পরাধীন ভারতে স্বদেশী আন্দোলন ও বিপ্লবী যুগে প্রগতিশীল এক পরিবারে বেড়ে ওঠা এক নারী সালেমা বেগম। তার ডাক নাম রানী। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ছোটলাট নিয়োজিত এক পুলিশ কর্মকর্তার প্রিয় কন্যা রানী। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ১৯২৫ সালের ১৮ নভেম্বর শুক্রবার কুয়াশাচ্ছন্ন প্রত্যুষে জন্ম হয় তার। নদীয়া জেলার টলটলে এক নদীর ধারে প্রকৃতির স্নেহছায়ায় বেড়ে ওঠা বিদ্যানুরাগী দুরন্ত এক মেয়ে রানী। তার বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া, বিয়ে, সন্তান, মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যাপীত জীবনের দিনলিপি তিনি সযত্নে লিখেছেন। তার বিস্তৃত স্মৃতিকথার উল্লেখযোগ্য অংশ বিশেষ এখানে তুলে ধরা হলো।
নিজের স্মৃতি কথায় মুক্তিযুদ্ধের শহীদমাতা সালেমা বেগম লিখেছেন: ‘‘নদীয়া জেলার এক অখ্যাত শহরে ছায়াঘেরা, মায়াভরা মাটির ঘরে আমার জন্ম। গ্রামের নাম আলমডাঙা। আর মাটির ঘরে জন্ম বলেই হয়ত মাটি আর গাছের সাথে আমার নিবিড় সম্পর্ক। মাটি আমার খুব প্রিয়, আর সবুজ গাছপালা আমার প্রাণ, আমার জীবন।
৪ বছর বয়স থেকে জীবনে যা কিছু দেখেছি, তা এখনো দু’চোখে ভাসে। তখন আমার বাবা চুয়াডাঙা শহরে, সবুজ গাছ-গাছালিতে ভরা একটি বাড়িতে থাকতেন। কাছে ছিল নদী, স্বচ্ছ পানিতে টলমল করতো স্নিগ্ধ-শান্ত বন-বনানীর ছায়া। এমন শান্তির নীড় মাঝে মাঝে অশান্ত হয়ে উঠতো, বিপ্লবের যুগে। শহরের বড় বড় দোকানগুলোর সামনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলেছে। সবাই বলতো, বিলেতি কাপড়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমরা ছোটরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেই বহ্নুৎসব দেখতাম। আবার দেখতাম, অনেক ভদ্র লোকদের ধরে ধরে জেলখানার মধ্যে ভরছে; কিছু লোক আবার স্লোগান দিচ্ছে ‘বন্দে মাতরম’। এরা সবাই শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তি কেউ উকিল, কেউ শিক্ষক, কেউ রাজনীতিবিদ। এরা সবাই ছিলেন আমার বাবার বিশিষ্ট বন্ধু।
আমার বাবার মনের মধ্যে যে দেশপ্রেম, মানবিক বোধ ও সহমর্মিতা ছিল তা পরবর্তীতে আমার ও আমার বড় ভাইয়ের মনের মধ্যে ছায়া ফেলেছিল। তাই ছোট বয়স থেকেই দেশের জন্য মমত্ববোধ জেগে উঠেছিল। আস্তে আস্তে যত বড় হতে লাগলাম ততই দেশ আমার প্রাণের থেকে প্রিয় হ’ল। এমনি করেই হয়ত আমার প্রতি রক্তবিন্দুতে দেশের মঙ্গল, দেশের জনগণের জন্য ভালবাসা জেগে রইল, যা পরবর্তীতে আমার সন্তানদের রক্তের মধ্যে সঞ্চারিত হল।
চাকদহ থাকতে প্রায়ই কলকাতা যেতাম। বছর খানেক ছিলাম সেখানে। এই চাকদহ থেকেই আমার বই পড়ার অভ্যাস হল। অভ্যাস ছিল উপন্যাস পড়া, তাই লাইব্রেরিতে বই ফেরত দিতে গিয়ে অপেক্ষমান থেকেও বই পড়তাম। চাচারা কলকাতায় থাকতেন। পড়াশুনা ছাড়া আর কিছুই করার থাকল না। মাঝে মধ্যে বাবা নিজে সাথে নিয়ে দেখার জিনিসগুলি দেখিয়ে আনতেন। এর মাঝে রানাঘাট থেকে বাবা মুর্শিদাবাদ বদলি হয়ে গেলেন। ১০ বছর পরে বাবা খুলনা জেলায় বদলি হয়ে এলে আমরাও খুলনা এলাম। মনে হল স্বর্গ থেকে নরকে পড়লাম। ঘরে বসে পড়াশুনা করা আর নদীর পাড়ে বসে বসে দিন কাটানো এই ছিল কাজ। তবে, খুলনার ঐ বটিয়াঘাটা থেকেই আমার সত্যিকারের পড়াশুনা আরম্ভ হল। আমার ভাই যে কলকাতা গিয়েছিল সে খুলনা জেলা স্কুলে এসে ভর্তি হ’ল। প্রত্যেক ছুটির দিন ওখানে আসত নানা রকম জ্ঞান বিজ্ঞানের বই, স্বাধীনতা ও বিপ্লবের বই, রাজনীতির বই, অনেক রকম ইংরেজী বইয়ের অনুবাদ পৃথিবী সৃষ্টির বই, মানব জীবন বিকাশের বই, কত রকম বই যে ভাই আনতো এবং আমাকে নিবিষ্ট ছাত্রী করে পড়াতো। সে এক নতুন আনন্দ, শেখার আনন্দ, জানার আনন্দ, বোঝার আনন্দ!
বটিয়াঘাটা ছিল একটা দ্বীপের মত। তাই বোধহয় ব্রিটিশ সরকার স্বাধীনতা বিপ্লবীদের সেখানে আটক করে রাখত। আটক মানে জেলের মধ্যে নয়, তাদের জন্য ছোট ছোট ঘর করে দিত তারা নিজে নিজে স্বাধীনভাবে থাকতে পারে। বটিয়াঘাটায় কোন স্কুল না থাকাতে বাবা আমাদের ভাইবোনদের সেই সব বিপ্লবীদের কাছে প্রাইভেট পড়তে দিলেন। সেই সব বিপ্লবীদের কাছেই শিখলাম দেশের কথা, মাতৃভূমির কথা, স্বাধীনতার কথা। জানলাম, মতিলাল নেহরু ও গান্ধির কথা, জানলাম ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা ও সূর্যসেনের নাম এবং দেশের জন্য তাদের অবদান। পুঁথিগত বিদ্যা ছাড়া আরও অনেক কিছু জানতে ও বুঝতে শিখলাম। দেশকে চিনতে ও জানতে শিখলাম। শুরু হল অন্যরকম জীবন।
হঠাৎ করে শুনলাম যে, আমার বিয়ে হবে। আমি তো অবাক! এখন আমার বিয়ে হবে কেন? পড়াশুনা করছি, রাজনীতি করছি, হেসে খেলে দিন কাটাচ্ছি। খামাখা ঝামেলা কেন? আমার বড় ভাই, আমার গুরু, আমার শিক্ষক, আমার বন্ধু যে আমাকে ভালবাসে, উপদেশ দেয়, শাসন করে, আদরে মন ভরে দেয়; তাকেই বললাম, ‘এ সব হবে না’। ভাই আমাকে বোঝালো, ‘ভদ্রলোক খুব ভাল মানুষ। তোর কোন অসুবিধা হবে না।’
১৯৪২ সনের ২৩ জানুয়ারি আমার বিয়ে হল। সেদিন ছিল শুক্রবার। শনিবার ২৪ জানুয়ারি, ভাই আমাকে বললো আজ থেকে ইনিই তোর গুরু, শিক্ষক ও বন্ধু। ভাইয়ের কথা মেনে নিলাম। হ্যাঁ, আমৃত্যু আমার স্বামী, আমার বন্ধু, শিক্ষক ও গুরু ছিলেন। আমিও আমৃত্যু তাকে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করব।
আমার প্রথম সন্তান-মেয়ে, ১৯৪২ সনের ডিসেম্বরে তার জন্ম। তখন মহাযুদ্ধের দাবানল। সেই বছরই বা কিছু পরে রায়ট হয় ভারতের নানা কোণে। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল, অন্যদিকে রায়ট। কলকাতা থেকে আমার স্বামী এবং আমার ভাই বরিশাল চলে আসেন। এরপর ১৯৪৭-এ ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেল। আমার বড় ছেলের জন্ম হয় ১৯৪৮ সনের ১৯ মে। ছোট ছেলের জন্ম হয় ১৯৫০ সনের ১৪ মার্চ, বাগেরহাটে। আমার ছোট মেয়ের জন্ম হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, ৯ ডিসেম্বর ১৯৫৩ সনে। আমার চারটি সন্তান- দুই ছেলে ও দুই মেয়ে।
’৭১-এ বড় ছেলে যখন রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়াশুনা করছে এবং ছোট ছেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ছে তখন তারা দু’জন যুদ্ধে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা গুড়িয়ে দেয় শহীদ মিনার, ইকবাল হল, ঢাকা হল এবং জগন্নাথ হলের ছাত্র ও শিক্ষকদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে। যারা জীবিত ছিল, তাদেরকে বাঙ্কারের ভেতরে ফেলে তাদের উপরে মাটি চাপা দিয়ে জীবিত কবর দেয়া হয়। এসব কথা শুনে আমার দু’সন্তান-সেলিম ও হাসানকে যুদ্ধে পাঠালাম। যুদ্ধে পাঠানোর সময় বললাম, ‘যাচ্ছ বীরের মত, আসবে বীরের মত, পিঠে গুলি নিয়ে ফিরবে না আমার বিশ্বাস ও দোয়া’। যুদ্ধে যাবার সময় আমি নিজ হাতে আমার বাসার গেট খুলে দিলাম। আমি ও আমার স্বামী আমাদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলাম না। অঝোর ধারায় কেঁদেছি। কিছুক্ষণ পর ভাবলাম, ওরাতো যাচ্ছে দেশ স্বাধীন করতে, আমি কেন কাঁদছি? তবু মায়ের মনতো।
এর মধ্যে সারা বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। শুরু হল প্রতীক্ষাও। কবে ফিরে আসবে আমার বুকের ধনরা, আমার সোনা মানিকরা। অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে থাকলাম। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়। দিনগুলি কত বড়, শেষ হয়েও শেষ হয়না। আমরা কতগুলো অবরুদ্ধ খাঁচার প্রাণী! জোরে হাসতে পারি না, মনের দু:খে কাঁদতেও পারিনা, পারি না স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে। এই হঠাৎ কারফিউ, এই হঠাৎ ব্ল্যাক আউট, আবার হঠাৎ প্রচন্ড গোলাগুলি, বিভীষিকাময় দিনরাতগুলি এমনিভাবেই যাচ্ছে। খেতে বসলে মনে হত আমার সোনা মানিকরা কি খাবার যোগাড় করতে পেরেছে? ঘুমাতে গেলে মনে হত ওরা এখন কোন বনবাদাড়ে শীতের মধ্যে এক কাপড়ে শত্রুর জন্য ওঁত পেতে বসে আছে অভুক্ত পেটে, নির্ঘুম চোখে তখন খাবার মনে হত বিষ। বিছানা মনে হত কন্টক শয্যা।
প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কায় দরুদ ও আয়াতুল কুরসি পড়ি। আস্তে আস্তে যুদ্ধ শেষের দিকে এল। ১৬ ডিসেম্বর বহু প্রতীক্ষিত, বহু আকাক্ষিত ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা লাল পথ ধরে বিজয় দিবস এলো। ঢাকার বুকে বাংলাদেশের পতাকা পত পত করে উড়ছে, চোখ জুড়িয়ে গেল। বিকেলে দেখলাম ইন্ডিয়ান ট্যাঙ্ক বহর ঢাকার রাজপথে।
সন্ধ্যার সময় দেখতে পেলাম ৬০ হাজার পরাজিত হানাদার বাহিনীর একটি দল বন্ধুকের নল নিচু করে, মাথা নিচু করে, হেঁটে যাচ্ছে শহরের দিকে। এই বন্দুক দিয়ে কত মায়ের বুক খালি করেছে, কত পিতাকে করেছে সন্তানহারা এই জালিম বাহিনী। এর কতক্ষণ পরে আমার দু’চোখ ভরে পানি এলো।
আমার ছেলেরা কোথায়? আমার ছেলেরা কি জীবিত আছে, দেখা কি হবে? যদি ফিরে না আসে, ওদের অভাব বুকে নিয়ে কিভাবে বাঁচব, নানা রকম এলোমেলো চিন্তায় মন খুবই ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলাম। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানালাম আমার ছেলেদের ফিরিয়ে দাও, তুমি তো অসীম করুণাময়। ১৭ ডিসেম্বর সকালে তেজগাঁওর দিকে হেঁটে হেঁটে রওনা দিলাম। মন বলছে, ছেলেরা আমার বেঁচে থাকলে অবশ্যই একবার আমার খোঁজে তেজগাঁওর বাসায় যাবেই। তাই ভারাক্রান্ত মন নিয়ে হেঁটে হেঁটে ফার্মগেট পর্যন্ত গেছি। এমন সময় আমার এক আত্মীয় অনেক দুর থেকে চিৎকার করে বলছে, ‘বড় আপা তোমার ছেলেরা ফিরে এসেছে। ওরা বাংলাদেশের আর্মি অফিসার। তুমি আমার বাসায় যাও, সেলিম তোমার সাথে ওখানে দেখা করতে যাবে।’ আমি আনন্দে অধীর হয়ে জোর কদমে আত্মীয়ের সেই বাসায় নিস্পলক চোখে উদগ্রীব হয়ে ওর অপেক্ষাতে থাকলাম। উৎকর্ণ হয়ে থাকলাম ওদের পায়ের শব্দ শোনার জন্য। অবশেষে সেই পরমক্ষণটি এলো, যার জন্য দীর্ঘ নয়টি মাস গভীর আগ্রহে দিন গুণেছি। সেলিম একটানা বারান্দার উপর দিয়ে বীর পদক্ষেপে হেঁটে আসছে। আমি তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। সেলিম দ্রুত এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘‘মা আমি ফিরে এসেছি। আবার বলল, মাগো আমি তোমার কোলে ফিরে এসেছি’’। বলেই আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ল। আনন্দের অশ্রুতে ওর বড় বড় চোখ দুটি ভরে গেল। আজ আমি কত খুশি, দীর্ঘ ন’মাস পর আমার নিখোঁজ ছেলেদের ফিরে পেয়েছি। আমি আনন্দে উচ্ছ্বাসে পূর্ণ হয়ে গেলাম। আমার এই সুখ ও আনন্দ দেখে বিধাতা বুঝি অলক্ষ্যে হেসেছিলেন।
১৯৭২ সনের ৩০ জানুয়ারি সেই দিন আমার জন্য পৃথিবীর সব চেয়ে জঘন্যতম বিভীষিকাময় দিন। পরিষ্কার দিনের আলোতে যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ হয় তার একটি উদাহরণ।
৩০ জানুয়ারি ১৯৭২ সকালটা মনে হয় সুন্দর ছিল। কে জানতো সেই দিনটা এমন কারবালার প্রান্তর হবে। সকাল ১১টা পর্যন্ত সাদামাটা দিনের মত শুরু হলেও তারপর কি হল মিরপুর ঐ বধ্যভূমিতে? কেন তা ২৮ বছর চাপা পড়ে ছিল কালো আবরণে? ২৮ বছরে ওটি কি বাংলাদেশের কোন অংশ ছিল না? কেন আমরা স্বজনহারাদের অন্ধকারে রেখে বীরের ইতিহাস, ত্যাগের ইতিহাস আড়াল করা হয়েছে! কি ব্যর্থতা ঢাকতে কাদের অপরাধটি আড়াল করতে তা করা হয়েছিল তা ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সেদিন ৩০ জানুয়ারি কী ঘটেছিল মিরপুর ১২ নম্বরে? কার কাছে এর উত্তর পাবো? কার কাছে আমি আমার সন্তানের খবর পাবো? কেন আমার সন্তান এক অসম অঘোষিত যুদ্ধে শহীদ হয়ে গেল। জবাব চাই, তখনকার সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে প্রত্যেক স্বজনহারার মতই আমার প্রশ্ন কেন এতদিন চাপা দেয়া ছিল শহীদদের অস্থি করোটি?
কী প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার ৪৬ দিন পর ৩০ জানুয়ারি অবরুদ্ধ মিরপর মুক্তকরণে এক অপরিকল্পিত যুদ্ধে প্রস্তুতিহীন একদল সেনাকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল সেটাও আমার প্রশ্ন। আর যারা জেনে বুঝে যে দেশের স্বার্থে, সেনা বাহিনীর গর্বের জন্য, দেশমাতৃকার সম্মান ও স্বাধীনতার জন্য যারা প্রাণ দিল, তাদের যথাযথ সম্মানিত করতে জাতি কেন ব্যর্থ হল, সেটাও আমাার প্রশ্ন। সেলিম ও সুবেদার মোমেনসহ ৪১ সেনাসদস্য ও পুলিশ বাহিনীর যারা আত্মদান করল তাদেরকে কীভাবে জাতি ও সেনা বাহিনী সম্মানিত করেছে তা জানবার অধিকার সমগ্র জাতির।
আমার প্রিয় সন্তান সেলিম যে সাহসী যোদ্ধাদের মধ্যে অন্যতম সাহসী ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাকে সর্বোচ্চ সম্মান দেবার অঙ্গীকার করে বঙ্গবন্ধু রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একটি হলের নামকরণ করেছিলেন তার নামে। অথচ তাকে সরকারি তালিকায় শহীদ থেকে মরহুম বানিয়ে দেওয়া হল। তিন তিন বার সেনা বাহিনী থেকে তার নামে একটি রাস্তার নামকরণ করবার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন পর্যায়ে যেয়ে ব্যর্থ হল তারা। আর আমি দক্ষিণাঞ্চলের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রধান হয়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করলাম প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের জন্য। দুর্ভাগ্যক্রমে সাক্ষ্যাৎ হল না। আমি আজ ৯২ বছর বয়সে মৃত্যুপথযাত্রী। আমার সম্মুখে ধূ-ধূ প্রান্তর। যে মা নিজে জীবিত থেকে তিন তিনটি সন্তানকে কবরে ঠেলে দেয় তার কানে কেবলই মৃত্যুর ঘন্টা, সন্তানের আসা-যাওয়া, আর অন্তহীন প্রতীক্ষা। মনে হয় হয়ত এই আমার সন্তান এলো-মধ্যরাতে অশ্বারোহী হয়ে, নক্ষত্রলোক থেকে নেমে কুটিরে কড়া নাড়লো। যে প্রিয় সন্তান পড়ার টেবিলে বইয়ের পাতায় উপুড় করে একদিন কেঁদেছে আর বলেছে, ‘যদি পরকালে তোমার সাথে দেখা না হয় মা’! কেমন আছে আমার সেই প্রাণের ধন!
একদা বেলোলিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে সেলিম লিখেছিল।
‘১৮/১০/৭১
মাগো,
অনেক দিন পর তোমার কাছে কিছু লেখার সময় হল। মা তিন মাস ফ্রন্টে থাকার পর ট্রেনিং-এ গিয়েছিলাম আবার সেই একই ফ্রন্টে ফিরে এলাম। ট্রেনিং-এ থাকার সময় প্রত্যেকটি রাতে তোমার কথা ভাবতাম বিশেষভাবে সেই তারায় ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। মনে হত সেই একই আকাশ কিন্তু মা তোমার সাথে কত দূরত্ব! মাগো ছয় মাসের বেশি তোমার মুখ দেখি না। যখন তুমি আমাদের বিদায় দিলে- আমার শুধু সেই ক্ষণটার কথাই মনে পড়ে যখন তোমার কথা ভাবি। তোমাকে ও বাবাকে ছেড়ে আসতে আমারও কষ্ট হচ্ছিল তাই, গেট থেকে বেরিয়ে আর পিছন ফিরে তাকাইনি।
আজকের এই দিনে নতুন সেক্টরে ফিরে আসার দিনে, আমার নতুন দায়িত্ব নিতে আসার দিনে, তোমার আর্শীবাদ চাই। মা সে সময় তুমি বলেছিলে শিগগিরিই তোদের সাথে দেখা হবে- সেই স্বাধীন দেশে সেই দিনটা যেন কাছিয়ে আসে সেই আর্শীবাদ করো। আমার প্রাণ দিয়েও যেন আমার দায়িত্ব পালন করতে পারি। আর্শীবাদ করো। সেলিম
৩০/১১/৭১
মা,
পহেলা নভেম্বর নোয়াখালীতে যাবার হুকুম হলো। ফেণীর বেলোনিয়া ও পরশুরাম মুক্ত করার জন্য। ৬ নভেম্বর রাতে চুপচুপ করে শত্রু এলাকার অনন্তপুরে ঢুকলাম। পরদিন সকালে ওরা দেখল ওদেরকে আমরা ঘিরে ফেলেছি। ৮ নভেম্বর রাতে ঐ জায়গা সম্পূর্ণ মুক্ত হলো। শত্রুরা ভয়ে আরো কিছু ঘাঁটি ফেলে পালিয়ে গেল। পরদিন চিতোলিয়া আমরা বিনাযুদ্ধে শত্রুমুক্ত করলাম। আস্তে আস্তে আরো এগিয়ে গেলাম। ২৭ নভেম্বর যখন আমরা ঐ এলাকা থেকে ফিরে এলাম তখন আমরা ফেনী মহকুমা শহর থেকে দেড় মাইল দুরে ছিলাম, পাঠাননগর ছিল আমাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি। শীঘ্রই মাগো আবার তোমার সাথে দেখা করতে পারব ভেবে মনটা আনন্দে ভরে গেল।
জানো মা, এই যুদ্ধে আমরা ৬০ জন শত্রু ধরেছি। আমাদের কোম্পানীর ৩ জন শহীদ হয়েছে ও একজনের পা মাইনে উড়ে গেছে। দোয়া করো মা। সেলিম’
আমার সাথে দেখা হলে এক সময়ের সেনাপ্রধান লে. জেনারেল মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন আমি নাকি এক বিরল মা। যে মা তার দুটি সন্তানকে যুদ্ধে পাঠাতে পারে। কিন্তু আমার তো মনে হয় না। আমি অসাধারণ নির্ভীক এক মৃত্যুঞ্জয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধার মা। সেই বিরল সন্তানের মা হবার গৌরব লাভ করেছি, যে সন্তান অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু সামনে জেনে জয়ের জন্য এগিয়ে যেতে পারে এবং শান্তচিত্তে মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করতে পারে। সে এমন বীর যে নিজেকে বিপন্ন করে সাহসী কন্ঠে সহযোদ্ধাদের বলতে পারে ‘আমার শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকতে তোমাদের ফেলে যাব না।’ সেই বিরল সাহসী সন্তানের মা আমি, আমি আমার সন্তানের গর্বে গৌরাবান্বিত মা। যদি সত্যই কেউ বীরশ্রেষ্ঠ হয়, তাহলে সে আমার সন্তান সেলিমের মত মৃত্যুকে ভৃত্য করে, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে ও বিজয় আনতে নিজের প্রাণ বিসর্জন দেবার সাহস রাখবে এটা ভাবা নিশ্চয় অন্যায় হবে না।
সব কথা মনের মধ্যে গুমড়ে গুমড়ে কেঁদে বেদনার মেঘ যেন জমে। কলমের মুখ দিয়ে আর যেন কালি ঝরে না আর কোথা থেকে শুরু করব তাও গুছিয়ে ভাবতে পারিনা। দীর্ঘ তিন দশক আগের কথা! স্মৃতি বড় দুর্বল হয়ে গেছে। আমি নিজেও দুর্বল হয়ে পড়েছি। সেলিমের নামটা মনে পড়লেই আমার দু’চোখ জলে ভরে যায়। কিছুই চোখে দেখতে পাই না। শুধু মনের মাঝে গুমড়ে বেড়ায় সেলিমের সব স্মৃতি। এসব কথা কি ভাষায় প্রকাশ করা কোন মায়ের পক্ষে সম্ভব? শুধু সন্তানহারা মা বুঝবে আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ, আর কেউ তা বুঝবে না।”
শহীদ লে: সেলিম ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা: এম. এ হাসানের মা শহীদ জননী সালেমা বেগম ২০১৮ সনের ১৯ জানুয়ারি দুপুরে মৃত্যুবরণ করেন। তার বাবা ব্রিটিশ সরকারের একজন পুলিশ অফিসার ছিলেন। ১৯৪২ সালে কলকাতার বিশিষ্ট চিকিৎসক এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানের স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক ডা: এম. এ শিকদারের সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
দেশের প্রগতিশীল সব আন্দোলনসহ স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা এই নারী তার সুযোগ্য দুই সন্তান লে: সেলিম ও ডা: এম. এ হাসানকে স্বাধীনতার ঊষালগ্নে (২৫ মার্চ ১৯৭১) মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত করে পুরো পরিবার নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। শহীদ মাতা সালেমা বেগম দক্ষিণাঞ্চলের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির প্রধান ছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকে তিনি তার পরিবারসহ সকল নিকটজনদেরকে নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সম্পৃক্ত হন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)