বিশ্ববিখ্যাত প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বসের বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ১০০ নারীর মধ্যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান ২৬তম। এই তালিকায় শুধু রাজনীতিবিদেরাই নন, রয়েছেন ব্যবসায় পরিচালনা, ফ্যাশন ডিজাইন, স্বাস্থ্য সেবা, ক্রীড়া, অর্থনীতিসহ বহু পেশার নারীরা। তালিকার মধ্যে রাজনীতি ক্যাটাগরিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থান ৬ষ্ঠ। তার আগে ক্রমান্বয়ে রয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে, ৩ মার্কিন নারী বিচারপতি, রানি এলিজাবেথ, এবং ৫ম স্থানে ট্রাম্প কন্যা ইভানকা ট্রাম্প।
৩য় অবস্থানে থাকা মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের ৩ নারী বিচারপতি, রাজনীতিবিদ নন। রানি এলিজাবেথও নন রাজনীতিবিদ। তিনি রানি অর্থাৎ সার্বভৌম। তাকে অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে সার্বভৌমের অবস্থান নিতে হয়নি বা ধরে রাখতে হয় না। ট্রাম্প কন্যাও নন রাজনীতিবিদ। তিনি নিজে কখনো রাজনীতি করেননি। তার কোন দলীয় পরিচয় নেই। বাবার ক্ষমতায় তিনি ক্ষমতাবান। প্রথম ৬ জনের মধ্যে রাজনীতিবিদ হচ্ছেন অ্যাঙ্গেলা মেরকেল, থেরেসা মে এবং শেখ হাসিনা। অ-রাজনীতিবিদদের যদি ফোর্বসের এই তালিকা থেকে সরিয়ে দেয়া যায় তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলে আসেন ৩য় অবস্থানে। ফোর্বসের নিয়মনীতি অনুযায়ী শেখ হাসিনা বিশ্বের ৩য় ক্ষমতাধর নারী।
এবারে যদি আমরা এই তিন রাজনীতিবিদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করি তাহলে দেখতে পাব শেখ হাসিনার মত পাথর সময়, বন্ধুর পথ পারি দিয়ে প্রথম দুজনকে পেতে হয়নি চ্যান্সেলর/ প্রধানমন্ত্রীর পদ। প্রথম দুজনকে হারাতে হয়নি পুরো পরিবার; জীবন রক্ষায় আশ্রয় নিতে হয়নি ভিনদেশে; মোকাবেলা করতে হয়নি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা তথা ১৯ বারের জীবন নাশের প্রচেষ্টা। তাদের দেখতে হয়নি পিতার হত্যাকারীদের আইনের উপর দিয়ে চলতে; নিশ্চিত করতে হয়নি পিতা হত্যার, একাত্তরের ঘাতকদের বিচার; সামলাতে হয়নি ইউরোপ-আমেরিকার প্রচণ্ড চাপ; দমন করতে হয়নি জঙ্গিবাদ; মোকাবেলা করতে হয়নি ক্ষুধা, দারিদ্র, অশিক্ষা, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা। তারা উন্নত পরিবেশে ধনীদের সমর্থন নিয়ে শুধু বুদ্ধি দিয়ে প্রতিযোগিতা করে হয়েছেন চ্যান্সেলর/ প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী, প্রভাবশালী, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত ৫টি দেশের কোনটির প্রধানমন্ত্রী নন। সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া, একদা তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা পাওয়া দেশটার নেতৃত্ব দিতে দিতে তিনি এমন অবস্থানে পৌঁছেছেন যে আজ বাংলাদেশ বিরোধী মার্কিনমুলুকের চরম পুঁজিবাদীদের পরম প্রিয় পত্রিকা তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজনীবিদ নারীর তালিকার শীর্ষ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছে। এটাই শেখ হাসিনা। ফোর্বসের লোকেরা যদি শুধু ক্ষমতার পরিমাপ না করে ক্ষমতা অর্জনের পরিস্থিতি এবং প্রক্রিয়াটাও বিবেচনায় নিতেন তবে এঞ্জেলা মার্কেল নন, এক নম্বরে থাকতেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা কিভাবে বিশ্বব্যাপী এত ক্ষমতাধর হয়ে উঠলেন। আসুন এবার তার পেরিয়ে আসা পথের দিকে তাকাই। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘ ছয় বছর তিনি প্রবাসে কাটিয়েছেন রাজনৈতিক আশ্রয়ে। ৮১ সালে যখন তিনি দেশে ফিরলেন তখন ৩০ লক্ষ শহীদ, ৪ লক্ষ বীরাঙ্গনার বাংলাদেশ স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, আমেরিকা আর তাদের নতুন স্ট্রাইকার জেনারেল জিয়ার অধীনে। পিতার খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে আইন পাশ হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বড় বড় রাষ্ট্রীয় পদে, বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে বাংলাদেশের কূটনীতিক। যুদ্ধাপরাধীরা জেল থেকে মুক্ত হয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনীতি। স্বাধীনতা বিরোধী সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তারা দেশে ফিরে বসে গেছেন উপরের পদগুলোতে। সেনাবাহিনীতে থাকা শত শত মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। বেসামরিক প্রশাসনে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা কোণঠাসা। জয় বাংলা আর শেখ মুজিব নিষিদ্ধ।
৮১ সালে দেশে ফিরে দেখলেন নিজের বাড়ি ৩২ নম্বর তাঁর অধিকারে নেই। পারলেন না সেখানে গিয়ে প্রিয়জনদের জন্য প্রার্থনা করতে। পেলেন না কোন থাকার জায়গা। এর বাসায়, ওর বাসায় কাটতে থাকলো তার নিষঙ্গ জীবন। যেখানেই যান সেখানেই তার জীবননাশের জন্য হামলা হচ্ছে। তাড়া করে ফিরছে মুক্তস্বাধীন ৭৫ এর খুনিরা। এসবের মধ্যে ৮২ সালের ২৬ মার্চ জাতীয় স্মৃতিসৌধে শেখ হাসিনা প্রথম সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন। দেশের মানুষ আবার এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশ ফিরে পাবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। রাজপথ হয়ে উঠল তার ঘরবাড়ি; দেশের মানুষ তাঁর ভাইবোন, পরিজন। এদের নিয়েই এগিয়ে চলল তাঁর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম; গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাবার সংগ্রাম। দেশের মানুষ তাঁকে বলল, “গণতন্ত্রের মানসকন্যা”।
স্বাধীনতা বিরোধী দেশি-বিদেশী শক্তির প্রচণ্ড বাঁধা, ষড়যন্ত্র, তাদের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আর নির্বাচনী কারচুপি আটকে দিল ৯১ সালের নির্বাচনী বিজয়। থামলেন না তিনি। সে নির্বাচনের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তিদের নিয়ে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসলেন যুদ্ধাপরাধের বিচার। তাঁর সংশ্লিষ্টতায়, তত্ত্বাবধায়নে গঠন হলো একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি। জনমত সংগঠিত হল ঘাতকদের বিচারের দাবীতে। গণআদালত গঠন করে দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষেরা গোলাম আযম এবং অন্যান্য শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় দিল। স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-বিএনপি’র সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা হলো সে রায় কার্যকরের। রায় কার্যকর করা দূরে থাক ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নেতৃবৃন্দের উপর নেমে আসলো দেশদ্রোহিতার হুলিয়া। সে হুলিয়া নিয়েই পরলোকে গমন করলেন আন্দোলনের নেতা, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।
ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন বাংলাদেশ রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দেয়। স্বাধীনতা বিরোধীদের আস্ফালনে অবদমিত হয়ে থাকা জনমানবের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পাখা মেলতে শুরু করে। জামায়াত-বিএনপি’র আয়োজনে মাগুরায় কেন্দ্র দখল করে সিল পেটানোর নির্বাচন বলে দেয় – জামায়াত-বিএনপি’র অধীনে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়; নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান না করা গেলে জনমতের প্রতিফলন হবে না। আবার আন্দোলন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্দোলন। এ আন্দোলনের দাবী এতটাই জনমত অর্জন করেছিল যে সরকারী কর্মকর্তারা পর্যন্ত সচিবালয় ছেড়ে রাজপথে এসে দাবী না মেটা পর্যন্ত লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যায়। জামায়াত-বিএনপি সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার সুযোগ পায়। মানুষ ফিরে পায় ৭৫ এ হারানো বাংলাদেশকে।
শেখ হাসিনা যখন ৯৬ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি; দারিদ্র তালিকায় ৩/৪ নম্বরে; সুদান, ইথিওপিয়ার কাছাকাছি। সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর ৯৮ সালের বন্যা মোকাবেলা করে মাত্র দুই/চার বছরের মধ্যে তিনি দেশকে খাদ্যে স্বয়ং-সম্পূর্ণ করে তোলেন; স্বাস্থ্য সেবা দরিদ্র মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য দেশজুড়ে চালু করেন কমিউনিটি ক্লিনিক; দেশজুড়ে গড়ে উঠতে থাকে রাস্তা-ঘাট, পুল-কালভার্ড। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের সময়কালে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি হারের গড় দাঁড়ায় ৫.২০% যা তাঁর পূর্ববর্তী সরকারের সময় ছিল ৪.৩২%। সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য রাজনীতির যে আদর্শ বঙ্গবন্ধু রেখে গেছেন শেখ হাসিনা শুধু সে আদর্শ অনুসরণ করে চলেছেন বলেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দারিদ্র হ্রাস হয়েছে তার প্রথম পাঁচ বছরে।
২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের সবগুলো সরকারের মধ্যে সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি কাজ করেও ২০০১ সালের নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারেননি শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। পরাজয়ের দায় স্বীকার করে তিনি দলের সভাপতির পদ ছেড়ে দিতে চাইলেও তা হতে দেয়নি তাঁর দলীয় সহকর্মীরা। ভারতের কাছে দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রয়ে রাজী না হওয়াই ছিল সে পরাজয়ের কারণ।কমদামে গ্যাস পাওয়ার জন্য বিজেপি’র নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার এবং দেশে গ্যাস উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত আমেরিকান কোম্পানিগুলোর নগদ স্বার্থ রক্ষার্থে আমেরিকা সরকার বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপর তাদের প্রভাব খাটিয়ে এবং এদেশের মার্কিন দালালদের নিয়ন্ত্রিত পত্রিকাগুলোকে কাজে লাগিয়ে২০০১ এর নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে ফেলে।
২০০৮ সালে “দিন বদলের সনদ” শিরোনামে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে এবং তার মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করে রাজনৈতিক পরিবেশ বদলে দেয় শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের জনগণ এই প্রথম দেশের ভবিষ্যতের কাঙ্ক্ষিত চিত্র দেখতে পায়। নবীনেরা, প্রবীণেরা বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পথ দেখতে পায়; শুনতে পায় উন্নত ভবিষ্যতের আহ্বান। ভূমিধ্বস বিজয় ছিনিয়ে এনে প্রথমেই তিনি সমাপ্ত করেন সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের অসমাপ্ত কাজ যা তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর প্রথম সরকারের সময়। এরপর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু করলে দেশ-বিদেশ থেকে নেমে আসে প্রচণ্ড চাপ। দেশের মধ্যে জামায়াত-বিএনপি শুরু করে হত্যা, ধ্বংস। শত শত মানুষ, পুলিশ হত্যা করে; অফিস-আদালত, যানবাহন জ্বালিয়ে দিয়ে স্বাধীনতা বিরোধীরা নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে। সুশীলেরা বলতে থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারছ না, ক্ষমতা ছাড়।
স্বপ্নের পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজ শুরু হলে এ দেশিয় দালালদের সহায়তায় হিলারি ক্লিনটনের নেতৃত্বাধীন আমেরিকান পররাষ্ট্র দফতর বিশ্বব্যাংকের উপর প্রভাব বিস্তার করে দুর্নীতির ভুয়া অভিযোগ তুলে বন্ধ করে দেয় পদ্মাসেতুর অর্থায়ন। পেছনে কলকাঠি নাড়েন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশী ডঃ মুহম্মদ ইউনুস। নিজের প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম করে নির্বাহী প্রধানের পদ আঁকড়ে থাকা নোবেল বিজয়ী বন্ধুর চাকরী বাঁচাতে ঢাকায় ছুঁটে আসেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি সরাসরি হুমকি দেন পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করার। বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিয়ে বিমানে উঠতে না উঠতে আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলে ওঠেন, হিলারি সাহেবদের কথায় বাংলাদেশ চলে না। কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মেলান মতিয়া চৌধুরী। বাংলাদেশে শেষ হতে শুরু করে মার্কিন আধিপত্য। কিছুদিন পরেই একাত্তরের ঘাতক কশাই কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড ঠেকাতে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেন হিলারি ক্লিনটনের উত্তরসূরি জন কেরি। কেরিকে শেখ হাসিনা তৎক্ষণাৎ ফোনে জানিয়ে দেন, বাংলাদেশের আইন-কানুন অনুসরণ করে কাদের মোল্লার বিচারের রায় কার্যকর হচ্ছে। যাদের অঙ্গুলি হেলনে দেশে দেশে যুদ্ধ বেঁধে যায়, লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ যায় তেমন একজন গদীনাসীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখের উপর এমন জবাব দেয়া ঝুঁকিপূর্ণ, সুদূর প্রসারী ফলাফল বহনকারী এবং অত্যন্ত সাহসী কাজ ছিল। এই ফোন কলের পরেই বাংলাদেশ রাজনীতি থেকে বিদায় নেয় পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ; বাংলাদেশ হয়ে ওঠে সত্যিকার অর্থে সার্বভৌম; শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন বিশ্বনেতা।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে আমেরিকা তার সকল শক্তি নিযুক্ত করে জামায়াত-বিএনপি’র পতাকা তলে। হেফাজতে ইসলাম চিরকাল জামায়াত বিরোধী হলেও এসময় আবির্ভূত হয় একই মঞ্চে। চিরকাল জামায়াত-বিএনপি রাজনীতির বিরোধিতা করা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি কমিউনিস্ট পার্টিসহ অনেক বাম দল জামায়াত-বিএনপি’র সুরে সুর মিলিয়ে বর্জন করে ১৪ সালের নির্বাচন। জামায়াত-বিএনপি জোটের নির্যাতন ভোগ করা জাতীয় পার্টিও সেসময় মহাজোট ভুলে জামায়াত-বিএনপি’র সঙ্গে যোগ দিতে চেষ্টা করে। জামায়াত-বিএনপি-আমেরিকার সকল চেষ্টা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ব্যর্থ করে দিয়ে যথা সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নতুন সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। নতুন সরকার গঠন করার পর শেখ হাসিনাকে মোকাবেলা করতে হয় নতুন সন্ত্রাসের – জঙ্গিবাদ। জামায়াত-বিএনপি’র সন্ত্রাসী, জঙ্গিদের সে উত্থান দমন করে দেশকে অর্থনৈতিক উন্নতির পথে চালিত করেন শেখ হাসিনা।
কশাই কাদেরের দণ্ড প্রদানে বাধা দেয়া জন কেরি ১৬ সালে ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন, “বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল”। বঙ্গবন্ধু হত্যার নীলনকশা প্রণয়নকারী আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতির সামনে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে পরিদর্শন বইতে লিখেছেন, “সহিংস ও কাপুরুষোচিতভাবে বাংলাদেশের জনগণের মাঝ থেকে এমন প্রতিভাবান ও সাহসী নেতৃত্বকে সরিয়ে দেওয়া কী যে মর্মান্তিক ঘটনা। তারপরও বাংলাদেশ এখন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে, তাঁরই কন্যার নেতৃত্বে। যুক্তরাষ্ট্র তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণে বন্ধু ও সমার্থক হতে পেরে গর্ববোধ করে। আমরা এখন এ সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিতে চাই এবং শান্তি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা যৌথভাবে কাজ করছি।”
গত বছর আগস্টের শেষ দিকে মায়ানমারের আরাকান রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের প্রতি সহিংসতা শুরু হলে বাংলাদেশে নামে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল। শেখ হাসিনা বলেন, ১৬ কোটি মানুষের খাবার জোগাড় করতে পারলে আমরা আরও ১২ লক্ষ লোকের আহার সংগ্রহ করতে পারব; প্রয়োজনে হলে খাবার ভাগ করে খাব; এই নির্যাতিত মানুষদের আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি না। তাঁর এই পদক্ষেপে সারাজাহান বাংলাদেশকে প্রশংসায় ভরিয়ে দেয়। বিখ্যাত ব্রিটিশ মিডিয়া, চ্যানেল ফোর তাঁকে খেতাব দেয়, “মাদার অব হিউম্যানিটি”। দুবাইর প্রভাবশালী দৈনিক খালিজ টাইমস বলে, “পূর্বের নতুন সূর্য”।দিল্লিতে বিজেপির দেওয়া সম্বর্ধনায় বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা এল কে আদভানী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতিতে শেখ হাসিনা সম্পর্কে বলেন, “শেখ হাসিনাই বর্তমান সাউথ এশিয়ার মূল নেতা”।
শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের আরও পরিচয় পাওয়া যায় নিউ ইয়র্কে। ১৭ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী ঢল আসার কয়েক দিন পর সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গেলে সেখানে সাংবাদিকেরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে রোহিঙ্গা বিষয়ে কথা হয়েছে কি-না জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, “তাঁর সঙ্গে কথা বলে কী করব, আমরাতো তাঁর শরণার্থী নীতি সম্পর্কে জানি”। এ কথা বলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে ঘোষণা আসে, রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশের পাশে থাকবে আমেরিকা। শেখ হাসিনার জন্য বহু সম্মান, স্বীকৃতি এসেছে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ, সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠান, জাতিসংঘ থেকে। বিভিন্ন ইস্যুতে পরামর্শ দেবার জন্য কয়েকবার আমন্ত্রণ পেয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সাত দেশের সংগঠন জি৭ সম্মেলনে যোগ দেবার। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী জনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখায়, এ ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতৃত্ব দেয়ায় জাতিসংঘ তাঁকে খেতাব দিয়েছে, “চ্যাম্পিয়ন অফ দ্যা আর্থ”। শেখ হাসিনার নারী উন্নয়ন নীতির ফলাফল স্বরূপ সমাজের সকল পর্যায়ে নারীর অংশ গ্রহণ, নেতৃত্বদান বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁকে জাতিসংঘের ইউএনওমেন “এজেন্ট অফ চেঞ্জ” পুরস্কার প্রদান করে।
সততা, সাহসিকতা আর দেশ ও দেশের মানুষের জন্য গভীর ভালবাসা, সারা দুনিয়ার মানুষের মঙ্গল চিন্তা, বিশ্বমানবের প্রতি ভ্রাত্রিত্ববোধ, মানব সভ্যতার প্রতি দায়িত্ববোধ জননেত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে এসেছে এতটা পথ। দেশীয় রাজনীতিতে তাঁর বিরোধীরাও আজ স্বীকার করে তাঁর অনন্য নেতৃত্বের গুণাবলী। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত এই বিশ্ব নেতার এখন ডাক পরে আন্তর্জাতিক সমস্যাবলী সমাধানে। অন্যতম প্রধান নারী নেত্রী হিসেবে আজ তিনি স্বীকৃত। তাঁর তুলনা হয় জার্মান লৌহমানবী এঞ্জেলা মার্কেল এবং সুদক্ষ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র সঙ্গে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি, ছিটমহল চুক্তি, দুইটি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কোন রকম বিবাদ সৃষ্টি না করে সমুদ্র সীমার অধিকার আদায় করে নেয়া এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আন্তরিকতার সঙ্গে আশ্রয় দেবার জন্য অচিরে তাঁকে বিশ্ব নেতা হিসেবে, শান্তির দূত হিসেবে স্বীকার করে নেবে টাইমস ম্যাগাজিন, নোবেল কমিটি – এমন প্রত্যাশা এখন প্রতিটি বাঙালির, বাংলাদেশীর।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)