নুসরাত ও ফারিয়া আক্তার দোলা নামের দুই শিশু রাজধানীর ডেমরায় বিকৃত মানসিকতার বলি হয়েছে। একজনের বয়স ৪ আরেকজনের ৫ বছর। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে শিশু দুটিকে লিপস্টিকের লোভ দেখিয়ে ডেকে এনেছিল দুই ধর্ষকামী মামাতো-ফুপাতো ভাই মোস্তফা ও আজিজুল। তারা দু’জন ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে, স্বীকারও করেছে তাদের কুকর্মের দায়। ঘটনাস্থল থেকে মাদকদ্রব্য ইয়াবা, হত্যায় ব্যবহ্নত গামছা ও আরোকিছু জিনিস আলামত হিসেবে জব্দ করেছে পুলিশ।
ধর্ষণের কারণ নিয়ে দেশে নানামুখী বিতর্ক প্রচলিত আছে। ধর্ষণের কারণ খুঁজতে গিয়ে অনেকে বিতর্কিত এবং আপত্তিকর কারণ বয়ান করে থাকে৷ ধর্ষণের জন্য মেয়েদের ছোট পোশাককেও দায়ী মনে করেন কেউ কেউ৷ অনেকে মনে করেন ধর্ষণের জন্য মূলত বিকৃত মানসিকতাই দায়ী৷ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, নয়তো পারিবারীক-রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বশত হয়ে ধর্ষণের ঘটনাও একটি বড় কারণ দেশে।
সাম্প্রতিক সময়ের দুটি আলোচিত নারী নির্যাতনের ঘটনা সাদা চোখে দেখলে বিষয়টি একটু পরিস্কার হবে।
ঘটনা ১: নোয়াখালীর সূবর্ণচরে গণধর্ষণ
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘটনাটি ঘটেছে। এখানে নারীর পোশাক কোনো বিষয় না। নির্বাচন পরবর্তী প্রতিহিংসায় ঘটেছে ওই গণধর্ষণ। ধর্ষণ করেই ওই নারীকে বা কোনো ঘটনাকে ‘শিক্ষা’ দিতে হবে, এই মানসিকতাই ওই ধর্ষণের কারণ বলে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত হয়েছে।
ঘটনা ২: ডেমরায় দুই শিশু ধর্ষণের চেষ্টা ও হত্যা
এ ঘটনায়ও নারীর পোশাক কোনো বিষয় না। এখানে ধর্ষকের বিকৃত মানসিকতাই বড় কারণ হিসেবে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। দুই নরপিশাচ তাদের বিকৃত লালসা মেটানোর আগে ইয়াবা সেবন করেছিল বলেও প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
আদিম যুগে নারী-পুরুষ গায়ে কোনো পোশাক না পরলেও যুগে যুগে নারীদের পোশাকের পরিবর্তন এসেছে৷ পশুর চামড়া, গাছের ছাল ব্যবহারের পরে এখন নানা ধরণের পোশাকের প্রচলন আছে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ঋতু বৈচিত্রের কারণে৷ আমাদের দেশেও ধর্ম-সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা, কাজের ধরণ-অনুষ্ঠান অনুসারে পোশাকের প্রচলন রয়েছে। তা নারী-পুরুষ সবার জন্যই প্রযোজ্য।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৯% ধর্ষণের ঘটনা ঘটে পুরুষ কর্তৃক পুরুষ ধর্ষণের। একজন পুরুষ আর একজন পুরুষকে ধর্ষণ করে কী কারণে? পুরুষের পোশাকের শালীনতার অভাবে নাকি নোংরা মানসিকতার কারণে! অবশ্যই নোংরা মানসিকতার জন্যই। দেশে যেসব শিশুরা ধর্ষণের শিকার হয়/হচ্ছে, তাদের পোশাকও নিশ্চয় ধর্ষকামী তৈরি করে না নরপশুদের। এক্ষেত্রে ধর্ষকের মানসিকতাই একমাত্র দায়ী বলেই মনে হয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মাদক। বিভিন্ন ধর্ষণের ঘটনা পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, ধর্ষকরা ঘটনার আগেপরে মাদক নিয়েছিল, নয়তো সে মাদকাসক্ত ছিল। ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরণের নারী নির্যাতন বন্ধে মাদকের অবাধ বিচরণ বন্ধ করা জরুরি।
গতবছর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মাদকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য কঠোরতা ইতিবাচক, হয়তো তার প্রভাব ভবিষ্যতে দেখা যাবে।
আরেকটি বিষয় অনেক সমাজ বিশ্লেষক বলে থাকেন, তা হচ্ছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রসার। কোনো দেশের আচার-ব্যবহার অনুসারে তাদের নারী পুরুষের পোশাক, সেই পোশাকেই তাদের নারী পুরুষরা তাদের গণমাধ্যমসহ বিনোদন সংস্কৃতিতে নিজেদের তুলে ধরে। অবাধ গণমাধ্যমের এই জামানায় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কারো মনোজগতে বিজাতীয় কোনো সংস্কৃতি সমস্যা তৈরি করলেও করতে পারে। এছাড়া ইন্টারনেটের মাধ্যমে নীলছবির জগত তো রয়েছেই।
তবে যে কারণেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটুক না কেন, তা চিন্তার কথা। সেইসঙ্গে ধর্ষণের শিকার যখন শিশু হয়, তখন তা আরও উদ্বেগের।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের সংবাদপত্র মনিটরিং কার্যক্রম সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৯১৮ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যেখানে ৯৪২টিই ধর্ষণকাণ্ড। যাদের মধ্যে অনেককে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছে।
তবে আশা জাগানিয়া বিষয় হচ্ছে ২০১৭ সালের তুলনায় নারী নির্যাতন তথা ধর্ষণ ২০১৮ সালে কমেছে। ২০১৭ সালে যেখানে মোট ৫ হাজার ২৩৫ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতিত হয়েছিল এবং ধর্ষণকাণ্ড ঘটেছিল ১ হাজার ২৫১টি। এর কারণ অনুসন্ধান করলে হয়তো দেখা যাবে, ২০১৮ সালের আলোচিত কিছু ঘটনার পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা, গণমাধ্যমে ঘটনাগুলোর প্রচার-ফলোআপ এবং সামাজিক মাধ্যমসহ বাস্তবজীবনে সচেতনতা এই অবস্থার পরিবর্তনে সাহায্য করেছে।
কো-এডুকেশনসহ যৌন শিক্ষার নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে অনেক দেশ সচেতনতা তৈরি করে তাদের দেশে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মত ঘটনা কমিয়ে আনছে। নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদেন দেখলে বোঝা যায়, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই শতকরা ৩৩ জন মেয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় বলে নানা সমীক্ষায় জানা গেছে৷
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও প্রতি ২২ মিনিটে একজন নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলেও জানা গেছে। বাংলাদেশে সে তুলনায় অনেকটা ভাল অবস্থানে থাকলেও যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা চিন্তার।
নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনার আগেপরে আইনের প্রতি অসচেতনতা ও বিচারহীনতা এধরণের ঘটনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ করে থাকেন সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্র ও পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে দেশের বিভিন্ন থানায় ১৮ হাজার ৬৬৮টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে।
এগুলোর মধ্যে ২০১৬ সালে করা হয়েছে ৩ হাজার ৭১৭টি, ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৯২৮, ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৬৮৯, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৬৫০ এবং ২০১২ সালে ৩ হাজার ৬৮৪টি মামলা হয়। এসব মামলার মধ্যে প্রতিবছর গড়ে ৪ শতাংশ আসামির সাজা হয়। বাকিদের অধিকাংশই আইন ফাঁক দিয়ে নয়তো চাপ-অনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছে।
এসব বিষয় মোকাবিলা করতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী-২০০৩) পরিবর্তন করাও জরুরি বলে অনেক সংস্থা ও বিশেষজ্ঞ মনে করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আইন ও উদাহরণ দেখে আইন পরিবর্তন করা যেতে পারে। কোনো ঘটনার পরে দৃষ্টান্তমূলক সাজা হলে তা এধরণের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়ে থাকে।
সবদিক বিবেচনা করে নারী নির্যাতন সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বসহকারে দেখা দরকার। ধর্ষণ সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে সঠিক ধারণা দিলে, সচেতন করলে, আইনের সাজার বিষয়গুলো প্রচার করলে স্বাভাবিকভাবে ধর্ষণের সংখ্যা কমবে৷শিশুদের ধর্ষণ ও নির্যাতন বিষয়ক সাবধানতা পরিবার থেকে আলোচিত হওয়া দরকার। পাঠ্যপুস্তকে বিষয়টি যথাযথভাবে তুলে ধরলে অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে।
এছাড়া কোনো ঘটনার পরে গোটা সমাজও নারীকেই দোষ দিয়ে থাকে, যার কারণে অনেকসময় ধর্ষণের শিকার নারী শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়ে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ডাক্তারি বা মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য ছাড়াও প্রয়োজন পরিবার ও সমাজের বন্ধুবৎসল আচরণ।
নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ রোধে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে চেষ্টা করে যেতে হবে এ অবস্থা পরিবর্তনে। যাতে আমার আপনার পরিবারের বা আশেপাশের কেউ এ অবস্থার শিকার না হয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)