নোয়াখালী সদরের একটি পার্কে স্থানীয় সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী নিজে পুলিশ নিয়ে অভিযান চালিয়ে গল্পগুজবরত শিক্ষার্থীদের পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, নিজের ফেসবুক পেজে শিক্ষার্থীদের ছবি পোস্ট করে অভিভাবকদের সতর্ক করেছেন তিনি। শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পার্কে আড্ডা দিচ্ছিলো বলেও মন্তব্য করেছেন এই সংসদ সদস্য।
এরপর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, পার্কে গল্পগুজবরত শিক্ষার্থীদের আগে সতর্ক না করে পুলিশে দেয়া একজন সংসদ সদস্যের কাজের আওতায় পড়ে কি না?
এর আগে গত বছরের ১৯ জুন রাজধানীর মহাখালীতে এই সংসদ সদস্যের ছেলে শাবাব চৌধুরীর গাড়ি চাপায় পথচারীর মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনার সময় শাবাব নিজেই গাড়িটি চালাচ্ছিলেন।
সেসময় গাড়ি চাপায় নিহত সেলিম ব্যাপারীর পরিবার জানায়, এমপির পক্ষ থেকে এককালীন ২০ লাখ টাকা ও মাসে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়ার আশ্বাসে মামলা প্রত্যাহারে রাজি হন তারা।
এর ঠিক বছরখানেক পর নোয়াখালীর ওই পার্কে পুলিশ নিয়ে অভিযান চালান তিনি। এরপর সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ তার এমন কাজের প্রশংসা করলেও অনেকেই এই দুই ঘটনায় প্রশ্ন তুলছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন: স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে পার্কে আড্ডারত থাকলে শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো দেখবে। এলাকার নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে এমপি সেখানে গেলেও তার সঙ্গে পুলিশ নিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।
পার্কে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের কাছে হঠাৎ করেই পুলিশ নিয়ে এমপি’র হানা দেয়ার বিষয় কিভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: যেহেতু তিনি নির্বাচিত প্রতিনিধি, তাই তিনি যদি মনে করেন কোনো কিছু আপত্তিকর, সেটা ভালোর জন্য করতেই পারেন। তাতে সমস্যার কিছু দেখি না। তবে এক্ষেত্রে পুলিশ নেয়ার দরকার ছিল না, অভিভাবকদের মুচলেকা দেয়ারও প্রয়োজন ছিল না।
তিনি বলেন: সব জায়গায় পুলিশ কেন লাগবে? পুলিশ দিয়ে সমাজ চালানো সম্ভব না। রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট কিছু কাজে পুলিশকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আর সমাজটা যদি পুলিশ চালায়, তাহলে সমাজের নিজস্ব শক্তি বলে কিছু থাকে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন: যদি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা মনে করে, লেখাপড়ার বাইরে কিছুটা সময় চিত্ত বিনোদনের অংশ হিসেবে পার্কে যাবে, আড্ডা বা খেলাধূলা করবে সেই স্বাধীনতা তো সব দেশেই দেয়া আছে।আমাদের সংবিধানেও দেয়া আছে।
তিনি বলেন: স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যদি আপত্তিকর কিছু করেও থাকে, তাহলে এমপি তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে কিংবা একটু বকা দিয়ে শাসন করতে পারতেন। সতর্ক করা কিংবা শাসনের বদলে তাদের পুলিশ হেফাজতে তুলে দেয়া হলো।
‘শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে তাদের স্বাধীনতার সীমারেখা কোথায়, স্বাধীনতা যেমন ব্যবহার করা যাবে, কিন্তু সেটা অপব্যবহার করা যাবে না। এছাড়াও আমাদের সমাজের মান্যগণ্য ব্যক্তিসহ এমপিদের বুঝতে হবে কিভাবে শাসন করতে হবে’, বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।
এ ঘটনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা তাদের কাজে অবহেলা করছেন জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: শিক্ষার্থী স্কুল কলেজ বাদ দিয়ে যদি পার্কে আড্ডা দেয় তাহলে ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত শিক্ষকদের ভূমিকা কী? শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা কোথায়? নিশ্চয়ই স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকরা যার যার জায়গা থেকে সঠিক কর্তব্য পালন করছে না। তবে একজন সংসদ সদস্য পার্কে পুলিশ নিয়ে শিক্ষার্থীদের থানায় পাঠাতে পারে না।
তিনি বলেন: এটা সম্পূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক গাফিলতি। স্কুল কলেজের পরিচালনা পর্ষদ কি দেখছে না তাদের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার ক্লাসে কেন কম? এ বিষয়গুলো খেয়াল রাখা স্কুল-কলেজের কর্তৃপক্ষের নৈতিক দায়িত্ব, আমাদের সংসদ সদস্যের নয়।
আটক শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়ে পার্কে আড্ডা বা সময় কাটাচ্ছিলেন জানিয়ে নোয়াখালী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নবীর হোসেন বলেন: তাদের আটক করে অভিভাবকদের ডেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এটা আসলে তাদের ভালোর জন্যই এবং অভিভাবকদের সচেতন করতেই এমপি এমন অভিযান পরিচালনা করেছেন।