কক্সবাজারের টেকনাফের শালবন আনসার ক্যাম্পের প্লাটুন কমান্ডার আলী হোসেন।
বাড়ি টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার পৌর এলাকার সৌখিন মোড়ে। স্ত্রী, এক ছেলে ও
এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। সুখী পরিবার বলতে যা বুঝায় তাদের পরিবারটিও তাই।
আট-দশটি নিম্নবিত্ত পরিবারের মতো নিত্য চাহিদা আর যোগানের সংকট থাকলেও অভাব ছিল না সুখের। তবে অভাব ছিল সৈনিক জীবনের ছুটি নামক সোনার হরিণের।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত আলী হোসেন ছুটি পেয়েছেন। প্রায় দেড় মাস পর শনিবার সকালে জীবনের শেষ ছুটিতে লাশ হয়ে বাড়ি এসেছেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তদের গুলিতে লাশ তিনি।
নিহত আলী হোসেনের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। শুক্রবার সারাদিনই প্রিয় মানুষটির লাশের অপেক্ষায় থেকে বিলাপ করছে পরিবারের সদস্যরা। সুখ-দুঃখের স্মৃতি হাতরে প্রত্যেকটা সদস্য বুনে যাচ্ছেন দুঃখকাঁথা। সদ্য এসএসসি পাশ করা একমাত্র মেয়ে সোমা আক্তারের কান্না কোনো ভাবেই থামছে না। বিলাপ করে শুধু একই কথা বারবার বলে যাচ্ছে “ আমার রেজাল্ট শুনে বাবা কতো খুশি হয়েছিল। বলেছিল দ্রুত ছুটি নিয়ে বাড়ি আসবে। আসার সময় টাঙ্গাইল থেকে নতুন কাপড় আর মিষ্টি আনবে। বাবা আজ ছুটি পেয়েছে। আজীবনের জন্য ছুটি পেয়েছে।
একমাত্র ছেলে শওকত আলী সুজন এবার সরকারি মুজিব কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। বাবাকে হারিয়ে শোকে একেবারে পাথর হয়ে গেছে। চোখের জল শুকিয়ে নির্বাক। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে চেনা-অচেনা সব মানুষের দিকে। উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে যেন পুরোপরি দিশেহারা পরিবারটি।
আর মাত্র দুই বছর পরই চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার কথা ছিল আলী হোসেনের। পেনশনের টাকা হাতে পেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে হজে যাওয়ার পরিকল্পনাও করেছিলেন তিনি। স্বপ্ন দেখতেন ছেলে-মেয়েরা মানুষের মতো মানুষ হবে। আর এজন্য প্রতিদিনই মোবাইল ফোনে স্ত্রীর সাথে কথা বলে পরিবারের খোঁজ নিতেন আলী হোসেন। এখন আর কে খোঁজ নিবে তাদের? কে আমাদের দেখাশুনা করবে? আর এ কথাগুলো বলেই স্ত্রী সাজেদা বেগম আহাজারি করে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন।
প্রতিদিনের মতো টেকনাফের মুচনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শালবন ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করছিলেন মোহাম্মদ আলী হোসেন। দুর্বৃত্তরা ক্যাম্পে হানা দিয়ে ১১টি অস্ত্র ৬৭০ রাউন্ড গুলি নিয়ে যায়। এ সময় বাধা দিলে তাকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এ মৃত্যুর খবর পরিবারের কাছে আসে শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে।
দিনভর অপেক্ষার পর প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষে আলী হোসেনের মরদেহ গ্রামের বাড়ি পৌঁছে শনিবার সকাল ৮টার দিকে। জানাযা শেষে পাইলট সখিপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ কবরস্থানে তাকে সকাল ১০টার দিকে সমাহিত করা হয়।
আলী হোসেন মৃত্যুতে পরিবারের লোকজন যেমন শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে তেমনি ওই এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
নিহতের ভাই আবুল সরকার বলেন, ছোট মেয়েটির রেজাল্ট হবার পর থেকেই ভাই বাড়ি আসার জন্য ব্যস্ত ছিলেন। চাকুরীর নিয়ম-নীতির কারণে তার ছুটি পেতে দেরি হচ্ছিলো। সেই তিনি ছুটিতে বাড়িতে এলেন, তবে আজীবনের জন্য।