বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ উপমহাদেশের রাজনীতিতে নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে সাধারণ মানুষের দাবি দাওয়া আদায়ে বরাবরের মতোই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত গণমানুষের দল হিসেবে তৃণমূল হতে শুরু করে জাতীয় পর্যায়েও সুদৃঢ় অবস্থান ধরে রেখেছে দলটি।
আমাদের গৌরবের ইতিহাস মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছে। পাশাপাশি ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সত্তরের নির্বাচনে দলটির দায়িত্বশীল ও সংগ্রামী ভূমিকা মুক্তিকামী মানুষদের অনুপ্রেরণা হয়ে আন্দোলিত করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও যৌক্তিক দাবি আদায়ে নেতৃত্বের ভূমিকায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভূমিকা অগ্রগণ্য।
স্বৈরতন্ত্রের বিলুপ্তিসহ যুদ্ধাপরাধের বিচার ও অন্যান্য প্রত্যেকটি ইতিবাচক আন্দোলন সংগ্রামের প্রথম সারিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যথোপযুক্ত ভূমিকা জনগণের নিকট নিজেদের সঠিক অবস্থান তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। বাঙালির ইতিহাস, বাংলার সংস্কৃতি ও সভ্যতা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, মুক্তবুদ্ধির চর্চায় দলটি সৃষ্টিলগ্ন থেকেই নৈপুণ্য দেখিয়েছে।
বর্তমান সময়েও ছিটমহলের সুরাহাকরণ, সমুদ্র বিজয় ইত্যাদি অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের নিকট দল হিসেবে যৌক্তিকতা দেখিয়ে চলেছে। অন্য দলের তুলনায় আওয়ামী লীগের পার্থক্য ও দূরদর্শিতার স্পষ্ট ছাপও রাখতে সক্ষম হয়েছে দলটি।
১৯৮১ সালের ১৭ মে পিতামাতা হারা নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত অবস্থায় জনগণের ডাকে বাংলাদেশে আসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা, মানবিক মানুষ, বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক, ৩ বারের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশে এসেই আওয়ামী লীগ সংগঠিত করার কাজে মনোঃসংযোগ ঘটান। হতাশাগ্রস্ত কর্মীদের উজ্জীবিত করেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য দেশব্যাপী সফর শুরু করে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
তবে শেখ হাসিনার এ পথ মসৃণ ছিল না, কন্টকাকীর্ণ পথকে মাড়িয়েই তিনি আজকের অবস্থানে এসেছেন। অসংখ্যবার আক্রমণ হয়েছে তার ওপর, মৌলবাদী গোষ্ঠী শেখ হাসিনাকে সরিয়ে দিতে সোচ্চার এখনো। তদুপরি তিনি নিরলস সংগ্রাম করে চলেছেন দেশের জন্য।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম নৃশংস হামলা সংঘটিত হয়েছিল খুনি চক্রদের মদদে। মূলত শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে দিতে পারলেই মৌলবাদীদের স্বার্থ রক্ষা হয়। কিন্তু সেদিন সৃষ্টিকর্তার মহিমায় বেঁচে যান রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা, পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা যে মানবঢাল তৈরি করেছিলেন সেটিও বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য ইতিহাস।
ওই হামলায় আহতরা স্প্লিন্টারের আঘাত নিয়ে অনেকেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন, অনেকেই ব্যথা নিয়ে বেঁচে আছেন। তবুও প্রিয় নেত্রীর জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করেছিলেন।
হামলার সময় সাথে সাথে ২৪ জন মারা যায় পরবর্তীতে হাসপাতালে আইভি রহমানসহ অনেকেই মারা যায়, আহতের সংখ্যা প্রায় ৩০০।
মানুষের ভালবাসাই শেখ হাসিনার কাছে অমূল্য সম্পদ। তিনি এ বিষয়টি বিভিন্ন আলোচনায় জোর দিয়ে উল্লেখ করেন। ওই দিন নেতাকর্মীরা মানবঢাল তৈরি না করলে শেখ হাসিনার কী হতো সেটা বলা মুশকিল, এখনো তিনি কানের যন্ত্রণায় ভুগছেন। আবার ওই দিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পোড়খাওয়া কর্মীরা তাদের নেত্রীর প্রতি শ্রদ্ধার জায়গাটা দেখাতে পেরেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীও তার দলের নেতাকর্মী সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল, দলের তৃণমূল নেতাকর্মী থেকে শুরু করে প্রেসিডিয়ামের সদস্যের প্রতি নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন। বিপদে আপদে পাশে থাকার চেষ্টা করেন।
মানবিক মানুষ হিসেবে শেখ হাসিনা উপমহাদেশীয় তথা বৈশ্বিক রাজনীতিতে অনন্য। সর্বশেষ রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে সারা বিশ্বে তিনি মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। অন্য কোন রাষ্ট্রপ্রধান কি সহসাই এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন? এখানেই শেখ হাসিনা অনন্য। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ শেখ হাসিনাকে মাদার অব হিউম্যানিটি পদকে ভূষিত করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। পাশাপাশি শেখ হাসিনার সরকার কূটনৈতিকভাবে মিয়ানমারের সরকারকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পাঠানোর ব্যাপারেও তৎপর।
রোহিঙ্গাদের ওপর যে ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছে সামরিক সরকার, তা আজ পরিষ্কার এবং তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের তৎপরতায় জাতিসংঘ বিশেষ অধিবেশনও বসিয়েছে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মতৈক্য পৌঁছানোর জন্য। এ সবই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েই হচ্ছে। বিচক্ষণতা আর সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে বর্তমান সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছেন।
২০০৯ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পরে আওয়ামী লীগের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার বিচক্ষণ ও সাহসী সিদ্ধান্তে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে অগ্রগতির সোপানে পা ফেলেছে বাংলাদেশ। সবকিছু সঠিকভাবে পরিচালিত হলে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। উন্নয়নের অনেকগুলো সূচকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর থেকে অনেকাংশে এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে। উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ব্যাপকভাবে আশার সঞ্চার করেছে, বাংলাদেশকে ফলো করছে বহির্বিশ্ব।
বর্তমান সরকারের গ্রহণীয় উদ্যোগ বিশেষ করে মেগা প্রকল্পের তড়িৎ বাস্তবায়নের মাধ্যমে উৎপাদনশীল বিশ্বে কর্মদক্ষতার গুণে আলাদা বিশেষত্ব অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে, এমন অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক তাদের সংযুক্তি প্রত্যাহার করে নেয় পদ্মা সেতু থেকে। দৃঢ়চিত্তের অধিকারী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নিজেদের টাকায় করার সিদ্ধান্ত নেন এবং নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। পদ্মা সেতু এখন আর কল্পনা নয়, বাস্তবে প্রতিফলিত হতে চলেছে, ইতিমধ্যে সেতুর উন্নয়ন কাজের ৫০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক আদালতসহ বিভিন্ন জায়গায় বিচার সালিশের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় পদ্মা সেতুতে কোন দুর্নীতি হয়নি। তাছাড়া, পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য কোন অর্থ ছাড় দেয়নি বিশ্বব্যাংক। তদুপরি দুর্নীতির অভিযোগ করাটা কোনভাবেই মানানসই ছিল না।
এদিকে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী পদত্যাগ করেন এবং বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগবিরোধী সংবাদ প্রচারে সিদ্ধি দেখিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তাদের সফলতা ও সততার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে এবং আজ তা প্রমাণিত।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময়েও শেখ হাসিনা প্রবল চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। বৈশ্বিক নেতাদের অন্যায্য অনুরোধকে অগ্রাহ্য করে স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সিদ্ধান্ত থেকে এক পা সরে আসেননি বঙ্গবন্ধু কন্যা। বিচক্ষণ এবং যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে শেখ হাসিনা উপমহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে দক্ষিণ এশিয়া ছাড়াও বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নিজের নেতৃত্বগুণকে বিকাশ করেছেন। এমনও হয়েছে অন্য দেশের নির্বাচনী প্রচারণায় ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য শেখ হাসিনার সাথে সখ্যতার চিত্র তুলে ধরেছেন প্রার্থীরা।
সুতরাং মনে হচ্ছে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও শেখ হাসিনার গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শেখ হাসিনাও নিজস্ব সক্ষমতা এবং প্রজ্ঞার সম্মিলন ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংস্থা থেকে স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার ও উপাধি পেয়েছেন। এ সবই শেখ হাসিনার অর্জন।
শেখ হাসিনার সাথে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সখ্যতা ও সাফল্যের স্বরূপ আমরা উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তার একক নেতৃত্বে দেশ আজ সফলতার শিখরে আরোহণ করেছে। আওয়ামী লীগও তার নেতৃত্বকে সাদরে গ্রহণ করেছে। কাজেই শেখ হাসিনাবিহীন আওয়ামী লীগের চিন্তা অচিন্তনীয়, অমূলক। সর্বশেষ কাউন্সিলে দলের সভাপতির দায়িত্বে নতুন কাউকে আসার অনুরোধ জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু কাউন্সিলররা সর্বসম্মতিক্রমে প্রধানমন্ত্রীকেই দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে (আসন্ন নির্বাচনের পরে তিনি হয়তো ভবিষ্যতে আর নির্বাচন করবেন না) আওয়ামী লীগের দায়িত্বে কে আসবে? আমরা দেখেছি অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা। তত্ত্বাবধায়কের সময়ে শেখ হাসিনাকে যখন কারান্তরীণ করা হয় তখন দল ভাঙ্গার নামে সংস্কারের নাম করে উপমহাদেশের প্রাচীন দল আওয়ামী লীগকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল একটি কুচক্রীমহল। কিন্তু পোড়খাওয়া সিনিয়র নেতৃবৃন্দের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগের ভাঙ্গন রোধ করা সম্ভব হয়। যদিও কয়েকজন সংস্কারবাদিতার লালসে দল থেকে সাময়িকভাবে ছিটকে পড়েন এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েকজনকে দলে টেনে রাজনীতি করার সুযোগ দেন।
কাজেই ভবিষ্যৎ আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি হিসেবে কাউকে এখন থেকেই তৈরি করা উচিত দলের জন্য, দেশের জন্য। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসুরী হিসেবে যেমন শেখ হাসিনা দায়িত্ব পালন করে চলেছেন ঠিক তেমনি শেখ হাসিনার উত্তরসূরীকেও দূরদর্শী ও বিচক্ষণতাসম্পন্ন হতে হবে। তাই এখন থেকে নেতৃত্ব তৈরি করা হলে আগামী দিনে দলের নেতৃত্ব প্রদানের মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বগুণ ও কর্মব্যস্ততার দক্ষতার কৌশলে শেখার মত অনেক কিছুই আছে নতুন নেতৃত্বের।
ভবিষ্যৎ আওয়ামী লীগের দায়িত্ব কে গ্রহণ করবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্বও শেখ হাসিনার উপরই বর্তায়। কারণ, দলের প্রতি শেখ হাসিনার ত্যাগ সব থেকে বেশি। এরই প্রেক্ষিতে কোন এক সেনাপ্রধান বলেছিলেন, সবাইকে কেনা যায়, ব্যতিক্রম কেবল শেখ হাসিনা। সুতরাং আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব শেখ হাসিনার হাত ধরেই আসবে এবং তা অবশ্যই বঙ্গবন্ধু পরিবারের হতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)