মধ্য আফ্রিকার বাচ্চা বাচ্চা মেয়েদের চকলেট আর বিস্কুটের লোভ দেখিয়ে পশ্চিমা সেনাসদস্যদের যৌন হয়রানির খবরের মধ্যে হঠাৎ করে ‘বাংলাদেশ’ এর নামটা ঢুকে পড়ায় বেদনামিশ্রিত কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশের পুলিশ বা সেনাবাহিনীর সদস্যরা এই ধরনের ঘটনায় যুক্ত হতে পারেন না- জোড় গলায় তা বলার সুযোগ নেই। কিন্তু জাতিসংঘের শান্তি মিশনের লোভনীয় চাকরির সুযোগকে নড়বড়ে করে দেওয়ার মতো কোনো কাজে জড়িয়ে না পড়ার মতো বুদ্ধি বিবেচনা তাদের আছে বলেই আমরা মনে করতাম। তবুও যৌন হয়রানির অভিযোগের তদন্তে অভিযুক্ত হিসেবে বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছে।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের কর্মরত সেনাসদস্যদের যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই পশ্চিমা মিডিয়া খবর দিচ্ছিলো। ইস্যুটি এখন বাংলাদেশের মিডিয়ায়ও শিরোনাম হয়েছে। অভিযোগের তালিকায় বাংলাদেশি সেনাসদস্যের নামও আছে- জাতিসংঘের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার এমন বক্তব্যের পরই বাংলাদেশি মিডিয়াও খবরটি লুফে নেয়।
শান্তিরক্ষী মিশনে কর্মরত সেনাসদস্যদের হাতে মধ্য আফ্রিকার নারীদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার তথ্যটা নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সময়েই এই ধরনের অভিযোগ উঠেছে। পশ্চিমা সেনা সদস্যরা যুদ্ধের নামে কিংবা শান্তি রক্ষার নামে যেখানে গিয়েছেন, সেখানেই নারীদের যৌন হয়রানি করেছেন- ধর্ষণ করেছেন- এমন খবর পাওয়া যেতো। এমনকি সহকর্মী সেনা সদস্যরা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন- এমন খবরও পশ্চিমা মিডিয়া বিভিন্ন সময় দিয়েছে। ফলে দারিদ্র্যপীড়িত আফ্রিকান দেশগুলোর মেয়েদের শরীরের দিকে এই সেনা সদস্যরা হাত যে বাড়াবেন না- ‘জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন’- এই সাইনবোর্ডটুকু তার নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। পারেওনি। ফলে জাতিসংঘকে তদন্তে নামতে হয়েছে, তদন্তের ফলাফল সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রকাশ করতে হয়েছে। এ থেকেই ঘটনার তীব্রতা আন্দাজ করা যায়।
শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে জাতিসংঘের পক্ষে একই দিনে দু’টো বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন একটি বক্তব্য দিয়েছে। অপরদিকে নিউইয়র্কে ইউএন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল ফর ফিল্ড সাপোর্ট অ্যানথনি বানব্যারি প্রেস ব্রিফিংয়ে একটি বক্তব্য দিয়েছেন। মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনের বক্তব্যে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এবং অভিযোগকারীদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। অ্যানথনি বানব্যারি সুনির্দিষ্ট অভিযোগগুলো তুলে ধরেননি। অ্যানথনির বক্তব্যে অভিযুক্ত হিসেবে বাংলাদেশের নাম থাকলেও মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের বক্তব্যে বাংলাদেশের নাম নেই।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন মূলত জাতিসংঘের যৌথ তদন্ত দলের বক্তব্যই প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত বিদেশি সেনা সদস্যদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া বেশ কিছু মেয়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছে জাতিসংঘের একটি যৌথ টিম। নির্যাতনের শিকার হওয়া মেয়েদের চারজন বলেছেন, তাদের যারা নির্যাতন করেছে তারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অপারেশন (ইউফর) এর সদস্য। দু’জন মেয়ে বলেছেন তারা ইউফর সদস্য দ্বারা ধর্ষিতা হয়েছেন। দু’জন বলেছেন, অন্য সেনা সদস্যদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করার জন্য তাদের অর্থ দেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ রায়াদ আল হোসেইন তার আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে বলেছেন, ‘যদিও কোনো কোনো সেনা সদস্যের জাতীয়তা এখনো পরিষ্কার নয়, তবে তিনজন মেয়ে বলেছেন, তারা বিশ্বাস করেন তাদের নির্যাতনকারীরা ইউফর জর্জিয়ান সেনা সদস্য। নির্যাতিত হওয়ার সময় এই চারজন মেয়ের বয়স ছিলো ১৪ থেকে ১৬ বছর।
২০১৪ সালে ফরাসি সাঙ্গারি সেনা সদস্যদের হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়া ৭ বছর বয়সী একটি মেয়ে এবং ৯ বছরের একটি ছেলের সাক্ষাৎকার নিয়েছে যৌথ কমিটি। মেয়েটি কমিটিকে বলেছে, এক বোতল পানি এবং বিস্কুটের বিনিময়ে ফরাসি সেনা সদস্যের সঙ্গে সে যৌন সম্পর্ক করেছে। এদের দু’জনেই বলেছে, তাদের বয়সী আরো মেয়েদেরই ফরাসি সেনা সদস্যরা একই কায়দায় নির্যাতন করেছে।
গত ২৯ জানুয়ারি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন যে বক্তব্য দেয় তাতে এইসব বিষয় উল্লেখ করা হয়। হাইকমিশনের বক্তব্যে ফ্রান্স, জর্জিয়া, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পাশাপাশি আরো একটি দেশের সরকারের কাছে অভিযোগ করার কথা উল্লেখ করা হলেও সেই দেশটির নাম প্রকাশ করা হয়নি। হাইকমিশন বলেছে, ওই দেশটির সেনা সদস্যের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে আরো প্রমাণ, তথ্য-উপাত্ত দরকার। তার পুরো বক্তব্যে বাংলাদেশের কোনো সেনা সদস্য বা বাংলাদেশের নামই নেই।
একই দিনে নিউইয়র্কে ইউএন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল ফর ফিল্ড সাপোর্ট অ্যানথনি বানব্যারি প্রেস ব্রিফিংয়ে মধ্য আফ্রিকায় যৌন নির্যাতনকারী সেনা সদস্যদের দেশের নাম প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশ, ডমিনিক রিপাবলিক অব দ্যা কঙ্গো, মরক্কো, নাইজার ও সেনেগালের নাম উল্লেখ করেন। এই পাঁচটি দেশের ১০জন সেনা সদস্য অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
জাতিসংঘের দু’জন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়েছেন মধ্য আফ্রিকায় শান্তিরক্ষী বাহিনীর যৌন হয়ারানি নিয়ে। দু’জনের বক্তব্যের তথ্যে ভিন্নতা থাকলেও আমরা দোষীদের শাস্তির পক্ষেই অবস্থান নেবো। বাংলাদেশের যে এক বা দুইজন (পাঁচ দেশের ১০ জন সেনাসদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের হিসাব থেকে) সেনা সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পক্ষে। আমরা চাইবো- সরকার নিজ থেকেই তদন্ত করে দোষী সেনা সদস্যের নামধাম প্রকাশ করেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।
আর হ্যাঁ, প্রত্যেক অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিস্তারিত তথ্য জাতিসংঘ নিজেই আগামী মাস নাগাদ প্রকাশ করবে। তখন তো আমরা সবই জেনে যাবো। সরকার নিজে থেকে আগেভাগে জানিয়ে দিলে কী আর ক্ষতি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)