আমি পেশায় শিক্ষক, এটা আমার টাইমলাইনে দেয়া তথ্যসূত্র এবং বিভিন্ন লেখালেখি জনিত কারণে মোটামুটি অনেকেরই জানা। বছর দুয়েক আগে অংশ নেয়া পেশাগত একটি ট্রেনিং সূত্রে পার্শ্ববর্তী উপজেলার একজন সিনিয়র টিচারের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় এবং পরবর্তীকালে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে আমরা একে অপরের ভাল বন্ধু বনে যাই। শুধু ভাল বন্ধুই নয়, একেবারে প্রিয় বন্ধু। সম্পর্কের সম্বোধনে আমরা এক পর্যায়ে আপনি থেকে তুমি হয়ে তুই পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছি।
তো, সেই বন্ধুর সাথে ফোনে প্রায়ই কথা হয়। প্রোফেশনাল বিষয় সংশ্লিষ্ট নানান বিষয়সহ বেসরকারি (এমপিওভুক্ত) শিক্ষকদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার আপডেট নিয়েও কথা হয়। যেহেতু নিয়মিত পত্র-পত্রিকা পড়া এবং এবং ফেসবুকের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বন্ধুর চেয়ে জোরালো, তাই তিনি নানান বিষয়ে আমার কাছে অনেক কিছু জানতে চান। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জনপ্রিয় দাবিগুলো পূরণে সরকারের মনোভাব এবং সর্বশেষ তথ্য জানতে সময়ে অসময়ে বন্ধু আমাকে ফোন করেন।
আমার বন্ধু বিজ্ঞান বিভাগের একজন ভাল মানের শিক্ষক। যতদূর জানি, তার শিক্ষার্থীদের মাঝে তিনি বেশ জনপ্রিয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার একটি আইডি ‘একটিভ’ আছে। তবে, টাইমলাইনে তার ব্যক্তিগত পারিবারিক কিছু ছবি আর কিছু ধর্মীয় ও বিজ্ঞান বিষয় সংশ্লিষ্ট কিছু ‘শেয়ারকরণ’ ছাড়া টাইম লাইন ঘুরে আর কিছু পাওয়া যায় না।
এমনকি আমার টাইম লাইনে তিনি কদাচিৎ আসলেও এখানে তার কোন চিহ্ন টের পাওয়ার জো নেই। আমার কোন লেখায় এমনকি বিশেষ কোন ছবিতেও তিনি কখনো কোন লাইক কমেন্ট করেন না। তবে, মাঝে মাঝে ইনবক্সে নক করেন। হাই-হ্যালো কিংবা কোন ধরনের শুভেচ্ছা বিনিময় করার জন্য আমার ইনবক্সের দরজায় বন্ধুটি পা মাড়ান না কখনো। প্রায় ক্ষেত্রেই এটা সেটা নিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে হাজির হন।
তবে, প্রিয় বন্ধুর এবারের অভিযোগটি সত্যিই ‘গুরুতর’। আমি বিনীতভাবে তার অনুমতি সাপেক্ষে আনীত অভিযোগের উত্তরটি ইনবক্সের পরিবর্তে প্রিয় চ্যানেল আই অনলাইনের মাধ্যমে প্রকাশ্যে দেওয়ার কথা জানালাম বন্ধুকে। তিনি নিরুত্তাপ সম্মতি দিলেন।
এবার অভিযোগটির কথা বলে নিই।আপনারা অনেকেই জানেন, আমি ফেসবুকে নিয়মিত লেখালেখি করি। আমার লেখার বিষয় কিছুটা পাঁচমিশালী ধাঁচের। তাছাড়া, চ্যানেল আই অনলাইন পত্রিকাতেও আমি মাঝে মাঝে মতামত কলামে লিখি। খুব সম্প্রতিই চ্যানেল আই অনলাইনে আমার চারটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
বন্ধুর অভিযোগ, একজন বেসরকারি শিক্ষক হয়েও আমি আমাদের পেশাগত দাবিদাওয়া নিয়ে কেন পত্রিকায় লিখি না, লিখছি না। পেশাগত দায়বদ্ধতা থেকেই আমার লেখা উচিত বলে তিনি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন।
এবার আমার জবাব দেওয়ার পালা। আমি প্রথমেই দেশের এমপিওভুক্ত ও অন্যান্য শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিদাওয়ার প্রতি আমার অবস্থান এবং সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করছি। এখানে প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, আমি ব্যক্তিগতভাবে স্বনামে এর আগে দৈনিক যুগান্তর ও প্রথম আলো পত্রিকায় পেশাগত বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে বেশ কয়েকটি জোরালো লেখা মতামত কলামে লিখেছি। চ্যানেল আই অনলাইন চালু হওয়ার পর এই পত্রিকায়ও আমি বেসরকারি শিক্ষকদের দাবি নিয়ে একাধিক লেখা লিখেছি। চ্যানেল আই অনলাইন প্রত্যেকটি লেখা যথেষ্ট গুরুত্বসহ প্রকাশ করেছে। এমনকি, শিক্ষকদের অত্যন্ত প্রিয় পত্রিকা ‘দৈনিক শিক্ষা’তেও এ সংক্রান্ত আমার বেশ কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
এদের মধ্যে ২০০৩ সনে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা বেসরকারি শিক্ষকদের ঈদ বোনাস (তখন বেসরকারি শিক্ষকদের ঈদ বোনাস দেওয়া হত না) সংক্রান্ত একটি কলাম বিশেষ ট্রিটমেন্ট দিয়ে ছাপিয়ে ছিল। সেজন্য তৎকালীন যুগান্তর সম্পাদক শ্রদ্ধেয় গোলাম সারোয়ার, ড: মাহবুব হাসান এবং বিভাগীয় সম্পাদক সাজেদ ফাতেমি ভাইদের কৃতজ্ঞতা জানাতে আমি ব্যক্তিগতভাবে যুগান্তর অফিসে গিয়ে দেখা করে আসি। গোলাম সারোয়ার এবং ফাতেমী ভাই বর্তমানে যথাক্রমে দৈনিক সমকাল এবং প্রথম আলোতে আছেন। মাহবুব হাসান ভাই এখন আমেরিকায় বাস করছেন।
তবে, এখন আর লিখছি না। আমি ভাল করেই জানি, আমার লেখায় বা না লেখায় কারো কিছু যায় আসে না। এমনকি শিক্ষকদের প্রাণের দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে আমার লেখার সামান্যতম ভুমিকা আছে বলেও আমি মনে করি না। তবুও এসব নিয়ে আর না লেখার পেছনে একটা কষ্টবোধ আছে। আছে আত্মপক্ষ সমর্থনের কিছু ‘তাৎপর্যহীন’ আবেগ।
শিক্ষকরা অর্থনৈতিকভাবে যতই পিছিয়ে থাকুক, দেশ ও সমাজে এখনো অধিকাংশ মানুষের কাছে তারা শ্রদ্ধার পাত্র। জাতিকে শিক্ষিত করার আসল কাজটি এখনো শিক্ষকরাই করছেন। টাকা-পয়সা সমাজে বেঁচে থাকার নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। কিন্তু, একজন ব্যক্তির আত্মমর্যাদা ও ব্যক্তিত্ববোধ অবশ্যই টাকা-পয়সার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
আমার মতে, সাম্প্রতিককালে কিছু শিক্ষক ব্যক্তিত্বহীনতার নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। শিক্ষক সমাজের আত্মমর্যাদা ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। দাবি আদায়ের নামে রাজপথে বসে যখন শিক্ষকদের কেউ কেউ থালা হাতে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘মা আমাদের এমপিও দেন। মা আমাদের ভাত দেন।’
কিংবা, শিক্ষামন্ত্রীর পায়ে পড়ে এমপিও চাওয়ার মত অত্যন্ত লজ্জাজনক ইতিহাস সৃষ্টি করেন। বিভিন্ন মিডিয়ায় উঠে আসা এসব আলোকচিত্রগুলো দেখে নিজ চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। নিজের বিবেককে বুঝাতে পারছিলাম না, আমরা রাস্তার ভিক্ষুক নই, জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষক।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করার দায়িত্ব অবশ্যই শিক্ষকের। কিন্তু, শিক্ষক নিজেই যখন অশিক্ষিত’র মত আচরণ করেন, তাকে শিক্ষিত করার দায়িত্ব কে নেবে!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)