ভারতীয় সিনেমায় ত্রয়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেন। ঋত্বিক ও সত্যজিতের মৃত্যু হয়েছে বহু আগেই। সর্বশেষ গত রবিবার ( ৩০ ডিসেম্বর) মারা গেলেন মৃণাল সেনও। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বাংলা ভাষার এই প্রভাবশালী নির্মাতার মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন ভারতীয় চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি থেকে শুরু করে বাংলাদেশেও।
৯৫ বছর বয়সী এই নির্মাতার শেষ কৃত্যানুষ্ঠান এখনো হয়নি। কলকাতার গণমাধ্যম জানিয়েছে, শিকাগো থেকে ছেলে কুণাল ফেরার পর মৃণাল সেনের শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। আর সেটা ২ জানুয়ারির আগে হচ্ছে না। আর তাই বিখ্যাত এই নির্মাতার মরদেহ এখন হিমঘরে! কিন্তু এতোসব পাশ কাটিয়ে আলোচনায় মৃণাল সেনের শেষ ইচ্ছা নিয়ে!
কী ছিলো তাঁর শেষ ইচ্ছে? মৃণাল সেনের পারিবারিক চিকিৎসক গণমাধ্যমে জানালেন, ব্যক্তিগত আলোচনায় পরিবারের সদস্যদের কাছে মৃণাল সেন বলেছিলেন, তাঁর শেষযাত্রায় যেন কোনো ফুলের মালা না থাকে। সরকারি আতিশয্যও যেন না থাকে। এমনকি রবীন্দ্র সদন কিংবা নন্দনেও শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাঁর মরদেহ রাখা হচ্ছে না।
প্রশ্ন উঠছে, কেন এমন ইচ্ছের কথা বলে গেলেন মৃণাল সেন? একেক জন একেকভাবে মৃণাল সেনের শেষ ইচ্ছাকে বিশ্লেষণ করছেন। তেমনি একজন লেখক দেবাহুতি চক্রবর্তী। ফেসবুক মৃণাল সেনের শেষ ইচ্ছে নিয়ে কথা বলেছেন তিনিও। চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের জন্য দেবাহুতির লেখাটি হুবুহু তুলে ধরা হলো:
ফুল যখন পাথর হয়ে ওঠে।।
জীবনে পুরস্কার তিনি গ্রহণ করেননি তা তো নয়। ১৮টি জাতীয়, ১২টি আন্তর্জাতিক, দাদাভাই ফালকে সহ ছোট বড় অসংখ্য পুরস্কার মৃণাল সেন পেয়েছেন। দু’হাত ভরে ফুলের শুভেচ্ছা ও তাই ছিল অফুরান। অথচ সেই তিনিই নিতান্তই সাদামাটা ভাবে বাড়ি থেকে এখন হিমঘরে। ছেলে কুনাল সেন ফিরলেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে।
এ পর্যন্ত জানা গেছে, তাঁর ইচ্ছানুযায়ী অন্তিম যাত্রার কোন আড়ম্বর হবে না। নিঃস্পন্দ দেহ ভরে উঠবে না ফুলে ফুলে। সরকার বা জনসাধারণের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য মরদেহ কোথাও শায়িত রাখা হবে না। বিষয়টা কি শুধুই একটা ইচ্ছে? ইচ্ছের আড়ালে আর কিছু নেই? শম্ভু মিত্রের ইচ্ছে অনুযায়ী প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শেষযাত্রা রাজ্য সরকারের দখলীকরণ প্রক্রিয়ার মাঝে জনসাধারণকে অনেকটাই দূরে ঠেলে দেয়। ঋতুপর্ণ ঘোষের ক্ষেত্রে ও ব্যাপারটা প্রায় এমনই।
সারাজীবন মার্ক্সবাদী চিন্তায় বিশ্বাসী মৃণাল সেনের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অনেকই প্রখর ছিল। সেইসাথে ছিল প্রথম যৌবনে রবীন্দ্রনাথের অন্তিম যাত্রার সময়কার একটা যন্ত্রণাময় স্মৃতি। নিমতলা শ্মশান ঘাটের উদ্দেশে এক পিতার বুক থেকে ভিড়ের অনিয়ন্ত্রিত চাপে ছিটকে পদদলিত হয় তার মৃত শিশু। উদ্দাম জনতার তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এই ছবি কখনোই মুছে যায়নি ক্যামেরার মহাকবির কাছ থেকে।
২০০২ এর পর থেকেই ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়াতে পারেননি বা সেলুলয়েডে বন্দী করতে পারেননি একুশ শতকের কলকাতার মর্মযন্ত্রণা। অশক্ত দেহে রক্তক্ষরণ ছিল যথেষ্ট । অথচ জানতেন, বাধা না আরোপ করলে পাত্র-অপাত্র সবার হাতেই থাকবে রাশি রাশি ফুল। কন্ঠে সোচ্চার হবে বড় বড় স্তুতি। যা তিনি এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। সবটাই আমার নিজস্ব ভাবনা। আর একজনের সাথে নাই মিলাতে পারে। আমার মনে হয়েছে শুধু কথায় তিনি আর তুষ্ট হতে চাননি। ফুলের মালা, ফুলের স্তবক বড় বেশি মানুষের স্তুতিবাক্যকে প্রতিষ্ঠা করে যা তিনি উপলব্ধি করেছেন। তার চেয়ে জীবনের শেষ পরিণামকে মেশাতে চেয়েছেন জল, মাটি আর হাওয়ায়।
মাণিক বন্দোপাধ্যায়ের করুণ মৃত্যুর পর শেষযাত্রায় সামিল হওয়া মানুষের অভাব হয়নি। মনে এল,সুভাষ মুখোপাধ্যায় একটা দীর্ঘ কবিতা লিখেছেন এই উপলক্ষে। কয়েকটি লাইন:
‘‘ফুলগুলো সরিয়ে নাও
আমার লাগছে।
মালা জমে পাহাড় হয়
ফুল জমতে জমতে পাথর
পাথরটা সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।’’