গ্রাম বাংলার আর আট-দশটা পরিবারের মতো সারাদিনের কাজ শেষে অবসরে একান্তে স্বামীর বুকে স্ত্রীরা মাথা গুঁজে ঠাই নিবে, আশা ভালবাসার কথা শোনাবে, প্রকৃতির অপরূপ লীলায় সুসজ্জিত গ্রামীণ পরিবেশে এমনটিই পরিলক্ষিত হয়। এখনো বাংলাদেশের গ্রামীণ আবহে সাজানো পরিবারের এমন পারিবারিক সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে মূল্যায়ন করা হয়। কিন্তু বাংলার নয়নমণি, মমতাময়ীর প্রতীক ফজিলাতুন নেছার ইতিহাসটা একটু ভিন্নভাবেই লিখে থাকবেন কবি সাহিত্যিকরা। ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সোনালী সময়ের অধিকাংশই কেটেছে স্বামীর সঙ্গ ছাড়াই। সে সময়টায় তার স্বামী রাজনৈতিক আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। প্রজ্ঞার সম্মিলনে অমলিন ফজিলাতুন নেছা মুজিব কখনো স্বামীর স্বাধীনতাকে নিজের মাঝে নিয়ে আসেননি। জীবনের শ্বাশত যাত্রায় জৈবিক চাহিদাকে জলাঞ্জলি দিয়ে আত্মজৈবনিক পথের দ্বার উন্মোচন করেছিলেন, স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুতে যথাযথ ভূমিকা পালনে সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
সংসার জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা বিরাট সময় স্বামীর সাহচর্য ছাড়াই কাটিয়েছেন। কিন্তু এতে তাদের দাম্পত্য জীবনে কখনো চিড় ধরেনি, মনোমালিন্যও হয়নি সামান্য সময়ের জন্য। ব্যক্তিস্বার্থ বাদ দিয়ে তিনি বৃহৎ অর্জনের জন্য চিন্তা করেছিলেন। কেননা, সুখানুভূতি এক একজনের কাছে ভিন্নমাত্রা পায় একেক দৃষ্টিকোণ এবং উপলব্ধির অনুধাবনে। আত্মসংবেদনশীল ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সুখের তাৎপর্য বিশেষ ব্যতিক্রমধর্মী, অনন্য সাধারণ ও বিরল। তবে স্বামীর নিবিড় বন্ধনকে কখনো মিস করতে চাইতেন না। যতটুকু সময় পেয়েছেন নিজে এবং সন্তানদের স্বামীর সাহচর্যে নিয়ে আসতেন। তাদের মধ্যকার পারস্পরিক বোঝাপড়া ছিল বহু গুণে গুণান্বিত। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ছিল চোখে পড়ার মত। দুইজন দুইজনের মতামতকে খুব সমীহ করতেন, সম্মান দিতেন। যেকোন বিষয় নিয়ে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত নিতেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব ও বঙ্গবন্ধু।
স্বামীর সাথে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সম্পর্কের গভীরতা বিভিন্ন জায়গায় উঠে এসেছে। স্বামীর প্রত্যেকটি কাজে ফজিলাতুন নেছা দ্বিধাহীন চিত্তে সমর্থন দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবও সাংসারিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ফজিলাতুন নেছার প্রত্যেকটি কথায় গুরুত্ব আরোপ করতেন যথাযথ মর্যাদায়। একটি ঘটনার উল্লেখ করে শেখ মুজিব বলেন- “রেণু আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় নীরবে চোখের পানি ফেলছিল। আমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম না, একটা চুমা দিয়ে বিদায় নিলাম। বলবার তো কিছুই আমার ছিল না। সবই তো ওকে বলেছি।” ছোট একটা উদাহরণের মাধ্যমে পারিবারিক দৃঢ়তা ও ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ সুস্পষ্ট। পারিবারিক টানাপোড়েনের মধ্যেও কখনো কোন মনোমালিন্য হয়নি তাদের সংসার জীবনে। তাদের পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকের সাথে কথা বলে জানা যায়- পারিবারিক জীবনে ফজিলাতুন নেছা ও শেখ মুজিবের সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ রাজনীতির পরিবেশকে অনেকটা সহজতর করেছিল সাধারণ কর্মীদের জন্য। সাধারণ কর্মীদের প্রবেশাধিকার ছিল এই দম্পত্তির নিকট অবলীলায়। সামান্য থেকে গুরুতর য কোন প্রয়োজনে নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ কোন ধরণের নিয়মের তোয়াক্কা না করেই প্রবেশ করতে পারতেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে।
কারাবাসের ফাঁকে যখন বঙ্গবন্ধু বাইরে থাকতেন তখন বঙ্গজননীর সাথে সাংসারিক আলোচনা, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক অবস্থা, রাজনৈতিক অবস্থা, দলের নির্যাতিত নেতাদের মামলা চলাকালীন মামলার হালনাগাদ ইত্যাদি কর্মপন্থা সম্বন্ধে ব্যাপক আলোচনা করতেন। স্বামীর প্রতি দায়িত্ববোধের কারণে টুঙ্গিপাড়া থেকে সংসার টেনে ঢাকায় নিয়ে আসেন। স্বামীর প্রতি কর্তব্যের ত্রুটি করতে চাইতেন না কখনো বঙ্গজননী। ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন এবং রাজনৈতিক জীবন বিকাশের জন্য তার একান্ত সান্নিধ্য ও সাহচর্যের দরকার ছিল। সবগুলো বিষয়ের সারসংক্ষেপ করে সিদ্ধান্ত আনুযায়ী ১৯৫৪ সালে ঢাকায় পাকাপাকিভাবে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন ফজিলাতুন নেছা।
টুঙ্গিপাড়ার বিশাল দিগন্ত বিস্তৃত পরিমণ্ডলের জায়গা ছেড়ে ঢাকার ঘিঞ্জি পরিবেশে এসেও সকল প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে রেণু মহাসুখী, আনন্দের আতিশয্যে রোমাঞ্চিত। কারণ, স্বামীর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ তো হবে সেই আশায়, স্বামীর সুখ দুঃখের সাথী হবে সেই প্রত্যাশায়। সারাদিনের কর্মযজ্ঞ শেষ করে ক্লান্ত শ্রান্ত বিশাল ব্যক্তিত্বের মানুষটিকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে সেবা শুশ্রুষা করতেন। মনের মাধুরী মিশিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর পছন্দের খাবারগুলো টেবিলের সামনে পরিবেশন করতেন, যদিও এ সুযোগটি কম ঘটেছিল রেণুর জীবনে। বহুমুখী গুণের কারণে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তি ফজিলাতুন নেছাকে সম্মান ও মর্যাদার সহিত মূল্যায়ন করতেন। ক্রমান্বয়ে ফজিলাতুন নেছা ও বঙ্গবন্ধু একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন। পারিবারিক কিংবা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে দুইজন মিলেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন রাজনীতির কবি, সৎ রাজনীতিবিদের উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। রাজনীতির প্রয়োজনে বাড়ি থেকে বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সাহায্য নিতে হতো। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রয়োজনে অতিরিক্ত অর্থের যোগান দিতেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বঙ্গবন্ধুর কারাবরণের দিনগুলোতে সাংসারিক চাহিদা মেটাতে তিনি ঘরের তৈজসপত্র বিক্রি করতে পিছপা হননি, এমনকি নিজের অলংকার ও গহনাগাটি। কিন্তু কখনো বঙ্গবন্ধুকে কিছু বুঝতে দিতেন না। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর বিভিন্ন স্মৃতি রোমন্থনে শেখ মুজিব উল্লেখ করেছেন- “রেণুও কিছু টাকা দিল গোপনে। আব্বার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা করলাম, এপ্রিল মাসের ২য় সপ্তাহে। হাসিনা ও কামাল আমাকে ছাড়তে চায় না, ওদের উপর আমার খুব দুর্বলতা বেড়ে গেছে। রওয়ানা করার সময় দুই ভাইবোন খুব কাঁদল।” পারিবারিক দায়িত্ববোধও যে মাঝেমধ্যে রাজনীতিবিদদের সিক্ত করে দেয় সে চিত্রটি এ সাক্ষাতে ফুটে উঠেছে নিঃসন্দেহে। তবে শেখ মুজিবের ধ্যান জ্ঞান পেশা ছিল রাজনীতি করা যেখানে অন্য সবকিছু ছিল গৌণ। বাঙালির মুক্তির জন্য তিনি সারাটা জীবন নিজের জীবনের স্বাদ, আহলাদ সবকিছুই বিসর্জন দিয়েছিলেন। আর এ জন্য তাকে যোগ্য সহযোগিতা করেছেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব।
রেণু খুব সাদামাটা জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। নিজের স্বাধ-আহ্লাদ, ভোগ-বিলাস সম্বন্ধে তেমন কোন নজির পাওয়া যায়নি। তবে ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে তিনি খুব সতর্ক ছিলেন। শেখ মুজিবের প্রথম সন্তানটি বাঁচেনি, সেজন্য মনোকষ্টে ভোগেন ফজিলাতুন নেছা। সেই দুঃসময়ে স্ত্রীকে সময় দিতে পারেননি বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক কর্মপরিধির কারণে। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর ঘর আলোকিত করে পৃথিবীতে আসেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময়টাতে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে ব্যস্ত ছিলেন জাতির জনক। ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঘর আলো করে রেণুর বুকে আসে শেখ কামাল। নিজের ব্যাপারে উদাসীন থাকলে পরিবারের সদস্যদের প্রতি আমৃত্যু ছিল মমতাময়ীর দৃষ্টি। নিজের পরিবার এবং সন্তানদের জন্য নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেও পিছপা হননি ফজিলাতুন নেছা। শ্বশুর-শ্বাশুড়ী এবং পারিবারিক আত্মীয়-স্বজনদের জন্যও নিজের ব্যক্তিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পড়াশোনার প্রতি অদম্য আগ্রহ ছিল রেণুর। অধিকাংশ সময়ই স্বামী রাজনৈতিক কাজে বাড়ির বাইরে থাকতেন, সে সময়টাতে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রবোধ স্যানাল, বিভূতি ভূষণ প্রভৃতি স্বনামধন্য লেখকের লেখা পড়তেন নিয়মিত। গান শোনার খুব শখ ছিল ফজিলাতুন নেছার। স্বামীর সাথে মুক্ত আলোচনায় তিনি রাজনৈতিক ও পারিপার্শ্বিক সমাজ চিন্তন নিয়ে আলোচনা করতেন। তাদের আলোচনার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় মানুষ বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে ছোট ছেলের নাম রাখা হয় শেখ রাসেল। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনের বহু মানুষের সম্বন্ধে সম্যক ধারণা ফজিলাতুন নেছাকে স্বামীর প্রতি আরও বেশি অনুরাগী ও আবিষ্ট করে তোলে যার কারণে নিবিষ্ট চিত্তে তিনি স্বামীকে ভালবাসতেন, স্বামীর কাজকে মর্যাদা দিতেন সর্বক্ষণ। স্বামীর একনিষ্ঠ রাজনীতির সাথে লেগে থাকাকে তিনি মূল্যায়ন করতেন গুরুত্ব দিয়ে, অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করতেন।
চলবে…