বলা আছে। সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।
এসময় প্রধান বিচারপতি বলেন, এ আইন কয়দিন পরওতো সংশোধন হতে পারে। তাছাড়া এ মামলা (ষোড়শ সংশোধনী মামলা) বিচারাধীন থাকাবস্থায় আপনারা তাড়াহুড়ো করে আইনের খসড়া করেছেন। প্রধান বিচারপতি আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে আইন না করার জন্য বললেন। কিন্তু তা মানলেন না। এখানে তাড়াহুড়োর কি ছিল? সুপ্রিম কোর্টতো সরকারকে শেষ করে দিচ্ছে না।
তিনি বলেন, দেশের আর্থ সামজিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭২ সালের চিন্তা-চেতনা থেকে ২০১৭ সালের চিন্তা চেতনার অনেক পার্থক্য থাকবে। পিছনে থাকলে চলবে না। সামনের দিকে তাকাতে হবে। সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানও পরিবর্তন হবে।
প্রধান বিচাপরতি বলেন, সামরিক আইনের কলঙ্ক মুছে ফেলতে একমাত্র বিচার বিভাগ ভূমিকা রেখেছে।
এসময় আদালতে উপস্থিত অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা দাঁড়িয়ে বলেন, একজন প্রধান বিচারপতিও শপথ ভঙ্গ করে সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন। সংবিধান স্থগিত করেছিলেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ওই সময়তো অনেক কিছুই হয়েছে। যা এখন আপনারাও সংরক্ষণ করছেন। এরপর এক পর্যায়ে প্রধান বিচাপরতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ রেখেছেন কেন?
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এর একটি ইতিহাস আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হর্স ট্রেডিং হচ্ছে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, তাদের (সংসদ সদস্য) প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না? তাহলে বিচারকদের ক্ষেত্রে হর্স ট্রেডিং হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? সংসদ সদস্যরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন কিনা। আপনারা নিজ দলের সদস্যদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না কেন?
এরপর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের রিট করার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তাদের রিট করার এখতিয়ার নেই।
এসময় আপিল বেঞ্চের বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, এ যুক্তি ঠিক না। যারা এসেছেন (এ মামলার রিটকারী আইনজীবী) তারা অপরিচিত আইনজীবী। তারা এ বারেরই (আইনজীবী সমিতি) সদস্য। বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে তারা এটা করতেই পারেন। এটা কি দোষ হয়ে গেল?
প্রধান বিচাপরতি বলেন, তারা এই সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। তারা সচেতন নাগরিক। তাদের রিট করার এখতিয়ার আছে। আপনি বলছেন, তাদের এখতিয়ার নেই। তাহলে কি আমি নিজে রিট করবো?
এসময় তিনি ভারতের বিচারক নিয়োগ সংক্রান্তে এক রায়ের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ওই মামলায় আবেদনকারী ছিলেন সেখানকার বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান।
শুনানির শেষ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হাইকোর্টের রায়ে একজন বিচারপতি সংসদ সদস্যদের ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড থাকার কথা বলেছেন। এই বক্তব্য সত্য না হলে তাকে অপসারণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো উচিত।
এসময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আইন না থাকলেও রাষ্ট্রপতি কি একজন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারেন?
জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা নেই। আইনও নেই। আইন না থাকলেও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে রাষ্ট্রপতি একজন বিচারপতিকে অপসারণ করতে পারেন।
অ্যাটর্নি জেনারেলের এ বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতি বললেন, এটা কি বললেন? আইন না থাকলেও রাষ্ট্রপতি একজন বিচারপতিকে সরিয়ে দেবেন? কত হাজার বছর পিছনে নিয়ে যাচ্ছেন? বিচার বিভাগকে কি মনে করছেন?
গত ৮ মে এবিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের প্রথম দিনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়। ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।
পরে সংবিধানের এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট করেন। ওই রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্টের দেয়া ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।