২০১৬ সালের শেষ শুক্রবার, জাতীয় জাদুঘরের টিকেট কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন। বড়দের হাত ধরে দাঁড়ানো উৎসুক শিশুদের চঞ্চলতায় কিছুটা কোলাহল শাহবাগে। এই দৃশ্য পার হয়ে জাদুঘরের নিচতলায় ঢুকতেই চোখে আটকে গেলো সাদা-কালো কাপড়ে কালো-সাদা বর্ণে ছাপা ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকার নাম। কাপড়টিতে ফুটে আছে সদ্য স্বাধীন দেশে প্রকাশিত ইত্তেফাকের একটি শিরোনাম ‘সোনার বাংলায় মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড’।
কাপড়ে জড়ানো ফটক দিয়ে নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে ঢুকেই দেখা গেলো স্বচ্ছ একটি স্ট্যান্ডে ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ছবি সম্বলিত একটি স্থাপনাশিল্প। দেশের মুক্তি সংগ্রামে সোচ্চার সংবাদপত্র ইত্তেফাকের ৬৪ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে এভাবেই সাজানো হয়েছে গ্যালারিটি।
গ্যালারির ফটকের কাছে বসেছিলেন শিল্পী অভিজিৎ রায়। তার পাশেই দেয়ালজুড়ে একটি বিশাল নাটাই। নাটাইয়ের বাধা সুতোয় প্রকাণ্ড এক ঘুড়ি। নাটাই ঘুড়ির পেছনে মুক্ত আকাশ সাজানো হয়েছে ইত্তেফাকের পত্রিকার টুকরো সেটে। আরেকটি কাপড় ঘেরা অংশে প্রজেক্টরে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে ইত্তেফাক পত্রিকার সংবাদ উপস্থাপনা। সংগ্রামের আবহসংগীত বাজছে ৩ মিনিট ১৭ সেকেন্ডের এই ভিডিওতে।
ইতিহাসে ইত্তেফাকের চমৎকার উপস্থাপনা তুলে ধরে ‘শব্দ কল্প চিত্র’ নামের এই প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ২৯ ডিসেম্বর। প্রদর্শনীতে আধুনিক স্থাপনাশিল্পের মাধ্যমে ’৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ’৬৯’র গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ সালের ছবি, সংবাদ এবং ইত্তেফাকের ভূমিকা নিজের মতো করে সাজিয়েছেন শিল্পী অভিজিৎ ও সহশিল্পীরা।
গ্যালারিতে ‘পর্দা’ নামের স্থাপনা শিল্পটি অভিজিতের নিজের কাজ। এই শিল্পকর্মে পর্দাবন্দি না হয়ে মুক্তচিন্তার বিকাশের কথা বলতে চেয়েছেন তিনি। মুক্তির বার্তা দিতেই পর্দা উঠেছিলো ইত্তেফাকের। তিনি দেখিয়েছেন ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন ও নব্বইয়ে ইত্তেফাকের ওপর পর্দা নামানোর চেষ্টা প্রতিহতের ইতিহাস।
ইউডা’র ছাত্র নোমান হীরার ‘আদর্শলিপি’ নামের ইন্সটলেশনে ব্যবহার করা হয়েছে বহু পুরোনো সময়ের সাক্ষী একটি টাইপরাইটার।
যুগযুগ ধরে নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ৬৪ বছরে পা রাখলো ইত্তেফাক। পত্রিকাটির এই পথচলাকে শৈল্পিক উপায়ে উপস্থাপন করেছেন ঢাকা আর্ট কলেজের ছাত্র কপিল চন্দ্র রায়। পদক্ষেপ নামের এই স্থাপনায় তিনি নীরব পদচারণার ভাব প্রকাশে সিঁড়ির প্রত্যেকটি ধাপ হিসেবে ইট এবং পদক্ষেপের রূপক হিসেবে জুতা ব্যবহার করেছেন। পত্রিকাটির স্বাধীন চিন্তা প্রকাশ করেছেন পাখি ব্যবহার করে।
এই স্থাপনা শিল্প পাশ কাটালেই মনে হতে পারে হুট করে ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়ার অফিসরুমে ঢুকে পড়েছেন। সেখানে শোভা পাচ্ছে লাল মখমলে ঢাকা একটি টেবিল। তাতে ফ্রেমে বাঁধাই সম্পাদকের ছবি, একটি ডায়াল ঘোরানো পুরনো আমলের টেলিফোন সেট। একটি হ্যাংগারে ঝুলছে ধূসর একটি কোট। কাজের টেবিলটির ওপর একটি চশমার বাক্স, খবরের কাগজ এবং একটি ফাউন্টেন পেন, একটি চায়ের কাপ। বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দিনের সঙ্গের ছবিটিতে মুক্তির কলমসৈনিক মানিক মিয়া যেনো এখনো ইতিহাসের তথ্য যোগান দিয়ে যাচ্ছেন।
‘সম্পাদকের কক্ষ’ থেকে একটু এগিয়ে গেলেই দেখা গেলো একাত্তরের অস্ত্রহীন শব্দযুদ্ধের বার্তা দিচ্ছে ইউডা’র আরেক নোমানের স্থাপনাশিল্প ‘চরমপত্র’।
শুধু খটখটে সংবাদ নয়, পাঠকের মনে বিনোদন যোগানো ইত্তেফাকের কথা বলছে শিল্পী মাধবী সুলতানার উপস্থাপনানির্ভর শিল্পকর্ম ‘বিনোদিনী’। তারপরেই ইত্তেফাকের ঐতিহাসিক ও বর্ণিল যাত্রা পেপারে তৈরি নৌকার আদলে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ‘জলযাত্রা’ নামের আরেকটি শিল্পকর্মে।
কালের সাক্ষী এবং মুক্তিসংগ্রামের এসব প্রামাণ্য দলিল দেখতে আসাদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু- কিশোর। উঠতি তরুণ-তরুণীরা ব্যস্ত ছবি-সেলফিতে।
নিছক ঘুরতে আসাদের একজন ছবি তুলছিলেন ডামি আকৃতির একটি ইত্তেফাক পত্রিকায় বানানো ফোকরে মুখ রেখে। ভালো করে তাকাতেই দেখা গেলো, ফোকরটির নিচে লাল কালির শিরোনামে লেখা ‘আমরা তোমাদের আজও খুঁজিতেছি’।
২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে প্রকাশিত এই সংবাদ প্রতিবেদনটিতে লেখা হয়েছিলো শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা, ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সহযোগী কার্যনির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা শহীদ সিরাজুদ্দিন হোসেনের কথা।
ছবি: আক্কাস মাহমুদ