চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

শব্দে জব্দ নারী

ঘরে-বাইরে অবমাননাকর শব্দের ব্যবহার নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে নারীর মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি এখনও প্রশ্নের মুখে। তারা বলেন, ভাষার ব্যবহারে সংবেদনশীলতা না আসলে নারীর ক্ষমতায়ণ আসবে না।

বুধবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ‘শব্দে জব্দ নারী’ অনুষ্ঠানে তারা এসব কথা বলেন।

নারীর প্রতি সকল অবমাননাকর শব্দ ব্যবহার রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০১৯ উপলক্ষে একশনএইড বাংলাদেশ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

একশনএইড বাংলাদেশের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনুষ্ঠানের শুরুতেই চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন অতিথিরা। এরপর তারা আলোচনায় যোগ দেন। আলোচনা অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘শব্দে জব্দ নারী’ বিষয়ে একটি ধারণাপত্র তুলে ধরেন একশনএইড বাংলাদেশের ম্যানেজার কাশফিয়া ফিরোজ। যেখানে একশনএইড বাংলাদেশের “সেইফ সিটিজ ফর উইমেন” ক্যাম্পেইনের একটি গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়।

এই গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৮জন নারী রাস্তায় চলার পথে অপমানজনক মন্তব্যের মুখোমুখি হন। এদের মধ্যে ৮৬ শতাংশ চালক ও চালকের সহকারীর দ্বারা এবং শতকরা ৬৯ জন দোকানদার এবং বিক্রেতার মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের শিকার হন।

এমন পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক হিসেবে উল্লেখ করে একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, ঘরে-বাইরে প্রথমেই একজন নারীকে ভাষার মাধ্যমে হেয় করা হয়, যাতে সে মানসিক ও সামাজিকভাবে আগাতে না পারে। শব্দ, বাক্য এবং উক্তিতে কোন লিঙ্গ থাকার কথা না। কিন্তু সেই ভাষাকেই লিঙ্গ অনুযায়ী ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন: অনেক সময় মেয়েদের পরিচয় করিয়ে দিতে মেয়ে মানুষ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। মানুষ হিসেবে পরিচয় করানো হয় না। আমরা বুঝে না বুঝে সবাই-ই ভাষার মাধ্যমে নারীকে হেয় করি। এর পরিবর্তন আনতে নারীকেই প্রথমে নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে ভাবতে হবে।

নারী নেত্রী খুশি কবির বলেন, কর্মক্ষেত্রে নারীদের সবসময় প্রমাণ করতে হয় যে তারাও পারে। আমাদের সমাজে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে নারীদের একটা গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা হয়। শব্দকে তৈরি করা হয় নারীর বিরুদ্ধে। শব্দকে লিঙ্গভিত্তিক করা হয়। শব্দকে নারী-পুরুষে বিভেদ করা যাবে না। কোন শব্দের আলাদাভাবে মূল্যায়ন বন্ধ করতে হবে। যেমন মোটা হওয়া অথবা পাতলা হওয়া কেন নেতিবাচক হিসেবে ব্যবহার করা হবে, এমন প্রশ্নও তুলেন এই নারী নেত্রী।

দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন বলেন, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা অধিকাংশ নারীকে শব্দজটের মধ্যে আটকে রেখেছে। আমরা হয়তো অনেক কিছুই গুরুত্ব দেই না। এজন্য সংবাদ মাধ্যমেও নারীর প্রতি অসংবেদনশীল শব্দ ব্যবহার করা হয়। যদি এই বিষয়ক কোন নীতিমালা থাকতো তাহলে বিষয়টি এতো হালকা হিসেবে দেখা হতো না।

ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের সামাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নারীকে শব্দজটে আটকানো হয়। যেমন: মেয়েরা বিদ্রোহী হবে এটা আমাদের ভাষার অভিধানেই নেই। আর এটা হলো পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার ফল। একজন নারীও পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার হতে পারে। গালাগালির ক্ষেত্রে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীকেন্দ্রিক গালি দেয়া হয়। আর সমাজে এই বিষয়টি বিদ্যমান থাকে গণমাধ্যমের মাধ্যমে। বিভিন্ন ধরনের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে নারীকে দুর্বল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও নারীদেরই ত্যাগের মূর্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ছেলেদের তুলনা করা হয় বাঘ, সিংহের সঙ্গে। আর নারীদের তুলনা করা হয় সাপ ও হরিণের সঙ্গে।

নিউজ২৪ এর বার্তা প্রধান শাহনাজ মুন্নী বলেন, শব্দ আমাদের সামনে ছবি এবং অর্থ তৈরি করে। গণমাধ্যমে শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখন হয়তো কিছুটা পরিবর্তন আসছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার উল্টো চিত্র আমরা পাই। এই মাধ্যমে একজন নারীকে যেই পরিমাণ অবমাননাকর ভাষার মুখোমুখি হতে হয় তা বলার অযোগ্য। এ থেকে বুঝা পরিবর্তন শুধু বাহ্যিকভাবেই হচ্ছে। ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য অবশ্যই আমাদের ভিতরের জগতটাকে পরিবর্তন করতে হবে। সামাকজিকীকরণে আনতে হবে গুনগত পরিবর্তন।

প্রকাশক মাহরুখ মহিউদ্দীন বলেন, অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনে পুরুষদের যুক্ত করতে হবে। নারী-পুরুষ একে অপরের সম্পূরক। সম্পূরক হিসেবে তারা সমাজকে কিভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে তা নিয়ে কাজ করতে হবে। বাংলা ভাষায় সাহিত্যে লিঙ্গ সংবেদনশীলতা নিয়ে কাজ এবং সমালোচনার সুযোগ থাকতে হবে।

আলোচনায় পাঠ্যপুস্তক ও একজন শিশুর ছোটবেলার কথা উঠে আসে । আলোচকরা বলেন, একজন শিশু যখন ছোটবেলায় অপমানজনক ভাষার শিকার হয় তার প্রভাব অনেক মারাত্মক হয়। সারাজীবন হয়ত তাকে তা বয়ে বেড়াতে হয়। আবার পাঠ্যপুস্তকে যখন জেন্ডার অসংবেদনশীল শব্দ আসে তখন ওই শিশুর সামাজিকীকরণে আরো বড় প্রভাব পরে।

নারীরা যাতে শব্দের মাধ্যমে জব্দ না হন সেজন্য কিছু সুপারিশ উঠে আসে অনুষ্ঠানে।