শিশু আইন ও আদালত নিয়ে বর্তমানে নিম্ন আদালত ও হাইকোর্টে এক ধরনের বিচারিক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে বলে এক রায়েই উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট।
পুরান ঢাকার মো. ওসমান হত্যা মামলার আসামি শিশু মো. হৃদয়ের জামিন আবেদন বিষয়ক রায়ে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ কথা বলেছেন।
বুধবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এ রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, দৈনন্দিন বিচারিক কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে এ কথা উচ্চারণে আমাদের দ্বিধা নেই যে, শিশু আইন ও আদালত নিয়ে বর্তমানে নিম্ন আদালত ও হাইকোর্টে এক ধরনের বিচারিক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।
এ রায়ে আরো বলা হয়: শিশু আইনে সাংঘর্ষিক অবস্থা, বিদ্যমান অসংগতি, অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি অবিলম্বে দূর করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে সরকার দ্রুততার সঙ্গে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলেই আদালতের প্রত্যাশা।
আর সরকার শিশু আইন সংশোধন অথবা শিশু আইন ২০১৩-এর ধারা ৯৭-এর বিধান মূলে গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা অস্পষ্টতা ও অসংগতি দূর করতে পারে বলে রায়ে বলে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এই রায় ও আদেশের কপি প্রয়োজনীয় অবগতি ও ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট আদালত/ট্রাইব্যুনালসহ সমাজকল্যাণ ও আইন সচিব এবং সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রকাশিত রায়ে আরো বলা হয়েছে: আমাদের বলতে দ্বিধা নেই যে, শিশু আইনের ১৫ ক ধারা, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৭ নম্বর ধারা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০-এর ২৭ নম্বর ধারা এবং ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৮ নম্বর ধারাসহ বিভিন্ন বিশেষ আইনের সঙ্গে শুধু অসংগতিপূর্ণ নয়, সাংঘর্ষিকও বটে।
আর শিশু আইনের প্রাধান্যতার কারণে যদি যুক্তি দেয়া হয় যে, থানার দায়েরকৃত মামলা অর্থাৎ জি.আর মামলার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধ আমলে গ্রহণ করবেন তাহলে সেটা হবে শিশু আইন প্রণয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। শুধু তাই নয়, একই আইনের অধীনে শিশুর বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গ্রহণ করবেন ম্যাজিস্ট্রেট, আর প্রাপ্ত বয়স্কদের বিরুদ্ধে অপরাধ আমলে গ্রহণ করবেন সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনাল বা ক্ষেত্রমত আদালত যা বাস্তবতা বিবর্জিত এবং অদ্ভুত বা অস্বাভাবিক একটি প্রস্তাবনা।
আদালত রায়ে বলেছেন, শিশু আইন-২০১৩ প্রণয়নের মূল লক্ষ্যই ছিল শিশুদের (আসামি, ভিকটিম ও সাক্ষী) সর্বোত্তম স্বার্থ সংরক্ষণ করা। আদালতে শিশুবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা। কিন্তু এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, দেশের শিশু আদালতসমূহে এখন পর্যন্ত শিশু বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। সেক্ষেত্রে শিশু আদালতের বাইরে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতসমূহে এই মূহূর্তে শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা নিঃসন্দেহে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এটা বাস্তবতা যে, শিশু আইন-২০১৩-এর ১৬ক, ১৫ক এবং ১৬(৩) ধারা সংযোজিত হওয়ায় বিভিন্ন ধরনের সংশয়, বিভ্রান্তি এবং সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে শিশুদের সর্বোচ্চ স্বার্থ নিশ্চিতের লক্ষ্যে সৃষ্ট সংশয়, বিভ্রান্তি ও অসংগতি দূর করা অতি জরুরি।
আদালত রায়ে বলেন, এখানে উল্লেখ করা আরো প্রাসঙ্গিক হবে যে, শিশু আইনের অধীনে কোনো আদেশ প্রদানকালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের নাম, সিল ও পদবী ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। আমরা লক্ষ্য করছি যে, বিচার পূর্বকালীন বিভিন্ন আদেশ প্রদানকালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের নাম, সিল ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে সংক্ষুব্ধ পক্ষের উচ্চতর আদালতে আসার ক্ষেত্রে এখতিয়ার নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে।
এদিকে ভবিষ্যতে জটিলতা এড়াতে ৭ দফা নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলেছেন হাইকোর্ট।
নির্দেশনাগুলো হলো-
১. সংশ্লিষ্ট ম্যাজিষ্ট্রেট কেবলমাত্র মামলার তদন্ত কার্যক্রম তদারকী করবেন এবং এ সংক্রান্ত নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় আদেশ এবং নির্দেশনা প্রদান করবেন।
২. রিমান্ড সংক্রান্ত আদেশ শিশু আদালতেই নিষ্পত্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে, আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু (ভিকটিম এবং সাক্ষী) বা আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর জবানবন্দী সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট লিপিবদ্ধ করতে পারবেন।
৩. তদন্ত চলাকালীন আইনের সাথে সংঘাতে জড়িত শিশুকে মামলার ধার্য তারিখে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজিরা হতে অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে।
৪. তদন্ত চলাকালে আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর রিমান্ড, জামিন, বয়স নির্ধারণসহ অন্তর্বর্তী যেকোন বিষয় শিশু আদালত নিষ্পত্তি করবে এবং এ সংক্রান্ত যেকোন আবেদন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দাখিল হলে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট নথিসহ ঐ দরখাস্ত সংশ্লিষ্ট শিশু আদালতে প্রেরণ করবেন এবং সংশ্লিষ্ট শিশু আদালত ঐ বিষয়টি নিষ্পত্তি করবে।
৫. অপরাধ আমলে গ্রহণের পূর্বে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল শিশু আইনের অধীনে কোন আদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে ‘শিশু আদালত’ হিসেবে আদেশ প্রদান করবে এবং এক্ষেত্রে বিচারক শিশু আদালতের বিচারক হিসেবে কার্য পরিচালনা এবং শিশু আদালতের নাম ও সিল ব্যবহার করবেন।
৬. আইনের সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি হলো এই যে, আইন মন্দ বা কঠোর হলেও তা অনুসরণ করতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তা সংশোধন বা বাতিল না হয়। নালিশী মামলার ক্ষেত্রে শিশু কর্তৃক বিশেষ আইনসমূহের অধীনে সংঘটিত অপরাধ সংশ্লিষ্ট বিশেষ আদালত বা ক্ষেত্রমত, ট্রাইব্যুনাল শিশু আইনের বিধান ও অত্র রায়ের পর্যবেক্ষণের আলোকে অভিযোগ গ্রহণের পর প্রয়োজনীয় আইনি কার্যক্রম গ্রহণের পরে অপরাধ আমলে গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কাগজাদি (নথি) সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করবে। অতঃপর ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধ আমলে গ্রহণের বিষয়ে প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান এবং অপরাধ আমলে গ্রহণ করলে পরবর্তীতে কাগজাদি বিচারের জন্য শিশু আদালতে প্রেরণ করবেন।
৭. শিশু আইনের প্রাধান্যতার কারণে বিশেষ আইনসমূহের অধীনে জি.আর মামলার ক্ষেত্রে শিশু কর্তৃক সংঘটিত অপরাধের জন্য পৃথক পুলিশ রিপোর্ট দেওয়ার বিধান থাকায় সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে অপরাধ আমলে গ্রহণ করবেন।