পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে—এই গুজব যখন আতঙ্কে পরিণত হলো এবং যখন সরকারের তরফে বিবৃতি দিয়ে বলা হলো যে এটা স্রেফ গুজব এবং এই গুজব ছড়ানোর অভিযোগে কয়েকজনকে আটকও করা হলো, ঠিক সেই সময়েই নেত্রকোণায় শিশুর কাটামাথা নিয়ে দৌড়ে পালানোর সময় গণপিটুনিতে এক লোকের নিহত হওয়ার ঘটনা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
এ বিষয়ে নেত্রকোণার পুলিশ সুপার তার ফেসবুক ওয়ালে যা লিখেছেন তা এরকম- বৃহস্পতিবার সকাল ১১ টায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের মূল আসামির (পরে গণপিটুনিতে নিহত) পরিচয় জানা গেছে। নাম রবিন (৩৫), পিতা এখলাছ উদ্দিন, সাং কাটলী, থানা নেত্রকোণা সদর। সে ভিকটিম সজীব (৭), পিতা রইছ উদ্দিনের পরিচিত এবং তারা দুজন রিকশাচালক। একই এলাকার বাসিন্দা। তাদের মধ্যে সুস্পর্ক ছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। রবিন (৩৫) ড্যান্ডি (মাদক ) আসক্ত। যে জায়গায় শিশু সজীবকে খুন করে সে জায়গায় সে মাঝে মাঝে নেশা করত। কি কারণে রবিন শিশু সজীবকে খুন করে তার রহস্য আমরা উদঘাটন করব। এর পেছনে আরও কেউ জড়িত থাকলে তাদেরকেও বের করব এবং বিস্তারিত জানাব।
পুলিশ সুপারের এই বক্তব্যের নিচে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ যেসব মন্তব্য ও প্রশ্ন করেছেন, সেগুলোও অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং যৌক্তিক।
অনেকেই যে প্রশ্নটি করেছেন তা হলো, ওই লোককে কেন মেরে ফেলা হলো? তাকে বাঁচিয়ে রাখলে বরং আসল ঘটনা জানা যেতো যে আসলেই সে কেন শিশুটিকে হত্যা করে মাথা নিয়ে পালাচ্ছিলো? তাকে মেরে ফেলার মধ্য দিয়ে মূলত পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে—এই গুজবের আগুনেই বরং ঘি ঢালা হলো। নাকি এর পেছনে গভীর-গভীরতর কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে? যদি থাকে তাহলে সেই ষড়যন্ত্রকারী কারা এবং তাদের উদ্দেশ্য কী?
পুলিশ সুপার লিখেছেন, নিহত ব্যক্তি নেশাখোর। এখন কথা হলো, একজন নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি একটি শিশুকে খুন করবে কেন এবং যদি করেও তাহলে সে মাথা নিয়ে কোথায় যাচ্ছিলো?
পুলিশ সুপারের ওই মন্তব্যের নিচে বুরহান খান নামে একজন লিখেছেন, বারহাট্টা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের তিলসিন্দুর গ্রামেও একজন অপরিচিত লোকের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তাকে স্থানীয়রা পুলিশে দিয়েছে।
তবে সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগে—এমন গুজব নতুন কিছু নয়। আমরাও ছোটবেলায় এমন কথা শুনতাম এবং ওই সময়ে বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা আতঙ্ক তৈরি হতো। কিন্তু আসলেই কতজনের সন্তান হারিয়ে গেছে বা কতজনের মাথা কেটে নেয়া হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা যেত না বা আদৌ এরকম ঘটনা কখনো ঘটেছে কি না, তাও পরিস্কার নয়। কিন্তু মানুষের মনে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তো এবং তখন আমরা দেখতাম বিভিন্ন পণ্যের ফেরিওয়ালাদেরও মানুষ সন্দেহ করতো। ফলে তখন পাড়া-মহল্লা ও গ্রামে ফেরিওয়ালাদের আনাগোনা কমে যেতো এবং অপিরিচত ফেরিওয়ালা বা লোক দেখলে মানুষ তাকে জেরা করতো।
কথিত আছে, ১৫৮০ সালের দিকে মৌলভীবাজারে কমলার দীঘি তৈরি করার সময় দীঘিতে যখন পানি উঠছিল না, তখন রাজা স্বপ্ন দেখেন যে তার স্ত্রী দীঘিতে আত্মবিসর্জন দিলে পানি উঠবে এবং পরবর্তীকালে রাজার স্ত্রী আত্মাহুতি দেয়ার ফলেই ওই দীঘিতে পানি ওঠে। এরকম আরও অনেক দীঘি তৈরি বা বড় অবকাঠামো নির্মাণের সময় মানুষের মাথা, রক্ত বা আত্মাহুতির এসব কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে। এসবের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বা ঐতিহাসিক দলিলপত্র না থাকলেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের মুখে মুখে চলে আসার ফলে অনেকের মনে বিশ্বাস তৈরি হয়ে গেছে।
ওই সময়ে ফেসবুক বা এরকম সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। ফলে গুজবটি ছড়াতো মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু এখন যেকোনো গুজব ছড়ানো মুহূর্তের ব্যাপার। কেউ একজন একটি কথা ফেসবুকে লিখে দিলে মুহূর্তেই সেটি লাখ লাখ কিংবা কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এবং যেকোনো গুজবে কান দেয়া লোকের সংখ্যাও কম নয়। সমাজের শিক্ষিত-সচেতন অংশেরও মানুষও এসব গুজব বিশ্বাস করে অথবা করতে চায়। কিন্তু যারা বিশ্বাস করে না বা এগুলোকে নিছকই অপপ্রচার বলে মনে করে, তাদের মনে খটকা তৈরি হয় নেত্রকোণার মতো ঘটনায়। ফলে নেত্রকোণায় শিশুর মাথা নিয়ে পালানোর সময় যে একজন গণপিটুনিতে নিহত হলো, সেই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন। কিন্তু মূলহোতা যেহেতু বেঁচে নেই, ফলে আসলেই নিহত লোকটি কেন শিশুটির মাথা নিয়ে দৌড় দিয়েছিল তা হয়তো কোনোদিনই জানা যাবে না। জানা না গেলে মানুষের মনে এই আতঙ্ক থাকবেই এবং পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে এই গুজব ডালপালা মেলবেই। তাহলে কি এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা যুক্ত তারা মানুষের মনে এই আতঙ্ক জারি রাখার জন্যই কাজটি করছে? তাদের কি কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে?
উদ্দেশ্য যাই হোক, যেহেতু একটা আতঙ্ক ছড়িয়েছে এবং নেত্রকোণার ঘটনার পর সেই আতঙ্ক ডালাপালা মেলতে পারে, সুতরাং এখনই সবার সতর্ক থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে এবং আশেপাশে সিসি ক্যামেরা লাগানো; পুলিশের নজরদারি বাড়ানো; অভিভাবকদের সচেতন হওয়া; ছোট সন্তানকে একা বাইরে বেরোতে না দেয়া এবং তাদের চোখে চোখে রাখা গেলে গুজব ও আতঙ্ক যাই থাকুক, অন্তত ব্যক্তি ও পরিবার পর্যায়ে মানুষ নিরাপদ থাকবে।
সেইসাথে সরকারকে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগার বিষয়টি আসলেই গুজব এবং সেইসাথে তাদের এটিও পরিস্কার করতে হবে যে, নেত্রকোণায় কেন একটি লোক শিশুর কাটামাথা নিয়ে দৌড় দিয়েছিলো?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)