৫৬ হাজার বর্গমাইল আসলে এরিস্টোটলের পাঠশালা যেন। এই বাংলার নবজাগরণের প্রতীক রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-লালন-শাহ আব্দুল করিম কারোরই স্কুলে যেতে হয়নি। জীবনের স্কুল থেকে জ্ঞানের দীপ জ্বেলেছেন তারা। নদীর দেশ, গানের দেশ, কবিতার দেশ বাংলাদেশ। বাঙ্গালী খুবই বিনয়ী এবং আতিথেয়তাপ্রবণ জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের মানুষের ঔদার্যকে যুগে যুগে যারাই দুর্বলতা ভেবেছে; তারাই তাদের পতন ডেকে এনেছে।
বাংলার সম্পদ লুন্ঠন করে লন্ডনে শিল্প বিপ্লব করেছিলো বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী। এদিকে দুর্ভিক্ষে মারা যায় অসংখ্য মানুষ; বাংলার মানুষ বুঝতে পারে তাদের নদী মনের ঔদার্য্যকে বৃটিশেরা দুর্বলতা ভেবেছে। নরম পলিমাটির জনপদে দ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার বাংলাদেশ।
বাংলার কৃষক জীবন দিয়ে পাট উৎপাদন করেছে। সেই সোনালী আঁশ রপ্তানী করে বসে খেয়েছে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। ঢাকাকে অন্ধকারে ঢেকে দিয়ে ঝাড়বাতি জ্বেলেছে তারা পাঞ্জাবে; তৈরী করেছে রাজসিক ইসলামাবাদ। বোঝা যায় আকাশ মনের বাঙ্গালী ঔদার্য্যকে দুর্বলতা ভেবেছিলো তারা। নরম পলিমাটির জনপদে আবার দ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। পিটুনী খেয়ে নাকে খত দিয়ে ফিরে যায় পাকিস্তানীরা।
বিএনপি-জামায়াত বলয় বাংলাদেশকালে একই ভুল করেছে। বাংলার মানুষ দু’হাতে কাজ করে জিডিপি গ্রোথ বাড়িয়েছে। সেলাই কর্মীরা রক্ত পানি করেছে; অনাবাসী শ্রমিকেরা মাতৃভূমির জন্য অশ্রু মুছে জীবন দিয়ে কাজ করে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। অথচ বিএনপি-জামায়াত বসে খেয়েছে। গলি থেকে রাজপ্রাসাদে উঠে এসে মাউনেরা “রাজপুত্রে”-র সাইড কিক হিসেবে রাতারাতি পাকিস্তানী খাদক, লুন্ঠক, ঘাতক হয়ে উঠেছে। রাজপুত্র ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে। ঐ যে বাংলার সরলতাকে দুর্বলতা ভেবেছে স্বাধীন দেশের হাওয়া উপনিবেশ। দ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে। পিটুনী খেয়ে নাকে খত দিয়ে লন্ডনে চলে গেছে রাজপুত্র।
আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টি বলয়টি একই ভুল করেছে। চায়ের স্টলে বসে থাকা বিশীর্ণ শরীরের মানুষগুলো যে এক একজন এরিস্টোটল; তা কেউ বুঝতে চায় না। গণতন্ত্র মানে ইচ্ছার স্বাধীনতা; রাষ্ট্রীয় সম্পদে জনমানুষের অধিকার; প্রতিটি নাগরিকের সম্মানের অধিকার; এগুলো খুব স্পষ্ট ব্যাপার বাংলাদেশের মানুষের কাছে। ৩০ কোটি হাত যখন দিনমান পরিশ্রম করে দেশটিকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করেছে; আবারো গলি থেকে উঠে আসা “রাজপ্রাসাদে”-র সাইডকিক খোউনেরা রাতারাতি সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছে। অপরাধ অস্বীকার আর জাস্টিফিকেশানের সিংহ হয়ে ঘুরছে কতিপয়। এমেরিকার বুশের মত নানা জুজু দেখিয়ে চলছে লুন্ঠন- পদে পদে জনমানুষকে কান ধরে উঠবস করানো আর গুমের নতুন সুবাতাস উপনিবেশ। ফলে আবার দ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে।
এক এগারোর পরে যারা দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির জুয়াড়ি হিসেবে; চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খেতে খেতে লুন্ঠনের স্বীকারোক্তি দিয়েছিলো; তারা কত অল্প সময়ে ভুলে গেলো সেইসব শিক্ষার দিনগুলোর কথা। এতো বিস্মৃতিপ্রবণ হলে কী চলে!
রাজনীতি করতে হলে শেরে বাংলার মতো কৃষকের দুঃখ বুঝতে হবে; মজলুম জননেতা ভাসানীর মতো মাটির মানুষ হতে হবে, রাজনীতিক সোহরাওয়ার্দীর মত মেধাবী হতে হবে; জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মত সৎ সাহস ও নিঃস্বার্থ স্বপ্ন বিনির্মাণের মানুষ হতে হবে। এরকম অসংখ্য রাজনীতির আইকন বাংলাদেশের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। সুতরাং মনোহরণকারী শ্লোগান আর জীবনহরণকারী মেশিনগানের খেলাটা বন্ধ করতে হবে; বাংলাদেশের মানুষের সেবক হতে হবে। নইলে যে কোন মহাপরাক্রমশালী শক্তির পতন অনিবার্য।
আর যেসব ধর্মের স্বঘোষিত ইজারাদার ছলে-বলে-কৌশলে খাসজমি, হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-আদিবাসীদের জমি ও জীবন খেতে চায়; তাদের খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে বাংলাদেশে।
বাংলাদেশের মানুষ মানবিকতা ও সাম্যের ইসলাম গ্রহণ করেছে। তরবারির ইসলামের ঠাঁই নেই এই বাংলায়। একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধীদের মৃত্যুদন্ড বাংলাদেশে যে কোন মানবতা বিরোধী অপরাধের শেষ দৃশ্য। সন্ত্রাসী বাংলা ভাই-শায়খের মৃত্যুদন্ড থেকে পরিণতি স্পষ্ট হয়ে যাওয়া জরুরী তরবারির ইসলামের নরমাংসের কারবারীদের।
বাংলাদেশ এক অদম্য জনপদ। এই সবুজ ব-দ্বীপটি পরাভব মানে না। জীবনের মুক্তির আনন্দই যে গানের-কবিতার-শ্রমের আর উৎসবের এই ভূ-খন্ডের একমাত্র চাওয়া। খুব বেশী কিছু চায় না মানুষ; শ্যামলকান্তি রোদ্দুরের বাংলাদেশের স্বপ্ন বুকে পুষে রাখে কেবল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)