সবাই দেখি শহিদুল আলমকে নিয়ে লিখছে, নোবেল বিজয়ী থেকে শুরু করে পাতি ব্লগার, এমন কি যারা শহিদুলের নামও জানতো না (কারণ শহিদুল প্রচার বিমুখ মানুষ) তারাও শহিদুল আলমকে নিয়ে কাটা ছেঁড়া করছে, তাকে জাজ করছে, তাঁর কাজ, অর্জন ও চরিত্র থেকে শুরু করে তাঁর জন্ম পরিচয় নিয়েও ব্যবচ্ছেদ করছে।
৫ আগস্ট থেকে শুনছি অনেক, পড়ছি অনেক। আল জাজিরার ইন্টারভিউয়ের কিছু কথা ভালো লাগেনি যদিও (আমার ব্যক্তিগত মত), ইন্টারভিউটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল শহিদুল হয়ত বিপদে পড়বেন, ঘণ্টা দশেক পরেই জানলাম শহিদুলকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পরে জানলাম তাঁর বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা হয়েছে, তাকে রিমান্ডে নেয়া হল, এখন জেলে আছে, তাঁর পক্ষের উকিলরা জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন জামিনের। বিচারাধীন বিষয়ে কিছু বলা সমীচীন নয়, আশা করি আইন তাঁর নিজস্ব গতিতে চলবে, ক্ষমতাধরদের চাপহীনভাবে।
১৯৯৭ সালে শহিদুলের সাথে পরিচয় হয়েছিল। ২০০৩ সালে একসাথে কাজ করি টানা ছয় মাস। ঐ ছয়মাস কাছ থেকে চিনেছি কিছুটা, ফলে তাকে নিয়ে কিছু লেখার অধিকার তো আছেই যেখানে অনেকে না চিনে কথা বলছে।
১৯৯৭ সালেই শুনেছিলাম, ফটোগ্রাফি পাগল শহিদুল লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জৈব রসায়নে পিএইচডি করেছেন, অধ্যাপনাও করেছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিশ্চিন্ত এই একাডেমিক ক্যারিয়ার ফেলে দেশে এসে ফটোগ্রাফির মতো একটা পেশা বেছে নেন তিনি, তাও আবার সেই ৮০’র দশকে যখন এই কাজের কোনো সম্মানজনক স্বীকৃতি বাংলাদেশে ছিল না। সবাই অবাক হতো, ভাবতো বড়লোকের শখ, কিছুদিন পর ছেড়ে দিবেন। তাঁর মা তো বলতেনই ‘সে অধ্যাপনার পাশাপাশি শখের ফটোগ্রাফি করে!
শহিদুল ফটোগ্রাফি শখের জন্য শুধু করেননি, তিনি বাংলাদেশের ফটোগ্রাফারদের আধুনিক ফটোগ্রাফির পাঠ পড়ানোর পাশাপাশি তাদের আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করার পথ সুগম করেছেন। ছয়মাস সময়ে দেখেছি কি নিষ্ঠার সাথে কাজ করেন শহিদুল, আমি শহিদুলের ভক্ত হয়েছিলাম তাঁর আউট অফ ফোকাস বিভাগটা দেখে। একদল সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন শহিদুল, প্রথম পর্যায়ের সেই বাচ্চারা আজ সমাজে দারুণভাবে প্রতিষ্ঠিত। দৃক ফটো থেকে বাড়তে বাড়তে ফটো লাইব্রেরি, মাল্টিমিডিয়া, পাঠশালা ও দৃক নিউজের প্রতিষ্ঠা করেন শহিদুল। ফটোগ্রাফি দিয়ে বাংলাদেশের পজিটিভ দিক শহিদুলের মতে এমন করে কেউ তুলে ধরেননি, বাংলাদেশ মানেই গরীব, ভিক্ষুক, অসহায় এইভাব শহিদুল দূরে রেখেছিলেন। সব কিছুতেই পজিটিভ দিক তুলে ধরতে চেষ্টা করতে দেখেছি তাকে, পরে তাঁর এই পজিটিভ মনোভাব বদলে গেছে কিনা জানি না। শহিদুলের সাথে কাজ করতে যেয়ে শিখেছিলাম, নাম ধরে বড়দের ডাকলে অসম্মান হয় না, তাই তাকে ছোটবড় চাইলেই নাম ধরে ডাকতে পারতো, উনি আমাদের কাছে আলম ভাই বা শহিদুল । সব থেকে মূল্যবান শিক্ষাটা পেয়েছিলাম নির্ভীকভাবে সমালোচনা করতে। নিয়ম মানার দিক দিয়ে কঠোর হলেও সবাইকে সমানভাবে কথা বলতে দিতেন, ছোটবড় সবাই নিজেদের মনোভাব নির্দ্বিধায় তুলে ধরতে পারতাম। এমন বহুবার হয়েছে শহিদুলের কাজের সাথে আমি একমত ছিলাম না। আর এই যে একমত ছিলাম না, সেটা নিয়ে কখনো রাগ হননি উনি, বরং উৎসাহিত দিয়েছেন এমনই থাকার জন্য, তর্কের খাতিরে তর্ক না করে যুক্তি দিয়ে কথা বলাতে উৎসাহিত করতেন, সমালোচনাকে সাধুবাদ জানাতেন, শহিদুল মনে করতেন সমালোচক তাঁর বড় বন্ধু।
দীর্ঘদিন বিদেশে বসবাসের কারণে তাঁর সাথে যোগাযোগ নেই, এমন কি সেই ছয় মাসের পরে দেশে কর্মরত থাকাকালীন সময়ে শহিদুলের সাথে হুট-হাট দেখা হয়েছে সভা, সমাবেশে বা মিছিলে কাজ করার সময়। এছাড়া শহিদুলের সাথে দেখা বা যোগাযোগ ছিল না। এমনকি আমার বায়োডাটাতেও সেই ছয় মাসের উল্লেখ করা হয়নি কোনদিন বা কখনও শহিদুলের কোন রেফারেন্স ব্যবহার করিনি, প্রয়োজন ছিল না। শহিদুলের কাজের সাথে আমার কাজের কোন মিল ছিল না। ফটোগ্রাফি নিয়ে বাংলাদেশে যত কাজ শহিদুল করেছেন তা আর কেউ করেননি, যে সম্মান অর্জন করেছেন বা যে সুনাম করেছেন তা আর কেউ পাননি, এই নিয়ে লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। শহিদুলের নাম দিয়ে গুগল সার্চ দিলেই পাওয়া যাবে তাঁর পুরো কর্মজীবন। তাই আর এ নিয়ে লিখলাম না।
এত বছর পরে বিশেষ করে ৬ অগাস্ট থেকে শহিদুলকে নিয়ে এত নতুন নতুন সবকিছু পড়ছি, দেখছি যে অবাকই লাগছে, যে ছয় মাস একসাথে নয়টা পাঁচটা কাজ করেও কিছুই জানলাম না। এই ২৫ দিনে অনেক প্রশ্ন জমেছে মনে, উত্তরগুলো অভিযোগকারী/কারিনীগণ দিলে চক্ষুকর্ণের বিবাদ মিটত।
১.গুজব ছড়িয়ে অন্যায় করেছেন শহিদুল কিন্তু সেই অপরাধ নিয়ে কথা না বলে শহিদুল একজন রাজাকার তা প্রমাণের জোর চেষ্টা কেন চলছে বুঝতে পারছি না? বোঝাবেন কি?
২. শহিদুল রাজাকারের ভাগনে খুবই গুরুতর অভিযোগ, শহিদুলের মা-বাবা মানে রাজাকারের বোন-দুলাভাই, ড. কাজী আবুল মনসুরকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা পদক প্রদান ও কাজী আনোয়ারা মনসুরকে নারী শিক্ষায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য ১৯৯৯ সালে রোকেয়া পদক প্রদান করা হয়, তিনি অগ্রণী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতাও (সূত্রঃ কালের কন্ঠ, ২৮ আগস্ট, ২০১৮)। প্রশ্ন হল সরকার উনাদের পুরষ্কার কেন দিয়েছিলো? আমাদের দেশে কি রাজাকার আত্মীয় হওয়া কি অন্যায়ের? আমাদের অনেক বেয়াই-তালই-সম্বন্ধিও তো রাজাকার ছিল, নাকি?
৩. আলজাজিরাকে দেয়া বক্তব্যের কিছু কিছু ভুল অর্থ করে লেইম সব অজুহাত দাঁড় করানোর চেষ্টা কেন? কিছু পাতি ব্লগার ও সরকারের অনুকম্পা প্রাথীরা এই কাজ করে চলেছেন, কোন সুবিধার আশায়? উনি যে অন্যায় করেছেন সেটা উল্লেখ করছেন না কেন?
৪. ইংরেজির মানে না বুঝে শহিদুলের করা নিউজ ও ডকুমেন্টারি নিয়ে মিথ্যে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর কারণ কী?
৫. শহিদুল অনুমোদন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছিলেন শহরের প্রাণকেন্দ্রে। আমার প্রশ্ন কিভাবে এতো বছর তিনি তা করলেন? আইন কি করছিল? দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কোথায় ছিল? কেন দেখলো না একটা বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠান অনুমোদন ছাড়া বছরের পর বছর চলছে?
৬. আমার জানা মতে আগে দুইজন খালেদা জিয়ার ফটোগ্রাফার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে বাবুল তালুকদার নামে একজন বেগম জিয়ার জন্য কাজ করেন। আমার প্রশ্ন কোন সাল থেকে শহিদুল বেগম জিয়ার ফটোগ্রাফার ছিলেন? কাউকে নিয়ে ডকুমেন্টারি বানালে বা নিউজ করলে কি তাঁর ব্যক্তিগত রিপোর্টার বা ফটোগ্রাফার হয়ে যায় কেউ?
৭. পাঠশালা দিয়ে শহিদুল কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন, খুবই অন্যায় করেছেন তিনি। কিন্তু প্রশ্ন হল এত বছর এই লুটপাট তিনি কিভাবে আরামে চালিয়ে গেলেন? কারা সাহায্য করেছে তাকে বিদেশী তহবিল নিজের ব্যক্তিগত তহবিলে রূপান্তরিত করতে?
৮. ২০১৩ তে শাহবাগ নিয়ে শহিদুল আলমের একটা লেখা নিউ ইয়র্ক টাইমসে ছাপা হয়েছে ২০১৩ সালে, আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে, সেই লেখা নিয়ে একজন ব্লগার রিভিউ লিখেছেন, (মজা পেলাম তাঁর অনুবাদ পড়ে ও কারসাজি দেখে)। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট হিসাবে “ফাঁসি” বহু বছর আগেই বাতিল হয়ে গেছে, কিন্তু আমার দেশের সরকার কেন এতো বছর পরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে বা কেন আমরা রাজাকারদের ফাঁসির দাবি নিয়ে শাহবাগে আন্দোলন করছি, তা ব্যাখ্যা করেছেন শহিদুল আলম ঐ লেখায়। তিনি বলতে চেয়েছেন – শাহবাগ আন্দোলন কেবল রক্তের দাবিতে জড়ো হওয়া নয়, বরং শাহবাগ ছিল সকল অর্থেই “সুবিচার” পাওয়ার দাবিতে আন্দোলন, যে “সুবিচার” গত চল্লিশ বছর ধরে বকেয়া রয়ে গেছে। এটাই ছিলো শহিদুল আলমের লেখাটির মোদ্দা কথা। মজার কথা এই লেখাটিকেই ব্যবহার করা হচ্ছে শহিদুল আলমকে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করতে। যে লেখা ৬ বছর আগে সরকারের পক্ষে ছিল তা কেন আজ তাঁর বিরুদ্ধে যাচ্ছে?
৯. দেশের সব থেকে বড় রাজাকার গোলাম আজম, নিজামীরা যদি জেল হাজতে জামাই আদর পেতে পারে তাহলে মামলাধীন শহিদুলের সাথে অমানবিক আচরণ কেন?
বাতাসে গুজবের বসবাস, বাতাসে উড়ছে গুজব শহিদুলকে শায়েস্তা করে, সরকার বিরোধী সমালোচনাকারী বোঝানো মুখ খোলার আগে দশবার ভাবো, শহিদুলের মতো নামীদামী মানুষের যদি এই হাল হয় তবে তোমাদের কী হবে? আমরা গুজব আর শুনতে চাই না। শহিদুলের অন্যায় করলে বিচার হোক, কিন্তু মুখ চেপে ধরে নয়।
সরকারের অনুকম্পা প্রার্থীরা বা চাটুকারের দলরা সরকারকে তোষামোদ করতে গিয়ে সরকারকে যে আরও বিব্রত করছে তা তাদের অনুভূতিতে নেই। গুজবের বিরোধিতা করতে যেয়ে আরও গুজব ছড়াচ্ছে, তাতে সরকারে ক্ষতি বই লাভ হচ্ছে না। এরা সরকারের মস্তিষ্কে ক্যান্সারের মতো বাসা বাঁধছে। এই সুসময়ের মাছিদের কাছ থেকে যত দূরে থাকবে সরকারের তত মঙ্গল হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)