প্রশস্ত মাঠের দক্ষিণ দিকে জাপানী বটগাছের পশ্চিম পাশে একা দাঁড়িয়ে আছেন বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র হুমায়ূন আহমেদ। নিথর নিস্তব্ধ ঠিক সন্ধ্যার আগে। গোধূলির শেষ ভাগও বলা যায়। তবে ক্লান্ত সূর্যের কিছুটা আলোর ছিটেফোঁটা তখনও লেগে আছে সবুজ পাতায়। নুহাশ পল্লীর আঙ্গিনা সুনসান নীরব। সেই নীরবতা ভেদ করে কয়েকটি ঝিঁঝিঁ পোকার সান্ধ্য আর্তনাদ ভেসে আসছিল গজারি বন থেকে। হঠাৎ করেই আকাশ ছেয়ে গেল ঘনকালো মেঘে। পাখিগুলো ফিরছে নীড়ে। সবুজে সবুজময় মাঠে দাঁড়িয়ে ঝিঁঝি পোকার আর্তনাদ শুনছেন হুমায়ূন আহমেদ। নীড়ে ফিরতে থাকা পাখিগুলোর উড়াউড়ি দেখছেন। তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ ক্যানসারের কাছে পরাস্থ হয়ে পরপারে চলে যাওয়ার ৫৫ দিন আগের ঘটনা। ২০১২ সালের ২৪ মে।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিয়ে আসা নানা প্রজাতির প্রায় দেড়’শ গাছের চারা রোপণ করিয়েছেন দিনভর। অসুস্থতার কথা যেন ভুলেই গেছেন। ততক্ষণে দিনের আলো নিভে গেছে। গাছের ছায়া ক্রমশ বড় বড় হতে হতে মিশে যায় হালকা অন্ধকারে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিকিৎসা নিয়ে বিশ দিনের জন্য দেশে এসেছেন। মাঝে মধ্যে নিজের হাতে গড়ে তোলা প্রিয় ভুবন নুহাশ পল্লীতে ছুটে আসেন তিনি। সেদিন খবর পাই – হুমায়ূন আহমেদ তার নিজস্ব জগৎ নুহাশ পল্লীতে অবস্থান করছেন। বাচিক শিল্পী ইকবাল নিশাত ও শিশুসাহিত্যিক জয়নুল আবেদীন স্বপনকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হই নুহাশ পল্লীতে। এর আগেও বহুবার দেখা হয়েছে,কথা হয়েছে বাংলা তাঁর সঙ্গে। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর প্রিয় লেখককে দেখার দেখার জন্য কেমন অস্থির হয়ে উঠছিলাম।
হুমায়ূন আহমেদকে দেখার প্রতীক্ষায় মাঠের পূর্বদিকে হোয়াইট হাউসের দক্ষিণে (যেখানে রাত যাপন করতেন তিনি) দুইটি ছাতিম গাছের নিচে বসে আছি আমরা। কখন পাবো তার দেখা? এ সময় হুমায়ূন আহমেদের মা রত্নগর্ভা আয়েশা ফয়েজ ঘর থেকে বেরিয়ে আমাদের কাছে এলেন। পরিচয় দিলাম। নানা বিষয় কথা হলো তার সাথে। নামাজে চলে গেলেন তিনি। বলে গেলেন ‘আমার পাগলটার জন্য তোমরা দোয়া করো। ও যেন ভালোবাসায় আবার ফিরে আসে।’
ততক্ষণে সময় বেশ গড়িয়ে গেছে। বাইরে চলছে ‘পিপিলিকা’ নামে একটি নাটকের শুটিং। কিছুক্ষণ পর দেখি আস্তে আস্তে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন লেখক হুমায়ূন আহমেদ। পেছনে তাঁর হাতের ওপর হাত রাখা। আমাদের দিকে বলা ঠিক হবে না, তার প্রিয় হোয়াইট হাউসের দিকে আসছেন। আমরা তাঁর দিয়ে এগিয়ে গেলাম। ধূসর রঙের ঢোলা একটা শার্ট আর ট্রাউজার পরিহিত লেখককে তখন বড় বেশিই ক্লান্ত লাগছিল। তিনি হয়তো বুঝতে পারেননি যে তাকে ঢের ক্লান্ত দেখাচ্ছে। স্যারের খুব কাছাকাছি আমরা। কেউ কথা বলতে সাহস পাচ্ছি না। হুমায়ূন আহমেদর লেখা পড়ে পড়ে বড় হয়েছি। তার হৃদয়ের কোমলাতা সম্পর্কে আমার তো জানাই আছে। কোটি তরুণ পাঠকের হৃদয় জয় করা লেখক আমার সামনে দঁড়িয়ে। তাঁর সঙ্গে কথা বলবো না -এ কীভাবে সম্ভব? এ সুযোগ হাত ছাড়া করা যাবে না- বিড় বিড় করে বললাম নিশাত ও স্বপনকে । ভয়ে শরীরও তখন কাঁপছিল।
আমার সমস্ত বিনয় আর নম্রতা ঢেলে দিয়ে সাহস করে বললাম – ‘স্যার আপনাকে সালাম করতে এসেছি। মনটা কেন ছটফট করছিল আপনাকে দেখার জন্য। ’ তখন একটু দূরে নুহাশের ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বুলবুল আস্তে আস্তে বলছিলেন ‘সর্বনাশ ! স্যার কারো সাথে দেখা করবেন না, এটা তিনি নুহাশে এসেই বলেছিলেন। এরা কথা বলছে, স্যার কি আমাকে ধমকই দেন কিনা।’ ভয়ে তিনি দু’ ঠোঁট কামড়াচ্ছিলেন। যাই হোক- লেখকের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা। সালাম করতে এসেছি শুনে তিনি বললেন, ‘করো করো সালাম করো, আমার পা পরিষ্কার আছে, একটু আগেই ধুয়ে এসেছি’। পরম তৃপ্তিতে সালাম করলাম জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের পা ছুঁয়ে। এ সুযোগ নিলেন নিশাত আর জয়নুল আবেদীন স্বপনও। প্রিয় লেখকের মুখে তখন মুচকি হাসি। হোয়াইট হাউসের বাইরে জ্বলে থাকা বাতির আলোয় দেখলাম সে দৃশ্যও। সেবারের একুশে মেলায় প্রকাশিত আমার ‘দেহারণ্যের ভাঁজে শূন্যতার বিলাপ ’ কাব্য গ্রন্থটি তাঁর হাতে তুলে দিলাম। বইটি হাতে নিলেন লেখক হুমায়ূন আহমেদ। দৃশ্যটা কল্পনা করুন তো! এরই ফাঁকে নিশাত ক্যামেরাবন্দী করে ফেলেন সেই মুহূর্তটি। বইটির পাতা উল্টিয়ে দেখতে লাগলেন তিনি। আমি মোবাইলের আলো জ্বেলে ধরে রেখেছি। বললেন বাহ্ প্রচ্ছদটা তো চমৎকার! কে করেছে? বললাম রাজিব রায়। ভেতরের পাতা খুলে তখন তিনি কী একটা কবিতা পড়ছিলেন। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে স্যার বললেন, ‘পদ্য বাদ দিয়ে গদ্য লেখো, তুমি ভালো করবে। বললাম জ্বি স্যার দোয়া করবেন। এটাই হুমায়ূন আহমেদের সাথে আমার শেষ দেখা। নিঃসঙ্গ সেই সন্ধ্যার দৃশ্যটি যেন আমার দু’চোখে স্থির হয়ে আছে এখনো । আর ‘পদ্য বাদে গদ্য লেখো ভালো করবে তুমি ভালো করবে’ স্যারের এই কথাটা দিব্যি ভেসে আসছে কানে। স্যার, আপনাকে তো দেখানোর সুযোগ দিলেন না, আমি ভালো গদ্য লিখতে পারলাম কি না ?
হুমায়ূন আহমেদের কথা পুরোপুরি রাখতে পারিনি। আংশিক রেখেছি। পদ্য বাদ দিতে পারিনি। তবে গদ্য লিখতে শুরু করি এরপর থেকেই। অবশ্য আগেও গল্প লিখেছি। এবার আরো উৎসাহিত হলাম। সাহস করলাম একটা গল্পের বই বের করার। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত বারোটি গল্প নিয়ে বের হলো আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ছাতিম গাছের মৃত ছায়া’। এই গল্প গ্রন্থের একটি গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ‘ ছাতিম কাঠের কফিন ’ শিরোনামে একটি টেলিফিল্ম। মাঝদুপুরের টেলিছবি হিসেবে চ্যানেল আইয়ে সেই টেলিফিল্মটি প্রচারিত হয়েছে।
গল্পগ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন- আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তিনি লিখেছেন ‘ইজাজ আহ্মেদ মিলন একজন তরুণ কবি। তাঁর কবিতা আধুনিক এবং তাতে সমাজ চিত্রের ছাপ আছে। বছর চার আগে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘নষ্ট শরীর ভিজেনা রৌদ্রজলে’ (এই কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি ‘সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার’ পেয়েছিলেন) এবং গেলো বছর প্রকাশিত দ্বিতীয় বই ‘দেহারণ্যের ভাঁজে শূন্যতার বিলাপ’ আমার হাতে আসে। তখনই তাঁর লেখার শক্তিমত্তা ও পারদর্শীতার পরিচয় পাই। বয়সে খুবই তরুণ এই কবি যে একদিন আমাদের সাহিত্য অঙ্গনের প্রথম সারিতে এগিয়ে আসতে পারে তার আভাস তাঁর লেখাতেই রয়েছে। মিলনের প্রতিভাবান একজন সাংবাদিকও । ঢাকার বিভিন্ন মিডিয়ার সঙ্গে তিনি জড়িত। এই মুহূর্তে তাঁর প্রথম গল্পের বই বেরিয়েছে। নাম ‘ছাতিম গাছের মৃত ছায়া’। আমি তাঁর কয়েকটি গল্প পড়ার সুযোগ পেয়েছি। গল্পগুলো আগে দেশের এবং দেশের বাইরের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। গল্পগুলোতে আধুনিক জীবনবোধ প্রখর। ভাষা ও প্রকাশ ভঙিতেও নতুনত্ব আছে। শুধু দেশের বর্তমান সামাজিক অবক্ষয় নয়, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে আমাদের জাতীয় জাগরণের খণ্ড খণ্ড ছবিও আছে গল্পগুলোতে। কোনো কোনো গল্পে বড় উপন্যাসের পটভূমি আছে। এ প্রজন্মের শক্তিমান লেখক ইজাজ আহ্মেদ মিলন কবিতার মতো গল্প লেখাতেও মুনশীয়ানা দেখিয়েছে। তাঁর কবিতার বইয়ের মতো গল্পের বইও পাঠকদের সমাদর লাভ করবে – এটা আমার ধারণা।’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)