চলচ্চিত্র, শিল্প ও সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকেই এবছর হারিয়ে গিয়েছেন সবার মাঝ থেকে। তাদের অনুপস্থিতি দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তাদের স্মরণ করবে বাংলাদেশ।
চলতি বছর চলচ্চিত্র, সংগীতসহ শোবিজের নানা অঙ্গনের বহু গুণী-প্রিয় মানুষেরা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে গেলেন। তাদেরকে হারানোর শোক হৃদয়ে নিয়েই বরণ করতে হবে নতুন বছরকে। অসংখ্য ভক্ত অনুরাগীদের কাঁদিয়ে চলতি বছরে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন যারা, তাদের কথা জেনে নিতে পারি এখানে:
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: এবছরের ৬ মার্চ খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা-ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিট-সিসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মারা গেছেন। হৃদরোগের পাশাপাশি ডায়াবেটিস ও কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১০ সালে তিনি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পদক পান। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব প্রদান করে।
রানী সরকার: ষাট ও সত্তর দশকের জনপ্রিয় খল-অভিনেত্রী রানী সরকার এবছরের ৭ জুলাই ৮৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রখ্যাত এই অভিনেত্রী বার্ধক্যজনিত ছাড়াও পিত্তথলিতে পাথর, বাতজ্বর, জটিল কোলেলিথিয়েসিস রোগসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। ১৯৫৮ সালে মঞ্চনাটকের মাধ্যমে তিনি অভিনয় শুরু করেন। একই বছর ‘দূর হ্যায় সুখ কা গাঁও’র মাধ্যমে প্রথম সিনেমায় অভিনয় করেন কিংবদন্তিতুল্য এই অভিনেত্রী। প্রায় আড়াইশ চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন তিনি। তার অভিনীত সিনেমাগুলো- ‘চান্দা’, ‘তালাশ’, ‘কাচের দেয়াল’, ‘বেহুলা’, ‘আনোয়ারা’, ‘চোখের জল’, ‘নাচের পুতুল’ ইত্যাদি। তিনি পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
আইয়ুব বাচ্চু: ১৮ অক্টোবর অসংখ্য ভক্ত অনুরাগীকে কাঁদিয়ে চলে গিয়েছেন গিটারের জাদুকর আইয়ুব বাচ্চু। নিজ বাসায় হার্ট অ্যাটাক করার পর তাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। বাচ্চুর সংগীতজগতে যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৮ সালে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের মাধ্যমে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালে তিনি সোলস ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯১ সালে বাচ্চু এলআরবি ব্যান্ড গঠন করেন। গিটারে তিনি সারা ভারতীয় উপমহাদেশে বিখ্যাত। জনপ্রিয় গান ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘সেই তুমি’, ‘তারা ভরা রাতে’, ‘সুখের পৃথিবী’, ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘আমি বারো মাস তোমার আশাই আছি’, ‘মেয়ে’, ‘আম্মাজান’ গানগুলির মধ্যে দিয়ে তিনি চিরকাল সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।
চলতি বছরে সবচেয়ে আলোচিত ছিলো আইয়ুব বাচ্চুর আকস্মিক মৃত্যু। তাকে হারানোর ক্ষতি বাংলা সংগীত জগতে পূরণ হওয়ার নয়।
আনোয়ার হোসেন: শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক হিসেবে পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ী সিনেমাটোগ্রাফার আনোয়ার হোসেন মারা গেছেন ১ ডিসেম্বর। সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে খ্যাতি থাকলেও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের একজন আলোকচিত্রীও ছিলেন আনোয়ার হোসেন। ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ ছাড়াও আনোয়ার হোসেন ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’,‘পুরস্কার’, ‘অন্য জীবন’ এবং ‘লালসালু’র জন্য শ্রেষ্ঠ সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছিলেন।
আমজাদ হোসেন: ব্রেন স্ট্রোক করে বেশ কিছুদিন লাইফসাপোর্টে থাকার পরে ১৪ ডিসেম্বর মারা গেছেন কিংবদন্তি নির্মাতা, গীতিকার ও লেখক আমজাদ হোসেন। আমজাদ হোসেনের পরিচালনায় জনপ্রিয়তা পাওয়া ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বাল্যবন্ধু’, ‘পিতাপুত্র’, ‘এই নিয়ে পৃথিবী’, ‘বাংলার মুখ’, ‘নয়নমনি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দুই পয়সার আলতা’, ‘সখিনার যুদ্ধ’, ‘ভাত দে’, ‘হীরামতি’, ‘প্রাণের মানুষ’, ‘সুন্দরী বধূ’, ‘কাল সকালে’, ‘গোলাপী এখন ঢাকায়’ ‘গোলাপী এখন বিলেতে’ ইত্যাদি। ১৯৭৮ সালে ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ এবং ১৯৮৪ সালে ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া নানামাত্রিক কাজের জন্য ১৪ বার জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। একইসাথে বাংলা একাডেমী পুরস্কার সহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
সাইদুল আনাম টুটুল: ১৫ ডিসেম্বর শনিবার রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির পর ১৮ ডিসেম্বর মঙ্গলবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নির্মাতা সাইদুল আনাম টুটুল। দীর্ঘদিন সিনেমা নির্মাণ না করলেও সম্প্রতি একটি নতুন ছবির শুটিং শুরু করেছিলেন টুটুল। সরকারি অনুদানে ‘কালবেলা’ নামে একটি সিনেমা করছেন তিনি। সাইদুল আনাম টুটুল ডিরেক্টরস গিল্ডের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ও আজীবন সদস্য। ২০০৩ সালে ‘আধিয়ার’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রশংসিত। এর আগে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ সিনেমা সম্পাদনার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়াও বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘুড্ডি, দহন, দীপু নাম্বার টু ও দুখাইয়ের মতো সিনেমার সঙ্গে রয়েছেন তার সংশ্লিষ্টতা। যেগুলোর সম্পাদনায় ছিলেন তিনি।
সরকার ফিরোজ: ২০ ডিসেম্বর অভিনেতা ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব সরকার ফিরোজ সরকার ফিরোজ মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এছাড়াও তিনি ১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্রের (এখনকার বিটিভি) একজন ঘোষক ছিলেন। দীর্ঘ ৫০ বছর দেশের টেলিভিশন মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সরকার ফিরোজ।
মোহাম্মদ ইদ্রিস: ২২ ডিসেম্বর মারা গিয়েছেন দেশের প্রথম ডাক বিভাগের খামের নকশাকার মোহাম্মদ ইদ্রিস। তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তিনি ছিলেন শিল্পী জয়নুল আবেদিন প্রতিষ্ঠিত আর্ট কলেজের তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর মুদ্রা, চিঠির খাম, ডাকটিকিট, জাতীয় প্রতীক, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রামসহ নানা কিছুর পরিবর্তনে কামরুল হাসানের তত্ত্বাবধানে কাজ করেন মোহাম্মদ ইদ্রিস। তার করা শাপলা ফুলের নকশার সেই প্রথম চিঠির খাম এখনও ব্যবহার করতে দেখা যায়।আত্মপ্রচারবিমুখ ছিলেন তিনি। জীবনের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছেন গ্রামবাংলার নানা রকম হস্তজাত শিল্পের উৎকর্ষসাধন ও তার প্রসারে।