আজকের সকালটা কেমন যেন কনফিউজিং! বদন-কিতাবে একজন লিখেছেন- ‘রাতে অনেক রান্না করলাম’, আর আমি পড়েছি ‘রাতে অনেক কান্না করলাম’! আরেকটা পোস্টে লেখা হয়েছে, ‘বিবার্তার ৫ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে জি এম কাদের বক্তৃতা করছেন’; আর আমি পড়েছি, ‘নিজের ৫ম বিবাহবার্ষিকীতে বক্তৃতা করছেন জি এম কাদের!’ মাথাটা পুরা গেছে!!
এর মাঝে একটা খবর দেখলাম, আমাদের শাফিন (মাইলস এর শাফিন) নাকি ভারত-বিদ্বেষী! এবং এই কারণে পূর্ব বাংলার গরীব কৃষকের টাকায় গড়ে উঠা ৩০০ বছরের কোলকাতা শহরে মাইলস’র একটা কনসার্ট বাতিল হয়ে গেছে! উপরোক্ত দুই পোস্টের মত এখানে যেন উদ্ভট ভুলপঠন না হয়, এই জন্য আবার পড়লাম। বিভিন্ন জায়গায় খবর নিয়ে দেখলাম, ঘটনা সত্য। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।
২০০৪ সালে ভারতের বলিউডে একটা সিনেমা হয়েছিল। সিনেমার গল্প এবং অভিনয় অতি সরল হলেও ছবির নির্দেশক ইমরান হাশমি আর মল্লিকা’র বেপরোয়া চুম্বনের দৃশ্যকে পুঁজি করে ভালোই সাড়া (!) ফেলে দিয়েছিলেন। অবদমনের শিকার বাংলার যুব সমাজেও দূরবর্তী সেই চুম্বন-শিহরণের ঢেউ এসে লেগেছিল। ঐ চুম্বন-সর্বস্ব সিনেমার মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন আনু মালিক। আনু মালিক অনেক ভেবে সুর না পেয়ে আমাদের শাফিনের একটা গানের সুর মেরে দিয়েছিলেন। গানটা ছিল, ‘ফিরিয়ে, দাও আমারি প্রেম তুমি ফিরিয়ে দাও’।
আকস্মিকভাবে প্রেম ফিরে চাওয়াতে ‘পুরুষ’ শাফিনের উপর বাংলার অবিবেচক নারীকুল অত্যন্ত খ্যাপা থাকলেও, এই গান অগণিত তরুণ-তরুণীর হৃদয়ে, শরীরে আজো যে কি ঢেউ তোলে সেটা আমাদের জাহাঙ্গীরনগরের মুক্তমঞ্চের পাশের টিলার উপর দাঁড়িয়ে আমি একবার প্রত্যক্ষ করেছি। সুর-চুরি বিদ্যায় যে তারাও আমাদের ঢালিউডের অনেকের মতই পারদর্শী তা মার্ডার সিনেমার গানটি না শুনলে বিশ্বাস হবে না। ‘ajana, ojaane Jan-e Jana’, শীর্ষক সেই গানটি।
আমাদের শাফিন এমনই এক স্রষ্টা, যার অনুকরণ করেছিলেন ভারতের আনু মালিক! যাই হোক, শাফিনের কনসার্ট ভারতে বাতিল হতে পারে, যদি সেখানে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা থাকে, বা কলকাতার মানুষের ‘সাম্প্রদায়িক’ আচরণের জন্য তিনি নিজে থেকে কোনো প্রোগ্রাম বয়কট করেন। কিন্তু উপমহাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের একজন ফিরোজা বেগমের ছেলে শাফিন আহমেদ এবং তার দল মাইলস’কে যে অভিযোগ দেয়া হয়েছে, যেভাবে অপপ্রচার চালিয়ে তাকে হেয় করা হচ্ছে তাতে অবশ্যই যে কোনো আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন বাঙ্গালির, বিশেষ করে বাংলাদেশের সকল মানুষের রাগান্বিত হয়ে প্রতিবাদ করার দরকার আছে বলে আমি মনে করি।
কনসার্ট বাতিল হয়েছে, তাও আমাদের কলকাতায়! আর যে ব্যান্ড বা ব্যক্তির কথা শুনছি, তারা তো শাফিনের পরিবারের কারোর ছাত্র হবারই যোগ্যতা রাখে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের ব্যান্ডশিল্পীরা কলকাতায় কনসার্ট না করলে, বাংলা ব্যান্ড কনসার্ট কত শান-শৌকতের হতে পারে তা চোখের সামনে দেখারই সুযোগ পেতেন না ‘ম্লানমুখে পথ চলা’ কলকাতার দাদা-দিদিরা। আমাদের এই দাদা-দিদিরা কেমন আমাদের ভালোবাসে, সেটা ইডেন গার্ডেনে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচের দিন একজনও স্টেডিয়ামে না গিয়ে প্রমাণ করেছেন। শাফিন নাকি তার ফেসবুক পেইজে ভারত-বিদ্বেষী কথা-বার্তা লিখেন! এই জন্য কলকাতার একদল অপরিণামদর্শী ছেলে-মেয়ে ফেবুতে প্রচারণা (?) চালিয়ে আয়োজকদের বাধ্য করেছেন মাইলসকে ‘আজাদী’ শীর্ষক কনসার্ট থেকে বাদ দিতে!
গান দিয়ে না পারলেও, চালাকি করেই স্যুকাজেলা গিয়ে আলোচনায় এসেছেন একজন শিল্পী (?) রুপম ইসলাম! ওর কিছু গানও আমাকে আজ শুনতে হলো।ওর চেয়ে ভালো গায়কেরা আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিএসসি’র বারান্দায় প্রতিদিন ক্যাম্পাসগুলোকে সুসরব রাখে।
যাইহোক, মাথা ঠাণ্ডা করে মূল আলোচনায় আসি। বিবিসি বাংলা আমাদের শাফিন আহমেদকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনি কি ভারত বিদ্বেষী? দারুণ ব্যক্তিত্ব শাফিন মাথায় ‘হ্যাট’ পড়ে রাজকীয় ভঙ্গিমায় (এটা আমার ইমাজিনেশন) বলেছেন, ‘বর্ডারে যদি প্রতিনিয়ত দেশের মানুষকে মারা হয়, অথবা জলবন্টন যদি ঠিকমতো না করা হয় আর তার ফলে যদি দেশের কোনও অংশ মরুভূমির মতো হয়ে যায়, সেটা নিয়ে কথা বলার অধিকার তার রয়েছে,’। আমি মনে মনে মন্তব্য করলাম, ‘hats off to you.’
যারা শতভাগ বাংলাদেশকে ভালোবাসেন, তাদের কিছু কথা তো ভারতের বিরুদ্ধে যাবেই। এটাই স্বাভাবিক। কেউ যদি বিএসএফের ফেনসিডিল ব্যবসার কথা বলে তাহলে কি সে ভারত বিদ্বেষী হয়ে যাবে? অথবা কেউ যদি ক্রিকেটে ভারতের আগ্রাসী ভূমিকার কথা বলে তাহলে কি সেটা ভারতের প্রতি বিদ্বেষ হয়ে যাবে? কেউ যদি ভারতের জাত-পাত সমস্যা, সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি, বজরং পার্টি নিয়ে কিছু বলে তাহলে কি সেটা ভারত বিরোধিতা হয়? ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশের নেতিবাচক উপস্থাপন নিয়ে কিছু লিখলে বা বললে সেটা কি ভারতের প্রতি ঘৃণা হয়?
এই বিষয়গুলোকে ক্লিয়ার করতে হবে। এবং সেটা সরকারিভাবে। সরকার মাঝে মাঝে করেও। যেমন গুন্ডে সিনেমাতে আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে যখন হেয় করা হয়েছিল, আমাদের সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তার প্রতিবাদও জানিয়েছিলেন। এই সরকার ভারতের সাথে মামলা লড়ে বিশাল সমুদ্রসীমা অর্জন করেছে। এগুলো কি ভারত বিরোধিতা?
ব্যক্তিগতভাবে, ইতিহাসের সন্তান হিসেবে আমি ভারতের কোনো কোনো জায়গাকে আমার নিজের দেশই মনে করি। যেমন আগরতলা। ’৭১ এ এই আগরতলা আমাদেরকে যেভাবে আদর করেছে, তার সামান্যতম প্রতিদানও আমরা দেইনি। আমার, আপনার অসংখ্য আত্মীয় সেখানে বাস করেন। অথচ আমাদের এলিটদের সব মনোযোগ কলকাতায়! কলকাতা বিষয়ে আমি বরাবরই প্রব্লেমেটিক। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পড়লে আমাকেও আপনারা খানিকটা রিয়েলাইজ করতে পারবেন। আর না হলে ভুল করে অথবা ষড়যন্ত্র করে ভারত-বিদ্বেষী’র তকমা দিয়ে দিতে পারেন!
’৪৭ এর ইতিহাস পড়ে দেখেন, পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু এলিটদের একটা অংশ ভারতের কেন্দ্রীয় কংগ্রেস ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের সাথে মিলে আমাদের ঠকিয়েছে। তা না হলে, আমাদের কলকাতা, দার্জিলিং, আসামের কাছাড়, করিমগঞ্জ আমাদের থাকতে পারত। কলকাতার মানুষদের মন ও মগজে একটু উঁকি মেরে দেখুন! এদের একটা বড় অংশের মাঝে কী পরিমাণ বাংলাদেশ বিদ্বেষ রয়েছে আপনারা যারা জানেন না তারা কল্পনাও করতে পারবেন না। কলকাতার মানুষদের এই হীনমন্যতা ঐতিহাসিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন হয় তখন একদল সাম্প্রদায়িক এলিট একে ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ বলে হেয় করার চেষ্টা করেছে। ইতিহাসে এদের সমস্ত সাম্প্রদায়িক আচরণ আমরা ক্ষমা করে দিয়েছি, ১৯৭১ এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাদের অমূল্য অবদানের ফলে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সহযোগিতা করেছে বলে আমরা ঐ সময়টুকুর জন্য আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব তাই বলে আমরা তাদের কোনো অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করতে পারব না? বর্ডারে ঢুকে আমার বোনকে যদি বিএসএফ ধরে নিয়ে যায়, আমি যদি প্রতিবাদ করি, তাহলে কি সেটা ভারত- বিরোধিতা হবে?
অনেকে আছেন, ভারতের বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু বললেই সেখানে পাকিস্তানকে নিয়ে আসে। পাকিস্তানকে আমরা তালাক দিয়েছি মনে-প্রাণে, কাগজে-কলমে। এমনকি পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক বাতিলের দাবিও আমরা করে আসছি বহুদিন ধরে। সেই পাকিস্তানের সাথে ভারতের যোগাযোগ আমাদের চাইতে অ-নে-ক বেশি। ব্যবসা, সিনেমা, মিউজিক, ক্রিকেট-বাণিজ্য সবক্ষেত্রে ভারত পাকিস্তানের সাথে লাভজনক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। ভারত-বাংলাদেশ ট্রেন/বাস যোগাযোগ সেদিন মাত্র শুরু হলো। আর ভারত-পাকিস্তান যোগাযোগ ৪৭ এর আগেও ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতে বাড়বে বৈ কমবে না। ভারত-পাকিস্তানের বর্ডারে গোলাগুলি, যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব যে দুই দেশের ক্ষমতাসীনদের একটা নির্বাচনী খেলা, সেটা সচেতন মস্তিষ্কের সবাই জানে।
ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক তাহলে কী রকম আছে, বা থাকা উচিত? সবাই বলে সম্পর্কটা বন্ধুত্বের। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমরা নতুন প্রজন্মও এটাই বিশ্বাস করি। ভারতকে আমরা বন্ধুই মনে করি। আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী দেশ। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক এত মিল আমাদের! ’৪৭ এর অভিশাপ আমাদের কে আলাদা করেছে, না হলে তো আমরা একসাথেই থাকতাম! ’৭১ সালে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা আর ভারত অর্জন করেছে একটি বন্ধু রাষ্ট্র। খেয়াল করে দেখুন, পুরো সাউথ এশিয়াতে ভারতের বন্ধু রাষ্ট্র কয়টি? নেপালে ভয়াবহ ভারত বিরোধিতা রয়েছে, সেখানে চীনের প্রভাব বাড়ছে, শ্রীলঙ্কার সাথেও ভালো সম্পর্ক নাই। পাকিস্তানের সাথে যে বৈরি আবহাওয়া তা কাজে লাগিয়ে কত সরকার যে ভারতে টিকে গেছে তার হিসেব কে নেবে!
আমরা ছাড়া ভূটানই একমাত্র ভারতের কাজে লাগে। চীনের সাথে ডিপ্লোম্যাসিতে ভূটান ভারতের বেশ কাজে দেয়। আমাদের বিজিবি, পুলিশ, র্যাব, আর্মি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে শান্তি বজায় রাখতে অসাধারণ ভূমিকা রাখছে। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যে আজ অনেকটাই নিষ্ক্রিয় তার কৃতিত্ব আমাদেরকে ভারতের দিতেই হবে। তাছাড়া বাংলাদেশ ভারতের অনেক মানুষের রুটি-রুজিরও এক বিরাট উৎস। বাংলাদেশ ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের তৃতীয় বৃহত্তম উৎস (http://cpd.org.bd/…/cpd-study-bangladesh-indian-remittance…/)। কত অল্প দামে আমরা ভারতকে ট্রানজিট দিয়ে দিয়েছি! এদেশে ভারতের মিউজিক, সিনে ইন্ডাস্ট্রির বিরাট বাজার। এমন এক বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে ভারতের কোনো কোনো রাজনীতিবিদ, কখনো কখনো সরকারের, কখনো কোনো শিল্পীর অপ্রয়োজনীয় বাজে আচরণ কাম্য নয়। ভারতে বাংলাদেশ-বিদ্বেষ কিংবা বাংলাদেশে ভারত-বিদ্বেষ কোনোটাই কাম্য নয়। উভয় দিক থেকে একটা শ্রদ্ধাবোধের সম্পর্ক থাকতে হবে। না হলে বন্ধুত্বের জায়গা দখল করবে বিদ্বেষ, যা দুই পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)