দেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্টে ফুটে উঠা অসহায়ত্বের চিত্রের সঙ্গে জাতীয় অসহায়ত্বের মিল খুঁজে পাচ্ছেন মানবাধিকার কর্মী এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল। মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে নাগরিকদের পাশে দেশ দাড়াচ্ছে না বা বিচার করছে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার কারওয়ান বাজারের ডেইলি স্টার সেন্টারে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৭’র মোড়ক উন্মোচন এবং আলোচনা সভার প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি আরও বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করেন।
সুলতানা কামাল বলেন, দেশে আজ এমন এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে যে শুধু আদিবাসীরাই নয়, প্রতিটি মানুষ মনে করছে আমাদের কিছু করার নেই।
কাপেং ফাউন্ডেশেন পরিচালিত ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালে আদিবাসী কর্মীদের চরম উদ্বেগ ও ভীতির মধ্যে থাকতে হয়েছে। ২০১৭ সালের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে শারীরিক নির্যাতন ও মৃত্যু, আদিবাসী কর্মীদের নানা অজুহাতে গ্রেফতার করা, বিভিন্ন ঘটনায় জড়িত করে সাজানো মামলা দায়ের করা, আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন ও মারধর করা, অস্ত্র গুজে দিয়ে জেলে প্রেরণ করা ইত্যাদি নিপীড়ন-নির্যাতন উদ্বেগজনকভাবে অব্যাহত রয়েছে।
সুলতানা কামাল বলেন, আজ আমাদের দেশের কিছু মানুষ মনে করছে, এই দেশটা আমার না। কেন আমার না? কারণ এই দেশটা আমাকে আর আশ্রয় দিচ্ছে না। দেশটা আমার পাশে দাঁড়াচ্ছে না। আমার যখন অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তখন এই দেশটা তার বিচার করছে না।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন বিষয় উল্লেখসহ গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ে, আদিবাসীদের ২০ হাজার একর জমি দখল করা হয়েছে, আদিবাসী নারীর বিরুদ্ধে খুন-ধর্ষণসহ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৪৮টি (সমতলে ২০টি, পাহাড়ে ২৮ টি)।
খারাপ দৃষ্টান্ত কখনও উদাহরণ হতে পারে না উল্লেখ করে সুলতানা কামাল বলেন, সব দেশেই অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। হয়তো আমাদের দেশে যতটা হচ্ছে অন্য কোন দেশে তার চেয়ে বেশি হচ্ছে, অনেকসময় সে দেশের মানুষও বিচার পাচ্ছে না। কিন্তু সেটাই কি আমাদের দৃষ্টান্ত হবে? অনুকরণীয়, অনুস্মরণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে? নাকি একটা মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া দেশ, যে দেশটা একেবারে স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দিলো, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করছি এমন একটা দেশের জন্য যে দেশে সব মানুষের অধিকার সম্মানিত হবে। সব মানুষের মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং সেই দেশে যখন মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে, তার প্রতিকার আমরা চাইবো না? প্রতিকার আমরা পাবো না? তাই যদি হয় যে অধিকার লঙ্ঘিত হলে প্রতিকার পাবো না, তাহলে মুক্তিযুদ্ধটা আমরা করলাম কিসের জন্য?
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তিনি এও বলেছিলেন যে প্রত্যেকটা মানুষ যেন অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হয়। অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে। এবং সেখানে কিন্তু তিনি বেছে বেছে বলেননি যে, কিছু মানুষ লড়াই করবে, কিছু মানুষ সবকিছু করবে, অন্য কেউ কিছু করবে না।
‘‘হ্যাঁ তিনি বলেছিলেন যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো। ঠিক আছে। কিন্তু নেতৃত্বটা কিসের জন্য দিতে বলেছিলেন? আজকে যে উদাহরণগুলো আসছে সেটার জন্য? জমি দখল, মানুষের অধিকার লঙ্ঘণ, বিচারহীনতা, নারীর ওপরে নির্যাতন সেটার জন্য সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলতে বলেছিলেন? নাকি যাতে এগুলো না হয় সে জন্য সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছিল?’’
নিজেদের বঙ্গবন্ধুর ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দল দাবি করলেও আওয়ামী লীগ সে দায়িত্ব পালন করছে না মন্তব্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ সাবেক উদেষ্টা বলেন, আজ তারা ক্ষমতায় আছে। বঙ্গবন্ধুর দল এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি বলে সমাজে সব রকম সুবিধা, সম্মান, মর্যাদা তারা দাবি করছেন। সেই জায়গা থেকে তাদের যে দায়িত্ব সেটা কেন পালন করছেন না? তাদের কথার সঙ্গে কাজের কোন মিল খুঁজে পাই না কেন? আজকে সরকারের কাছে আমাদের এটাই প্রশ্ন।
তিনি বলেন, জাতির অংশ হিসেবে আমাদের এখানে দাঁড়িয়ে বলার অধিকার রয়েছে যে আমরা বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলতে দিতে পারি না। মানবাধিকার লঙ্ঘন দিনের পর দিন হয়ে যাবে আর আমরা চুপ করে থাকবো সেটা হতে পারে না।তাই প্রতিটি মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষের উচিত নিজের জায়গা থেকে আওয়াজ তোলা।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও বক্তব্য দেন আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস’র সদস্য উষাতন তালুকদার এমপি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক বাঞ্চিতা চাকমা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন কাপেং ফাউন্ডেশন এবং জাতীয় আদিবাসী ফোরামের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন।