একজনের চিত্রকলার শিল্পকর্ম সংগ্রহ শুরু জয়নুল আবেদিনে, আরেকজনের প্রথম সংগ্রহ এস.এম সুলতান। শিল্পকর্ম সংগ্রহ দিয়ে যে দুজনের সম্পর্কের শুরু তা কিন্তু নয়। তবে যাদের অনুরাগ শিল্পকর্মে, তাদের একত্রিত করে হয়তো প্রকৃতি নিজস্ব নিয়মেই। শিল্পনুরাগী দম্পতির নাম রাজীব সামদানী এবং নাদিয়া সামদানী। যারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বিশ্ব শিল্পকলার মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থানকে বিস্তারে এবং সুসংহত করতে।
বাংলাদেশী এবং আন্তর্জাতিক চিত্রকলা, ফটোগ্রাফিসহ বিভিন্ন শিল্পকর্মের সংগ্রাহক রাজীবের উপলব্ধির শুরু ২০০০ সাল থেকে। উপলব্ধি এই নিজ দেশেই অবহেলা বা উপেক্ষার শিকার শিল্পী সম্প্রদায়। কোন গ্যালারী নেই, যাও বা আছে তাতে অভিজাতদেরই ঠাঁই। প্রান্তিকের শিল্পীকে নিজেকে প্রদর্শনের সুযোগ নেই। এমনকি শিল্পকলা নিয়ে ভালো কোন ওয়েবসাইটও নেই। অথচ এদেশের শিল্পীদের যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পুরো দেশ জুড়ে তারা অমিত প্রতিভাধর এবং অপার সম্ভাবনাময়।
স্বপ্ন পূরণের ‘সামদানী ফাউন্ডেশন’
সম্ভাবনার রাস্তা তৈরি করার স্বপ্ন জমাট বাঁধে যূথবদ্ধ হবার পর। ২০০৮ সালে পরিণয়ে আবদ্ধ হন দুজন।
২০১১ সালে গঠিত হয় সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন। স্বপ্নের পথে যাত্রার শক্তিশালী পদক্ষেপ। কি সে স্বপ্ন? বাংলাদেশী শিল্পকলার আন্তর্জাতিকায়ন এবং সহজে দেশের মানুষের বৈশ্বিক শিল্পকলার স্বাদ আস্বাদন। ফাউন্ডেশনটা তো শুরু হল তবে সেটা যে শুধু দেখন-সর্বস্ব নয় তার প্রমাণ ঢাকা আর্ট সামিটের প্রথম আয়োজন। ২০১২ সালে।
স্মৃতিচারণ করেন নাদিয়া সামদানী। বলেন, স্থানীয় শিল্পীদের ছোট পরিসরে সহায়তা শুরু করি আমরা। কিন্তু আমাদের ভাবনায় এলো এভাবে কতজনকে আর পথ দেখাতে পারব? পাঁচজন, দশজন। অথচ আমরা তো দেশের সব জায়গার শিল্পীদের কাছে শিল্প রসিকদের কাছে পৌছাতে চাই। সে ভাবনা থেকে ঢাকা আর্ট সামিট আয়োজনের ভাবনা এলো। অন্যদিকে রাজীব জানালেন আরেক গল্প। বলেন, অনেকটা জেদ থেকে আমাদের ফাউন্ডেশন এবং এই সামিট। দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পকলা বলতে বিশ্বজুড়ে ভারত ও পাকিস্তানকে উল্লেখ করে। খারাপ লাগত। কারণ এই দক্ষিণ এশিয়ায় শিল্পকলার প্রাণকেন্দ্র বঙ্গ। তাদেরই খোঁজ নেই। আমি দক্ষিণের শিল্প চর্চার কেন্দ্রবিন্দু বলতে ঢাকাকে ভেবেছি। স্বপ্নের সারথি পেয়েছি নাদিয়াকে। এখন আমি থেকে আমরা হয়েছি। স্বপ্নের পথে ছুটতে শুরু করেছি। এখন সবাই ঢাকাকে চেনে যদিও দক্ষিণ এশিয়ার আর্ট হাব হিসেবে, তবে তাতে সন্তুষ্টির খুব বড় কারণ নেই। কারণ অধিকাংশ স্বপ্ন এখনও অপূর্ণ রয়ে গেছে।’
শিল্পকলার ভুবনে বহুমুখী উদ্যোগ পূরণের সাংগঠনিক প্রচেষ্টা সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন। সম্পূর্ণ অবাণিজ্যিক অলাভজনক শিল্প সম্প্রসারণ উদ্যোগ। তাহলে আপনাদের জীবনযাপনের অর্থ সংস্থান কি? হাসতে হাসতে রাজীব সামদানী বলেন বেঁচে থাকতে যে অর্থ তা আমাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ‘গোল্ডেন হার্ভেস্ট’ দেয়। আর মনের ক্ষুধা মেটাতে আমাদের ফাউন্ডেশন। যার মাধ্যমে শিল্পকলা এবং স্থাপত্য সংক্রান্ত গবেষণা এবং প্রদর্শনীর পাটাতন তৈরি করতে চাই দক্ষিণ এশিয়ায়। প্রথাগত দ্বিবার্ষিক শিল্পভাবনা বিনিময়ের পদ্ধতি থেকে বের হতে চেয়েছি আমরা। আরও চেয়েছি, বিশ্বের পেশাদার শিল্পবোদ্ধা এবং শিল্পীরা বাংলাদেশ ঘুরতে আসুন। দক্ষিণ এশিয়ার শিল্প ভাবনার সঙ্গে সমন্বয় করে দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পীদের সঙ্গে করে নিজেদের গবেষণা এবং শিল্পকর্ম পরিচালনা করুন।
শুরু থেকেই এই উদ্যোগের সঙ্গে রয়েছেন শিল্প নির্দেশক এবং কিউরেটর হিসেবে ডায়না ক্যাম্পবেল বেটানকোর্ট। যার মাধ্যমে সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন (সাফ) চেয়েছে বাংলাদেশের সকল পর্যায়ের সমকালীন শিল্পী এবং স্থপতিদের সৃজনশীলতার দিগন্তকে অবাধ করতে। বাংলাদেশের কাজকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে। চেয়েছে শিল্প-স্থাপত্য চর্চার ক্ষেত্রে অনুদান, আবাসন, শিক্ষা এবং প্রদর্শনীর ভুবনকে বিস্তৃত করতে। দিতে চেষ্টা করছে শিল্পী এবং স্থপতিদেরকে আন্তর্জাতিক সহজিয়া সম্পৃক্তি। বিদেশের বিখ্যাত শিল্পকলার জাদুঘরগুলো যেমন লন্ডনের টেট, নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট, দ্য মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট, সলোমন আর গুগেনহেইম মিউজিয়াম এবং প্যারিসের সেন্টার পম্পিড্যুর কিউরেটরদের সঙ্গে দক্ষিণ এশীয় চিত্রকলা বিষয়ক ভাবনা বিনিময়ের পথ সুগম করেছে সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন। বছর জুড়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে ফাউন্ডেশনটি ফেলোশিপের মাধ্যমে। এছাড়া ফ্রি লেকচার, সেমিনার এবং কর্মশালা তো রয়েছেই।আর এসব কাজে ফাউন্ডেশন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং শিল্পকলা একাডেমীর সঙ্গে সমন্বয় করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
তাদের সমস্ত ভালোবাসা তৈরি হয় শিল্পকলার বিস্তারের গল্প করে। স্বপ্নগুলো জমা হয় ‘গল্প’ ঘরে। সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের নিজস্ব সংগ্রহ এখন প্রায় ২০০০। যার মধ্যে তরুণদের শিল্পকর্মই বেশি। যে কেউ যেতে পারেন বাসভবন কাম ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায়। অ্যাপয়েন্টমেন্ট সাপেক্ষে। এই ছবিগুলো বিশ্বের বিভিন্ন উৎসবে বা প্রদর্শনীতে ঘুরেও বেড়ায়। পরিচিতি বাড়ে বাংলাদেশী শিল্পী এবং শিল্পের। চলতি বছরের শেষে আমেরিকার শিকাগোতে ‘গল্প ’ সংগৃহীত শিল্পকর্মের মধ্য থেকে বাছাই করা গুরুত্বপূর্ণ ছবি প্রদর্শিত হবে। ‘দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের শিল্পকর্ম, ভাষা এবং এবং বিপ্লবের নানা রূপ’ শিরোনামে। ওমর খলিফ এর কিউরেশনে। যাদের ছবি বাছাই হবে তারাও আমন্ত্রিত হবেন এ আসরে।
সাফল্যের গল্প বিস্তারে আর কিছু কি লাগে!
ছবি : জাকির সবুজ