সকালে ঘুম ভাঙলো আমীরুল ইসলামের ফোন পেয়ে। খবর: কায়েস ভাই নেই! কায়েস ভাই মানে ব্রাজিলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস! খবর শুনে স্তব্ধ হয়ে রইলাম। কায়েস ভাই ব্রাসিলিয়ার একটি হাসপাতালে আছেন এটা জানা ছিল। কয়েক দিন আগে সায়ীদ স্যারের কাছে শুনেছিলাম তিনি এখনো সংকটাপন্ন! কিন্তু আশা ছিল এবারও সুস্থ হয়ে উঠবেন। শিল্প ও খাদ্যরসিক এবং ফুর্তিবাজ কায়েস ভাই তাঁর অসম্ভব প্রাণশক্তি দিয়ে ফিরে আসবেন এটাই আশা ছিল। তাঁর খাদ্যপ্রীতি ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এ নিয়ে আমরা অনেক সময় কটাক্ষ করলেও তিনি মোটেই পাত্তা দিতেন না! কেন যেন মনে হয় খ্যাদপ্রীতির প্রতিক্রিয়ায় অর্জিত দেহের বিপুলতাই তাঁর মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে।
কায়েস ভাইকে আমি চিনি সেই ১৯৮১ সাল থেকে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে গিয়ে যে দু-একজনের বিদ্যাবত্তায় আমি মুগ্ধ ও চমকিত হয়েছিলাম তাঁদের মধ্যে কায়েস ভাই অন্যতম। শুনেছিলাম কায়েস ভাই তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারিবিদ্যার ছাত্র। তখনই ক্লাসে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। আবার নটরডেম কলেজে স্পোকেন ইংলিশ শেখান। শুনলাম উর্দু জানেন তিনি বাংলাভাষার মতোই। জানলাম ইংরেজিতে তাঁর সমকক্ষ পারঙ্গম মানুষও বিরল।
১৯৮২ সালেই একদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র লাইব্রেরির কার্য-সহকারী লকিয়তউল্লাহ ভাই বললেন, ‘কায়েস ভাইকে দেখলাম বিসিএস পরীক্ষা দিচ্ছেন।’ বললেন নিজে তাঁকে দেখেছেন পরীক্ষা দিতে। আমি অবাক হলাম। সন্ধ্যার দিকে প্রতিদিনকার মতো সেদিনও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এলেন তিনি। জিজ্ঞেস করলে জানালেন কথা সত্যি। ডাক্তারিবিদ্যা ছেড়ে দিয়ে তিনি হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজ থেকে ডিগ্রি পরীক্ষায় বসেছিলেন। যথারীতি ডিগ্রি পরীক্ষায় ভালো ফল হয়েছে। খালাম্মার পিড়াপীড়িতে বিসিএস দিয়েছেন। খালাম্মার জন্য একটাই চয়েস তাঁর ফরেন সার্ভিস! যদি হয় তাহলে চাকরিতে যাবেন; না হলে নয়! পরে জানলাম সেবারের বিসিএস পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন। সুতরাং তাকে ফরেন সার্ভিস নিয়ে সরকারী চাকরিতে যেতেই হলো।
বিদেশে পোস্টিং হবার আগ পর্যন্ত কায়েস ভাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে নিয়মিত ছিলেন। যে পাঠচক্রেই তিনি অংশ নেন সেখানেই উচ্চ স্তরের আলোচনা করেন। আমরা বিস্মিত হয়ে শুনি। আড্ডার মধ্যে একদিন শুনি শেকসপীয়ারের নাটকের লাইনের পরে লাইন মুখস্ত বলে যাচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করে জানলাম ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়ই তিনি পুরো শেকসপীয়ার পড়ে ফেলেছিলেন। বরীন্দ্রনাথও ভালোভাবে হজম করেছেন। কেন্দ্রের অফিস ৩৭ ইন্দিরা রোডে থাকার সময়ই বাংলা উচ্চারণ ও আবৃত্তি কর্মশালায় দেখতাম তিনি ক্লাস নিতেন। একদিন শুনলাম খ্যাতিমান নাট্যজন আতাউর রহমানের সঙ্গে শেকসপীয়ারের নাটক অনুবাদ করছেন তিনি।
সরকারী চাকরিতে যোগ দেয়ার আগের কথা। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের তখন নিদারুণ অর্থকষ্ট। কায়েস ভাই নটরডেম কলেজের স্পোকেন ইংলিশের ক্লাস নিয়ে যা আয় করতেন তার অনেকটাই দিয়ে দিতেন কেন্দ্রের তহবিলে! বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতেরা বা বিদেশি সংস্থার উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আসতেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। তখন অবধারিতভাবে সায়ীদ স্যার সঙ্গে রাখতেন কায়েস ভাইকে। কারণ কায়েস ভাই তাদের সঙ্গে জমিয়ে ফেলতেন অড্ডা দিয়ে।
ইন্দিরা রোড থেকে যখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কার্যালয় বাংলা মোটরে এলো তখন আমাদের সঙ্গে কায়েস ভাইও হাত লাগিয়েছিলেন বই-বাঁধা ও পিকআপ ভ্যানে বই তোলায়। সুশীলদা একটা ফটোও তুলেছিলেন তার। অনেক দিন কেন্দ্রের সংরক্ষিত এলবামে ফটোটা ছিল। এখন আর সেটা দেখতে পাই না। সেই তখন থেকে দেখে আসছি মানুষের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল সরল আত্মম্ভরিতাহীন। উচ্চতর পদে গেলেও ব্যবহারে কোনোরূপ পরিবর্তন দেখিনি। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজনে তাঁর অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা ছিল সবসময়। বিশেষ করে বছরের পর বছর ধরে রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের তিনি ছিলেন শক্তিকেন্দ্র! বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের পঞ্চাশ বছর নিয়ে আমি একটি দীর্ঘ গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখেছিলাম। বিশেষ প্রয়োজনে লেখাটির ইংরেজি অনুবাদ দরকার হয়েছিল। রাষ্ট্রদূতের ব্যস্ত দায়িত্বে থেকেও তিনি আমার অকিঞ্চিৎকর লেখাটি ইরেজিতে অনুবাদ করে দিয়েছিলেন।
তিনি ছিলেন নাট্যাঙ্গনেরও বান্ধব। তাঁর রূপান্তরিত নাটক ‘মুক্তি’ মঞ্চস্থ হয়েছে নাট্যদল থিয়েটারের প্রযোজনায়। নাট্য উৎসবের আয়োজনেও তাঁর সহযোগিতার হাত ছিল প্রসারিত। চিত্রশিল্পীদের যে তিনি কতটা নিকটজন ছিলেন তা আমাদের শিল্পাঙ্গনের সকলেরই জানা। একাধারে তিনি ছিলেন শিল্পকলা-সমালোচক ও পৃষ্ঠপোষক। তাঁর অনুপস্থিতি যে আমাদের শিল্পীদের কতটা অসহায়তার মধ্যে ফেলবে তা অনুভবনীয়!
ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন আমার বিশেষ ভরসার স্থল। ১৯৮৬ সালে তাঁর অনুজ যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত, তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভাইয়ের চিকিৎসার্থে চলে যেতে হলো তখনও আমার বিয়ের সময়ের জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাঁর তৎকালীন সরকারী বাসভবনে আমাদের থাকতে দিয়েছিলেন। তিনি যখন জেনেভায় দায়িত্বরত তখন আমাকে বলেছিলেন কোনোভাবে সেখানে হাজির হতে। বলেছিলেন আমাকে ইয়োরোপের বিভিন্ন স্থান ঘুরিয়ে দেখার ব্যবস্থা তিনিই করবেন।
তাঁর বাবার মৃত্যুর সময় আমি ছিলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সংস্পর্শ থেকে দূরে। তখন কায়েস ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগও ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। পারিবারিক নিকটজন বিবেচনা করে তিনি আমাকেও খবর পৌঁছাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। আমাকে অনেকবার নিয়ে গিয়েছেন তাঁর মায়ের কাছে। খালাম্মার স্নেহও আমি পেয়েছি তাঁরই স্নেহসূত্রে। সদাপ্রসন্ন নাঈমা ভাবীর সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁদের বিয়ের আগেই! ছোটবোন নূপুরকে মাঝে মাঝে নিয়ে আসতেন কেন্দ্রে। অনুজার প্রতি তাঁর বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের যুগল স্নেহধারার মাধুর্য আমাকে স্পর্শ করেছিল। পরে দেখেছি তাঁর দুই কন্যা মানসী ও মাধুরীর প্রতি স্নেহ ও বাৎসল্যের ধারা!
পরবর্তী কালে আমি চ্যানেল আইয়ের সঙ্গে যুক্ত হবার পর দেখলাম ফরিদুর রেজা সাগরের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক! ফলে কায়েস ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি পেল। লন্ডনে বা ব্রাসিলিয়ায় দুই জায়গাতেই অবস্থান কালে প্রতিটি বিশেষ দিবসে আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আমীরুল ইসলামের সঙ্গেও তাঁর ছিল চমৎকার সম্পর্ক! আমীরুলকে মজা করে ডাকতেন কুমিরুল বলে! ঢাকায় এলে চেষ্টা করতেন চ্যানেল আইয়ে আসতে। এলে তুমুল আড্ডা হতো আমাদের। সম্ভবত চ্যানেল আইয়ের ২০১২ সালের ক্যালেন্ডারের ভূমিকা লিখেছিলেন কায়েস ভাই। রবীন্দ্রপ্রসঙ্গে চমৎকার ঐ লেখনটি দুই দিন আমার সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে লিখে দিয়েছিলেন। সেটাই ছিল তাঁর সঙ্গে একত্রে দীর্ঘ সময় কাটানোর স্মৃতি।
আগেরবার সংকটাপন্ন অবস্থা থেকে ফিরে আসবার পর বেঙ্গল গ্যালারিতে তাঁর পঞ্চাশ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। খুব খুশি হয়েছিলেন আমাকে দেখে। এবারও জানুয়ারির শেষের দিকে ঢাকায় এসেছিলেন। বাংলা একাডেমিতে একুশে গ্রন্থমেলার আলোচনায় তাঁর অংশ গ্রহণের কথা জানা ছিল। কিন্তু তাঁর উপস্থিতির দিন আমি ঢাকায় ছিলাম না। বাংলা একাডেমিতে এসে তিনি আমার খোঁজ করেছিলেন। হায়, আমি তখন দেশে ছিলাম না!
মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস সম্পর্কে আমি এতক্ষণ এলামেলোভাবে যে-সব কথা লিখলাম সবই আমার ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে। আমি অনুভব করি এমনি বহু মানুষের ব্যক্তিগত স্মৃতিতে তিনি ভাস্বর হয়ে আছেন। অর্থাৎ দেশের অনেক কাজের সঙ্গে থাকা অনেক মানুষ তাঁর স্মৃতির বেদনাকে বহন করবেন। সবচেয়ে যা দুঃখের বিষয় এই যে, তাঁর অভিজ্ঞতার আলো থেকে আমরা বঞ্চিত হয়ে গেলাম বড় আগে, অসময়ে!
কায়েস ভাইয়ের অকাল বিয়োগ আমাকে এতটাই বিমূঢ় করেছে যে তাঁর সম্পর্কে ভালো করে একটা কিছু লেখা এখন আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবু এই লেখার মধ্য দিয়ে তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানিয়ে রাখলাম। তাঁর কন্যাদ্বয় মানসী ও মাধুরী এবং নাঈমা ভাবীর বঞ্চনা অনপনেয়। কায়েস ভাইয়ের সজীব পিতৃস্নেহ থেকে নিতান্ত অপরিণত বয়সে বঞ্চিত হচ্ছে এ কথা আমাকে ব্যথাতুর করে তুলছে। কামনা করি এই শোক বহনে তারা সক্ষম হবে। নাঈমা ভাবীও সক্ষম হবেন শোক কাটিয়ে উঠতে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)