২০১৬ সালে স্কুল শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে অপমানের পর পুরো দেশ সরব হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আবার প্রধান শিক্ষকের পদ ফিরে পান তিনি। সেই শিক্ষককেই আবার এবছর ঘুষ গ্রহণের মামলায় পাঠানো হয় কারাগারে। এছাড়া দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নির্বাচন নিয়েও বেশ আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য নিয়োগের পর প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে শিক্ষকদের মধ্যকার কোন্দল। এছাড়া শিক্ষকের বিরুদ্ধে আরেক শিক্ষকের মামলা, শিক্ষকদের গবেষণা নিবন্ধ নিয়ে নানা অভিযোগসহ আরও অনেক বিতর্কিত বিষয় যখন আলোচনায়, তখন ৫ অক্টোবর পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’।
প্রাথমিকের বইতে ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতা পড়ে আসা শিক্ষার্থীদের সামনে যখন পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের এই অবস্থা তখন বিশেষ এই দিনে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের উদয়-অস্ত নিয়ে নিজেদের ভাবনা চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে তুলে ধরেছেন উচ্চ শিক্ষাস্তরের কয়েকজন শিক্ষার্থী এবং একজন শিক্ষক।
‘‘মা-বাপ বানায় ভূত, শিক্ষক বানায় পুত’ গ্রামীণ এই কথাটা আগে বুঝতাম না, এখন বুঝি। আসলে এত পথ-বিপথের মধ্যে আমাদের সঠিক পথ দেখান শিক্ষকরা। শিক্ষকরা জানার কৌতুহল জাগান বলেই আমরা নতুন কিছু জানার চেষ্টা চালাই।’’ এই কথা দিয়েই শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধার জানান দিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মাহমুদ আলম বাপ্পী।
তবে উচ্চ শিক্ষা নিতে এসে শিক্ষকদের পক্ষপাতমূলক আচরণ, শিক্ষক রাজনীতির নামে অপরাজনীতি দেখে হতাশার কথা জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সুচিস্মিতা তিথি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার মাত্র এক বছরেই নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘বিদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে আসা কয়েকজন শিক্ষক আছেন যারা নতুন আসা শিক্ষার্থীদের খুব তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। এ কারণে প্রথমেই অনেক শিক্ষার্থী দমে যায়। অনেক শিক্ষক বলে দেন শিক্ষকদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে। আবার এটাও শুনেছি অমুক শিক্ষকের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক করা গেলে শিক্ষক হওয়া যাবে।’অথচ স্কুল জীবনে পাওয়া একজন শিক্ষকের প্রেরণাতেই আজ তিনি সমাজবিজ্ঞান পড়ছেন বলে জানান সুচিস্মিতা। তিনি বলেন,‘পাঠ্য বিষয়ের মধ্যে সমাজ বিষয়টা একেবারেই ভালো লাগতো না। ষষ্ঠ শ্রেণিতে এ বিষয়ে পাশ নম্বরও তুলতে পারিনি। অথচ সপ্তম শ্রেণিতে বন্ধুর মতো একজন শিক্ষক গল্পের ছলে সমাজ বিষয়টিকে সহজ করে বুঝিয়েছিলেন। সেই থেকে বিষয়টিকে আলাদাভাবে ভালোবাসতে শুরু করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় টিকে অন্য বিভাগে সুযোগ পেয়েও সিদ্ধান্ত নিলাম সমাজবিজ্ঞান পড়বো।
স্কুল-কলেজে জীবনবোধ ঠিক ততোটা পরিপক্ক হয় না যতোটা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। তাই এখন একজন ভালো শিক্ষকের গুরুত্বটা বুঝি। তবে একজন মহান শিক্ষকের যে কল্পিত রূপ নিয়ে আমি এসেছি সেরকম শিক্ষক আছেন হাতেগোনা। এখানে শিক্ষক হওয়াকে নিরাপদ একটি পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন অনেকে। শিক্ষক হওয়ার পেছনে যার মহৎ উদ্দেশ্য নেই, তার কাছ থেকে তো বেশি কিছু আশা করা যায় না।’
মাত্র একবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার বর্তমান চালচিত্র দেখে একই কথা বলেন ঢাবির পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী শিহান শাহরিয়ার।
শিক্ষার্থীদের এসব কথা শোনার পর চ্যানেল আই অনলাইনের প্রতিবেদকের কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক মফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, বছর জুড়েই নানা দিবস আছে। শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে সম্মান জানাতে একটি বিশেষ দিন তাই আমাদের দায়িত্ববোধটা বাড়িয়ে দেয়।
শিক্ষক দিবসকে এভাবেই দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বর্তমান প্রধান। তবে শিক্ষকতার মতো মহান পেশা এখন সময়ের সঙ্গে অনেকাংশেই কেবল প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বে পরিণত বলেও মনে করেন এই অধ্যাপক।
এই বিষয়ে চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক গণ্ডিতে আবদ্ধ হওয়ার আগে শিক্ষকতা এখনকার মতো ছিলো না। তখন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটাই ছিল অন্যরকম। কেবল একটা চাকরি হিসেবে দেখার কারণে এখন শিক্ষকতা আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব মাত্র। অথচ প্রকৃত শিক্ষকতাকে তো কোন গণ্ডিতে আটকানো যায় না। উদারতা, দৃষ্টিভঙ্গি মিলিয়ে এর ক্ষেত্র বিশাল,উন্মুক্ত।
প্রাতিষ্ঠানিক গণ্ডিবদ্ধতার মধ্যেও কেবল দায়সাড়া নয় বরং শিক্ষকদের কাছে প্রকৃত শিক্ষকসুলভ আচরণ আশা করেন নিজের ছাত্রজীবনে গুণী শিক্ষকদের সান্নিধ্য পাওয়া এই শিক্ষক।
তিনি বলেন, এখনও মানুষের মনে শিক্ষকের স্থান আগের মতোই সম্মানের। আগের দিনের অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওস্তাদ, শিক্ষাগুরুর মতো এখন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর শিক্ষকতাকেও আমি আরও ব্যাপকতর অর্থে দেখতে চাই। শিক্ষকতাকে কেবল পাঠদানে সীমাবদ্ধ হিসেবে দেখলে চলবে না। উন্নত জীবনাচরণ, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং আলোকিত মানুষ গড়ার শিক্ষকতাই কাম্য।
উচ্চ শিক্ষাস্তরে শিক্ষক-ছাত্রের মেলবন্ধন শিক্ষকের জন্য শ্রদ্ধার ভিত্তি গড়ে দেয় অথচ এখন ছাত্র-শিক্ষকের দূরত্ব বেড়েছে।
এই দূরত্বের কারণ তুলে ধরে অধ্যাপক মফিজুর বলেন, ‘উচ্চ শিক্ষায় ছাত্র-শিক্ষকের পারস্পারিক যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ। কেবল পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ইতিহাস, দর্শন, দেশ-সমাজ, সমসাময়িক রাজনীতি ও বিশ্বনীতি নিয়ে আলোচনার দরকার। এখন সাড়ে তিন মাসের সেমিস্টারে কঠোর সিলেবাস, সুনির্দিষ্ট সময়ে ক্লাস শেষে পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট নির্ভর ব্যবস্থায় এটা হয়ে ওঠে না। শিক্ষকরা ব্যস্ত, শিক্ষার্থীরাও প্রথম বর্ষ থেকেই শুধু পড়ালেখা ছাড়াও আয়-উপার্জনসহ নানা কাজে ব্যস্ত।
আমাদের ছাত্রাবস্থায় ৫-৬ জন শিক্ষার্থীর টিউটোরিয়াল গ্রুপের সঙ্গে একজন শিক্ষকের নিবিড় সম্পর্ক তৈরির সুযোগ ছিল। চিন্তা-ভাবনা লেনদেনের সুযোগ ছিল। আর এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত একটি দৌড়ের মধ্যে আছে।’
শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধাবোধ যেন শেষ হয়ে না যায় সেজন্য ছাত্র-শিক্ষকের কার্যকর পারস্পরিক যোগাযোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, শিক্ষকদেরও দায়িত্ববোধের জায়গাটিতে আরও সচেতন হতে হবে এবং শিক্ষকতার চেয়ে নিজের অন্যান্য পরিচিতি গড়ার প্রতি অতি গুরুত্ব দেয়ার প্রবণতা থেকে সরে আসতে হবে।