চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘শিশু অপহরণকারীরা বাবা-মায়ের অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছে’

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে আশংকাজনক হারে বেড়েছে শিশু অপহরণ এবং অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যার ঘটনা। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে এসে শিশু নির্যাতনের পর হত্যার ঘটনা বেড়েছে ৩৩ শতাংশ।

আসক’র তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে শিশু অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যার ঘটনা ছিলো ৯৯টি। ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩৩-এ। শিশু অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যার ঘটনায় পুলিশের দ্রুত পদক্ষেপের অভাবের পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থতাও নানা সময় এসেছে আলোচনায়।

সম্প্রতি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার ফলদা গ্রামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দির, বাড়িঘর, স্কুল ও বিভিন্ন স্থাপনায় দুর্বৃত্তদের হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থদের সমবেদনা ও সুধী সমাবেশ শেষে একান্ত সাক্ষাতকারে চ্যানেল আই অনলাইনের মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলাদেশ সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল।

চ্যানেল আই অনলাইন: চ্যানেল আই অনলাইনের পক্ষ থেকে ভাষার মাসে আপনাকে শুভেচ্ছা। সাম্প্রতিক সময়ে অন্যান্যে অপরাধের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে অপহরণের ঘটনা। হঠাৎই অপহরণের এবং অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ কি বলে আপনি মনে করছেন?

সুলতানা কামাল: অপহরণের ঘটনা অপরাধেরই একটা অংশ। আমরা আমাদের বিভিন্ন বিশ্লেষণে যে কথাটি বারবার বলেছি বা উঠেছে এসেছে তা হলো, অপরাধ করে পার পেয়ে যাবার সংস্কৃতি। এই পার পেয়ে যাবার সংস্কৃতিটা কিন্তু সমাজে নানা ভাবে নানা কারণে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। যতদিন পর্যন্ত সেখানে একেবারে মৌলিক ভাবে কিছু কাজ করতে না পারবো যারা অপরাধ করবে তাদের মনের মধ্যে এই শংঙ্কাটা থাকবে না যে, আমি অপরাধ করলে আমাকে কোন না কোন ভাবে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে এবং শাস্তি পেতে হবে। যতোদিন পর্যন্ত আমরা এই জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা না করতে পারছি ততোদিন কিন্তু এই অপরাধের প্রবণতা বাড়তেই থাকবে। মূল কথাটা হলো অপরাধ যে করবে তাকে আইনের প্রক্রিয়াগুলি মধ্যে এনে যদি শাস্তি নিশ্চিত করা যায় তাহলে অপরাধ প্রবণতা কমানো যেতে পারে। মোট কথা হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়া খুবই জরুরী।

চ্যানেল আই অনলাইন: সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ কি?

সুলতানা কামাল: মানুষের লোভ বেড়ে গেছে অনেক বেশি। কম খাটুনি দিয়ে অনেক বেশি অর্থ উপার্জন করতে চায়। যার জন্য আমারা দেখি টেন্ডারবাজী, ঘুষের টাকার ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি। কেউ কিন্তু কোন শ্রম দিয়ে, মৌলিক কাজের মধ্যে দিয়ে, কিংবা অর্জনের অর্থের দিকে নজর না দিয়ে অনেক সহজে অর্থ উপর্জনের যে প্রক্রিয়াগুলি রয়েছে তার দিকে নজর দিচ্ছে। আর সে দেখে আসছে যে, অপরাধ করে সমাজে কোন শাস্তি পেতে হচ্ছে না।

চ্যানেল আই অনলাইন: শিশুরাই কেনো বেশির ভাগ সময়ে অপহরণের শিকার হচ্ছে?

সুলতানা কামাল: শিশুদের অপহরণ করলে মা-বাবা অনেক বেশি অসহায় বোধ করে। অপহরণকারী যদি বলে আমাকে পঞ্চাশ লাখ টাকা দাও। সমর্থ থাকুক আর না থাকুক মা-বাবা যেকোন ভাবেই হোক তা ব্যবস্থা করার চেষ্টা করে। কারণ সন্তানকে যেকোন মূল্যে বাঁচাতে হবে। আরেকটি কারণ হচ্ছে শিশুরা অসহায় ও দুর্বল। এই যেমন সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা তাও কিন্তু তাদের অসহায়েত্বের সুযোগ নিয়ে।

চ্যানেল আই অনলাইন: অপহরণের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশের ভুমিকা কি এবং কি হওয়া উচিত?

সুলতানা কামাল: পুলিশের তৎপরতার যথেষ্ট অভাব আছে। তাদের সক্ষমতা, প্রশিক্ষণের যথেষ্টে অভাব রয়েছে, মানসিকতারও একটা ব্যাপার রয়েছে। পুলিশকে সক্ষম করে তুলতে হবে, পুলিশকে আরো বেশি দক্ষ করে তুলতে হবে। বিশেষ করে পুলিশের মানসিকতার ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করতে হবে।

চ্যানেল আই অনলাইন: মানবাধিকার সংগঠন গুলো কি সঠিক ভাবে কাজ করছে?

সুলতানা কামাল: পনের-ষোল কোটি জনগণের রাষ্ট্রে হাতে গুনা যে কয়টি সংগঠন কাজ করছে। তা যথেষ্ট নয়। আমাদের সংগঠনের যতোটুকো সাধ্য তা করার চেষ্টা করছি। আমারা আমাদের সংগঠনের বেলায় এবং ব্যক্তি আমি বলতে পারি তা হলো আমি বা আমরা সিন্দুতে বিন্দু। এখানে আরো বেশি মানুষকে সচেতন হয়ে কাজ করতে হবে। আমি যে কথা জোর দিয়ে বলতে চাই জনসাধারণকে, তার নাগরিক চেতনা নিয়ে আইনের শাসন, মানবাধিকার রক্ষার তার যে দায়-দায়িত্ব রয়েছে,আইন মানার যে প্রবণতা রয়েছে তা তাদের নিজেদের মধ্যে তৈরি করতে। তাৎক্ষণিক কোন ঘটনা ঘটলে হয়তো বাহিরে থেকে সামাল দেয়া যায় কিন্তু সার্বক্ষণিক, সার্বিক পরিবর্তন আনা যায় না।

চ্যানেল আই অনলাইন: আপনারা কি সঠিক ভূমিকা রাখতে বাঁধা প্রাপ্ত হচ্ছেন ?

সুলতানা কামাল: কখনো কখনো এমন হয়। আমার যেটা মনে হয় যে, সরকারের সরাসরি বিরোধিতা বা কোন কাজের সমালোচনা করলে তারা যদি মনে করেণ তাদের ভাবমূর্তি বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে তখন তাদের সাথের আমাদের বিভিন্ন মন্তব্য হয়। তর্কবিতর্কও হয়। তবে আমি মনে করি আমাদের কাজে সবসময় সচ্ছতা বজায় রাখতে হবে। যাতে প্রমাণ করতে পারি যে, আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য কাজ করছে না। অন্যদিকে সরকারেরও অন্যের কাছ থেকে সমালোচনা গ্রহণ করার প্রবণতা তৈরি করতে হবে এবং সেটা বজায় রাখতে হবে।

চ্যানেল আই অনলাইন: পুলিশ বলছে মানবাধিকার সংগঠন গুলোর কোন স্টাডি নেই। এটা ওপর তারা শুধু শুধুই পুলিশের ওপর দোষ চাপাচ্ছে! আপনি কি বলবেন?

সুলতানা কামাল: সেটা হয়তো কোন কোন মানবাধিকার সংগঠন দিয়েও থাকতে পারে, ঠিক যেভাবে কোন কোন পুলিশ অপরাধ করে থাকে। তবে তা ঠালাও ভাবে বলা সম্ভব নয়। পুলিশ যে ভিত্তিতে বলেছে সেটা প্রমাণ করার দায়িত্বও তাদের। তবে একটু আগে যে কথাটি আমি বলেছি তা আমাদের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ব্যাপারেও বলতে চাই। আমাদের সকল কাজে সবসময় সচ্ছতা বজায় রাখতে হবে। যেকোন কাজেই যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। সে ব্যাপারেও স্বীকার করে নিতে কখনো কোন অসুবিধা নাই।

চ্যানেল আই অনলাইন: মানবাধিকার নেত্রী এলিনা খান বলেছিলেন বিত্তবানদের ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা ব্যতিক্রম কেননা টাকা পাচ্ছে, আপনি কি বলবেন?

সুলতানা কামাল: এইটা সাধারণ ভাবেই কিছুটা সত্য। যাদের অর্থ আছে প্রতিপত্তি আছে তারা তার প্রভাব খাটিয়ে সহজেই অনেক কিছু আদায় করে নিতে পারেন। কিন্তু যারা দুর্বল যাদের টাকা বা প্রতিপত্তি নেই তারা সহজ ভাবেই অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে।

চ্যানেল আই অনলাইন: যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণায় দেখা গেছে একজন মানুষ শৈশব থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন মিডিয়ায় আট হাজারের মতো খুনের ঘটনা দেখে, যে পরবর্তীতে অপহরণ খুনের ঘটনাকে তার কাছে স্বাভাবিক করে তোলে। এ ক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা কি হওয়া উচিত?

সুলতানা কামাল: মডিয়া যখন এই ঘটনাগুলি দেখাবে তার আগে সেখানে একটা ভাষা ব্যবহার করা হয় সেনসেটিভ আঙ্গিকে দেখানো হয় হবে না সেনশেসনাল আঙ্গিকে দেখানো হবে। সেটার ওপরই অনেকখানি নির্ভর করছে যারা দেখছে তারা তা বিষয়টাকে কিভাবে বিশ্লেষণ করছে এবং তা থেকে সে কি শিক্ষা নিচ্ছে। এখানে মিডার যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এটা যেহেতু ঘটানাটি বাস্তব অপরাধ। তা দেখানোর দায়িত্ব যেমন মিডিয়ার রয়েছে তেমনি এমন ভাবে উপস্থাপন উচিত যে বিষটা অপরাধ ও অন্যায়। তা সমাজের জন্য মানুষের জন্য ক্ষতিকর। এবং উপস্থাপনও হতে হবে এমন ভাবে যেন তা থেকে সে সচেতন হতে পারে, শিক্ষা নিতে পারে।

চ্যানেল আই অনলাইন: এই সহনশীলতার মানসিকতা থেকে উত্তরণের উপায় কি ?

সুলতানা কামাল: যখন পর্যন্ত এই অপরাধগুলির প্রতিকার না হবে, অপরাধের শাস্তি না হবে, সমাজে অপরাধকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নত না করা হবে, তাকে প্রশ্রয় দেয়া বন্ধ না হবে ততোক্ষণ পর্যন্ত মানসিকতার পরিবর্তন হবে না । কারণ এর প্রতিকার চেয়ে যখন কোন লাভ হয় না বলেই সাধারণ মানুষ ধরে নেয় তখন অপরাধগুলি প্রাকৃতিক ভাবেই সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।

চ্যানেল আই অনলাইন: আপনাকে ধন্যবাদ।

সুলতানা কামাল: আপনাকেও ধন্যবাদ।